মৃত্যর মুখ থেকে ফিরে আসা

শেহাব উদ্দিন আহমদ ওরফে সারাজ ভাই। আমাদের চাচাতো ভাই। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থী। বর্তমানে লন্ডন প্রবাসী। প্রায় দুই দশক ছিলেন ক্যাটারিং শিল্পে। বর্তমানে অবসর যাপন করছেন প্রবাসে । লন্ডনের অদূরে সামরিক ছাউনির শহর কলচেষ্টার থেকে অদূরে কগোশেল শহরে ছিলেন প্রায় তিন দশক। রোমান আমলে নির্মিত শহর কগোশেলে দি ইস্টার্ন ভিউ নামের অভিজাত এবং জনপ্রিয় ভারতীয় রেস্তোরা পরিচালনা করেন প্রায় ৩০ বছরের অধিক কাল।১৯৯৫ সাল থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আমি ও কর্মরত ছিলাম ইস্টার্ন ভিউ রেস্তোরাতে।

এবার দেশে বেড়াতে এসে জানালেন, ১৯৭১ সনে ভাগ্য জোরে কিভাবে প্রাণে বেঁচে যান নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে। পারিবারিক এক কাজে ৭১ এর মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে অবরুদ্ধ সুনামগঞ্জ শহরে এলেন। পুরো শহর পাক হানাদার বাহিনীর দখলে। শহরের নানা স্থানে সামরিক চেক পোষ্ট। এর পূর্বে আমাদের গ্রামে থাকাকালীন সিদ্ধান্ত নিয়ে ছিলেন যত দ্রুত সম্ভব মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিবেন। সেই লক্ষ্যে তাহিরপুর সীমান্ত হয়ে ভারতের মেঘালয়ে চলে যাবার জন্য প্রাথমিক একটি পরিকল্পনাও ছিলো। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে আব্বার সঙ্গে চলে যেতে চেয়েছিলেন। বাঁধা দিলেন আব্বা। যেহেতু চাচা (শেহাব ভাইয়ের বাবা) বিলাত প্রবাসী এবং চাচার অবর্তমানে শেহাব ভাই পরিবারের অস্থায়ী প্রধানের দায়িত্বে ছিলেন, সেহেতু আব্বা তাকে সঙ্গে নিলেন না। যাবার কালে বলে গেলেন, “আমাকে আগে যেতে দাও, আমি গিয়ে দেখি ওপারে কী অবস্থা”।

সুযোগ বুঝে পরে ভারতে যাবার পরামর্শে ভাই সাহেব গ্রামের বাড়িতে থেকে গেলেন। দুই সপ্তাহ পর প্রবাসী চাচা লন্ডন থেকে বাড়ি এলেন। সেই সময় শেহাব ভাই আবারো চাইলেন ভারতের মেঘালয়ে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিবেন। তাই আব্বার মতামত এবং নির্দেশনা চেয়ে একটি দীর্ঘ পত্র লিখে নিয়মিত ভারতে যাতায়াতকারী একজন বার্তাবাহকের নিকট পৌঁছে দেন। সেই সময়কার অনেক ঘটনা তার মনে না থাকলেও সুনামগঞ্জের হাওর অঞ্চলকে শত্রু মুক্ত রাখতে যারা অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন তাদের ক’জনার নাম স্পষ্ট স্মরণ করলেন। তাঁরা হলেন- বেতাউকা গ্রামের কালা শফিক, তাড়ল গ্রামের সুজাত চৌধুরী, ছাত্র নেতা শহীদ মুক্তিযোদ্ধা তালেব উদ্দিনসহ আরো অনেক সাহসী মুক্তিসেনা। সুনামগঞ্জের দক্ষিণাঞ্চল সহ হবিগঞ্জ জেলার উত্তরের বিরাট হাওর এলাকা যুদ্ধ শুরু থেকে প্রায় অর্ধেকের বেশি সময় শত্রুমুক্ত ছিলো। শেহাব ভাইয়ের জবানবন্দী থেকে জানা যায় টানাখালী বাজারে স্থাপিত ক্যাম্প থেকে সুনামগঞ্জ সিলেট মহাসড়কে অনেক বার সফল অ্যাম্বুস করা হয় । যার কয়েকটিতে পাকবাহিনীর জানমালের ক্ষতি হয় ব্যfপক। কয়েকটি বড় সফলতার একটি ছিলো পাগলা ও জয়কলস বাজারের মধ্যবর্তী মদনপুরের সেতু বিস্ফোরক সহযোগে উড়িয়ে দেওয়া, অন্যটি ছিলো আহসানমারা ফেরি ঘাটের দু’টো কাঠের ফেরিকে ধ্বংস করে নদীতে ডুবিয়ে দেওয়া।

টানাখালী বাজারে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্পটি আমাদের গ্রাম থেকে মাত্র তিন চার মাইল দূরে ছিলো বিধায় মুক্তিযোদ্ধারা প্রায়ই আমাদের গ্রামে এসে বিশ্রামের পাশাপাশি কখনো দুপুর বা রাতের খাবার খেয়ে যেতেন। তাদের অনেকেই ছিলেন শেহাব ভাইয়ের সহপাঠী কেউ আবার শহরের পরিচিত স্বজন। তাদের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ছিলো শেহাব ভাইয়ের। মে মাসের শেষ দিকে মেঘালয়ে অবস্থানরত আব্বার নিকট যুদ্ধে অংশ নেবার আগ্রহ প্রকাশ করে আরও একটি মর্মস্পর্শী চিঠি লিখলেন তিনি। চিঠিটি মুক্তাঞ্চল থেকে বয়ে নিয়ে যান তৎকালীন তুখোড় ছাত্রনেতা মুক্তিযোদ্ধা সুজাত চৌধুরী। স্বাধীন হওয়ার পর সুজাত চৌধুরী বর্ণনা দিয়েছিলেন সেই চিঠিখানায় দেশ মাতৃকার জন্য কী পরিমাণ আকুলতা ও জীবন বাজী রাখার অঙ্গীকার ছিলো। আব্বা চিঠি পড়ার সময় জেলার প্রথম সারির দু’জন বিশিষ্ট নেতাও উপস্থিত ছিলেন। চিঠির ভাষায় যাদের চোখও হয়েছিলো অশ্রুসজল।

শেহাব ভাইয়ের এবারের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হলো। আব্বা অভয় দিয়ে বললেন, সঠিক সময়ে শেহাব ভাইয়ের মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের ব্যবস্থা করবেন। কারণ সেই সময় আমার প্রবাসী চাচা পরিবারের নিরাপত্তায় উদ্বিগ্ন হয়ে দেশে আসার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি চাইছিলেন শেহাব ভাই যেন বাড়িতে অবস্থান করেন। যা আব্বা জেনেছিলেন চাচার দেয়া পত্র মারফত। লন্ডন থেকে বিমান যোগে ঢাকায় সহজে নামলেও গ্রামের বাড়িতে আসার সময় পোহাতে হয়েছে নিয়মিত ও অনিয়মিত সামরিক বাহিনীর নানা প্রকার উৎপাতের। পাশাপাশি ছিলো দেশি দালাল ও রাজাকারদের নানা মানসিক অত্যাচার। বাড়িতে এসে চাচা প্রথমে শুরু করলেন শেহাব ভাইকে চোখে চোখে রাখা। এর মাঝে চাচার নজর ফাঁকি দিয়ে তিনি প্রায়ই চলে যেতেন টানাখালী বাজারে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্থায়ী ক্যাম্পে। তাদের নিকট পৌঁছে দিতেন পাকবাহিনী ও রাজাকারদের গতিবিধির খবরাখবর। তেমনি এক সাক্ষাতে ক্যাম্পের অপারেশন পরিচালকের একটি অনুরোধ রক্ষা করতে সিদ্ধান্ত নেন অবরুদ্ধ সুনামগঞ্জ শহরে ফিরে যাবেন।

সেই পরিকল্পনা মাথায় রেখে আরেক বড় ভাই গিয়াস উদ্দিন আহমদ (বর্তমানে প্রবাসী) কে সাথী করে রওনা করেন সুনামগঞ্জ শহরে। পাগলা বাজার পর্যন্ত হেঁটে ৪৪ মডেলের বাসে দিনের মধ্যভাগে নামেন শহরের বাসস্ট্যান্ডে। শহরজুড়ে ভয়ার্ত পরিবেশ। মিলিশিয়া ও রাজাকারদের লাল চোখের রাজত্ব। পথচারীসহ যাকেই সামনে পাচ্ছে তাকেই ধমকাচ্ছে। অশালীনভাবে তল্লাশি করছে নিরাপত্তার নামে, পকেট হাতিয়ে টাকা পয়সা নিয়ে বেতের ঘা মেরে তাড়িয়ে দিচ্ছে। প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে নীরবে সব মেনে নিয়ে চলে যাচ্ছে সবাই।

এই মন খারাপ করা পরিবেশে বেশিক্ষণ থাকতে মন না চাওয়ায় এক পরিচিত রিক্সায় শহরের পূর্বে কুড়িয়ার পাড়ের নিজ বাড়িতে চলে যান। সেখান থেকে রিক্সাযোগে হাসন নগরস্থ এক আত্মীয়ের বাসায় নামার পর মুখামুখি হলেন এক ভীতিকর অবস্থার। পরিচিত সেই রিক্সাওয়ালা দ্বিগুণ ভাড়া দাবি করে বসলো। শেহাব ভাই প্রতিবাদ করলে রিক্সাওয়ালা ধমকের সুরে বললো, “আমি জানি আপনি কে, কেন শহরে এসে ঘোরাফেরা করছেন মনে করেন আমি বুঝি না? বেশি কথা বললে পাঞ্জাবীদের কাছে আপনার কথা বলে দেবো।” সঙ্গে শুনিয়ে দিলো তার বর্তমান অবস্থান আমাদের পাড়া সংলগ্ন এক পাক দালালের বাসায় এবং রিক্সার মালিক সেই পাক দালালের ছোট ভাই।

একের পর এক ভীতিকর অবস্থার মোকাবিলা করতে করতে এক সময় ভেঙ্গে পড়েন তিনি। সিদ্ধান্ত নিলেন শহর সংলগ্ন গ্রামের পাঠান বাড়িতে আমাদের চাচাতো বোনের বাড়ি চলে যাবেন। চাচাতো বোনের স্বামী মরহুম আব্দুল মান্নান ছিলেন স্থানীয় এইচ এম পি উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক। আগ পিছ না ভেবে বোন জামাইর সঙ্গে চলে গেলেন পাঠান বাড়ি। দুই দিন পর লোক মারফত কিছু গুরুত্বপূর্ণ খবর সংগ্রহ করে সিদ্ধান্ত নিলেন গ্রামের ফিরে যাবেন। পরিকল্পনা মত শহরের বাড়ি হয়ে গ্রামের আসতে পাঠান বাড়ি থেকে রওয়ানা দিলেন বিকাল বেলা। আধাঘণ্টা চলার পর এসে উঠলেন শহরমুখী সদর রাস্তায়। যেটির শুরু হয়েছিলো বুড়িস্থল গ্রামের শেষ প্রান্ত হতে।

শহরতলীর কাঁচা পাকা রাস্তা ধরে মিনিট চারেক চলার পর সোনাখালী নদীর উপর বড়সড় একটি ব্রিজ। যার পাহারায় নিযুক্ত ছিলো কিছু পাঞ্জাবি সৈনিক ও মিলিশিয়া এবং ১০/১২ জন রাজাকার। এদের একদল সার্বক্ষণিক অবস্থান করতো সেতুর দুই প্রান্তে মজবুত করে তৈরি বাঙ্কারে। বাকিদের কয়েকজন সেতু উপর টহল দিতো এবং সেতু পারাপারকারীদের জিজ্ঞাসাবাদ করতো। ওদের মধ্যে সুবেদার পদ মর্যাদার একজন পাঞ্জাবি সৈনিককে সবাই ভয় পেতেন। সে নাকি প্রায়শই পথচারীদের নানা শারীরিক অত্যাচার করতো। সোনাখালী সেতু দিয়ে নিয়মিত চলাচলকারী লোকজনের কাছে সে ছিলো মূর্তিমান আতঙ্ক। শেহাব ভাইকে শেষ বিকালে মুখামুখি হতে হলো এই পাঞ্জাবি জল্লাদের।

সেতুতে উঠতে না উঠতে সেই অত্যাচারী সুবেদার শেহাব ভাইয়ের গতিরোধ করে বেরিয়ে এলো সেতুর মুখের একটি চায়ের দোকান থেকে। ওকে দেখা মাত্র শেহাব ভাইর শিরদাঁড়া বেয়ে নেমে এলো ঠাণ্ডা স্রোত। সেতুর থেকে নীচে নেমে তার সামনে দাঁড়াতে আদেশ করলো বেশ কড়া ভাষায়। সেতুর মুখে দাঁড়িয়ে থাকা শেহাব ভাইয়ের সামনে এসে দাঁড়ালো পাঞ্জাবি সেই জল্লাদ। চিবিয়ে চিবিয়ে অশ্রাব্য গালি সহকারে প্রথম প্রশ্ন,
-শালা তুম কিদার সে আয়া?
শেহাব ভাই দেরি না করে জবাবে বললেন,
-পাঠান বাড়ি সে আয়া।
বলার সঙ্গে সঙ্গে পাঞ্জাবি রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বললো,
-কিয়া তুম পাঠান মল্লুক সে আয়া? শালা হামাকো সাথ মজাক কর রাহা হে।
বলেই আবার শুরু করলো বাজে ধরনের গালি গালাজ! শেহাব ভাই তো এমনিতে ভয়ে কাঁপছেন তার উপর ওর এই রণমূর্তি দেখে আরো বেশি ভয় পেয়ে গেলেন। তিনি বুঝতে পারছেন না পাঠান বাড়ি বলাতে পাঞ্জাবি সৈনিকটি ক্ষেপে গেলো কেনো? ঠিক। তখনই শুনলেন জল্লাদ সুবেদারটি আরেক সৈনিককে ডেকে বলছে, শালা গাদ্দার কো বাঙ্কার মে লে যাও! লাগতা হ্যায় ও শালা মুক্তি হায়।

যখনই বলছে বাঙ্কার মে লে যাও সংগে সংগে শেহাব ভাই ধরে নিলেন ওদের উদ্দেশ্য খারাপ। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন অবরুদ্ধ শহরে যাদের এভাবে সন্দেহ করে বাঙ্কারে নিয়ে গেছে, তাদের কেউ আর ফেরত আসেনি। সেকেন্ডের ভিতর শেহাব ভাইয়ের চোখে ভেসে উঠলো বাবা মা ভাই বোনসহ সকল আপনজনের মুখ। নিশ্চিত জানেন আর কতক্ষণ পর শেহাব ভাই গুলি করে মেরে ফেলে দিবে সোনাখালী নদীতে। প্রিয় স্বজনেরা কেউ জানবে না শেহাব ভাইয়ের গুলিবিদ্ধ লাশ ভেসে বেড়াচ্ছে সোনাখালীর কালো জলে।
কোন কূল-কিনারা না দেখে পরিচিত সেই চা দোকানের মালিক চাঁন মিয়াকে বললেন, ভাই একটু ওদের বলো না আমি তো মুক্তি না। চা দোকানের মালিক তৎক্ষণাৎ জল্লাদ সুবেদারকে ডেকে বললো, সাব শুনেন আমি ঐ যুবককে চিনি। সে মুক্তি না। ভাল মানুষ। আমাদের পাড়াতেই থাকেন। উনাকে ছেড়ে দিন। আল্লাহ পাঠানো ফেরেশতার মত চাঁন মিয়ার কথা শুনে শেহাব ভাইকে বাঙ্কারে নিতে আসা সৈনিককে হাতের ইশারায় থামিয়ে দেয় সে। বেশ জোরে সোরে আবার চাঁন মিয়াকে জিজ্ঞেস করছে, তুমি সত্য বলছো তো? তুমি ওকে ভাল করে জানো! আমি কিন্তু তোমার কথা বিশ্বাস করে গাদ্দার কো ছোড় দিয়া, তবে চেহেরা দেখে তো আমার মনে হলো নির্ঘাত মুক্তি হবে। তার উপর আমার সঙ্গে মজাক করে বলে কিনা পাঠান মুল্লুক থেকে এসেছে। শালা বাঙাল মুল্লুক মে পাঠানকো কিদার মিলে গা!

৪৭ বছর পর এসেও শেহাব ভাইয়ের কণ্ঠে ভয়। ভয়ার্ত কণ্ঠে বললেন, সোনাখালী নদীর পাড়ের সেতুর মুখের চা দোকানী চাঁন মিয়া ভাইয়ের কারণে আমার জীবনের এক্সটেনশন টাইম চলছে। জল্লাদ পাক সুবেদার মেজরের শেষ আদেশ ছিলো, জলদি করে আমার চোখের সামনে থেকে সরে যা, তোকে এখানে আর কখনো যেনো না দেখি।

লিখেছেন: ইশতিয়াক রূপু