পারাপার

সাল উনিশ’শ একাত্তর। জুলাই মাসের চটচটে গরম। ঘামের রেখা তার জুলফি বেয়ে পরছে। উনি যে কপালের ঘাম মুছবেন সে উপায় ও নেই। মাথায় গুলির বাক্স।

এতো ভারী বাক্স দুই হাতে ধরে কোনো ভাবেই কপালের ঘাম মোছা সম্ভব নয়। ওনার সঙ্গে আছেন আরেক অধ্যাপক ওনার সহকর্মী।

অধ্যাপক তার স্ত্রী, পুত্র কন্যাদের মুক্তাগাছায় নিরাপদে রেখে এসেছিলেন বাড়ির কী অবস্থা দেখতে। এসে দেখলেন এক অংশ পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। অবাক ব্যাপার হচ্ছে ওনার বিয়েতে উপহার পাওয়া টি সেট আর ডিনার সেটগুলো কীভাবে যেন অক্ষত আছে।

মানুষ মারা যাচ্ছে যুদ্ধে আর জড় বস্তু অক্ষত। বাড়ি থেকে বের হয়ে বড় রাস্তার মোড়েই মিলিটারি ওনাকে আর ওনার সহকর্মীকে ধরল।

তারপর থেকে শুরু হয়েছে মাইলের পর মাইল হাঁটা। মাথায় একটা গুলির বাক্স চাপিয়ে ওনার সহকর্মীর উচ্চতা নিয়ে রসিকতা করেছে মিলিটারিদের একজন। কেমন একটা অসভ্য জাতি!

অধ্যাপককে উর্দুতে যা বললেন সেনারা তার অর্থ দাঁড়ায় পা চালিয়ে চল।

উনি শুরুতেই ওদেরকে একটা মিথ্যে বলেছেন। নিজের পরিচয় গোপন করে বলেছেন উনি পিওন। একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করলেন উনি।

শুনেছেন প্রিয় শিক্ষক ঋষিসুলভ অধ্যাপক গোবিন্দ চন্দ্র দেবকে না কি পাকিস্তানী আর্মি হত্যা করেছে পঁচিশে মার্চের রাতে। অপারেশন সার্চলাইটের সময়। প্রিয় শিক্ষকের মুখখানি এখনো ওনার চোখে ভাসছে। ডাক্তার জি সি দেব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ে ওনার প্রিয় শিক্ষক ছিলেন।

কেন যেন ছেলেমেয়েদের মুখ চোখের ওপর ভাসছে।তা র দুই মেয়ের চেহারা অবিকল ওনার নিজের চেহারা কেটে বসান যেন। তার ছেলে দেখতে হয়েছে মায়ের মত। একটা ভয় পেটের মধ্যে পাক দিয়ে উঠছে। ওনার স্ত্রীর মুখও একবার মানসপটে ভেসে উঠল। আর কখনো কি প্রিয় মুখগুলো দেখতে পাবেন?
সকাল থেকে কিছু খাবার পড়েনি পেটে। সেই যে রাস্তা থেকে ধরে নিয়ে এল।

ওনার সহকর্মী এবার মৃদু স্বরে বললেন,”ভাই আজকে ফজরের নামাজ পরে বের হয়েছিলাম। শুনেছি এরা নাকি কাজ শেষে গুলি করে দেয়।”
সহকর্মীকে অভয় দিলেন,”না আমাদেরকে বোধ হয় ছেড়ে দেবে।”

নুরুজ্জামান সাহেব ওনার কথা বিশ্বাস করলেন না।

“নাপাক অবস্থায় মৃত্যু হলে কি বেহেস্ত নসীব হবে?”

ষোলো বছর বয়সের পর জ্ঞানত নামাজ কাজ পারেননি অধ্যাপক। মৃত্যু পথযাত্রী মা এক অদ্ভুত শর্ত দিয়েছিলেন তার তিন পুত্র সন্তানকে। যেই ছেলে সারা জীবন নামাজ পরবে উনি তার সেবা গ্রহণ করবেন। উনি চুপ করে রইলেন।

নুরুজ্জামান সাহেব বলে চলেছেন,”আমার ছোট মেয়েটা খুব কাঁদছিল আজকে। আসলে আজকে বাড়ি থেকে বের হয়ে ভুল হয়েছে।”

কথা বলতে বলতে দু’জনে বোধ হয় একটু পিছিয়ে পড়েছিলেন। হঠাৎ পেছন থেকে অশ্রাব্য গালি ভেসে এল। উর্দুতে চিৎকার। গল্প না করে জলদি পা চালাও।

অধ্যাপককে এসে এক সেনা বলল, “ওই খাটো লোককে বিশ্বাস করি না আমরা। ওদের মাথায় প্যাচের বুদ্ধি থাকে। তুমি লম্বা মানুষ। ওর কথায় ভুলে উল্টা পাল্টা কিছু করো না।”

কী অসম্ভব বর্ণবাদী একটা জাতি। বাঙালি মেয়েদেরকে ধর্ষণ করার কারণ হিসাবে নাকি অজুহাত দিয়েছে ওদের ওরসের সন্তানেরা হবে প্রকৃত মুসলমান। খাটো শ্যামবর্ণ বাঙালিদেরকে ওরা সাচ্চা মুসলমান মানতে নারাজ।

অধ্যাপক উত্তরে কিছু বললেন না। একটা ঢোক গিললেন। ইশারায় সহকর্মীকে বললেন চুপ থাকতে। নুরুজ্জামান চুপ হয়ে গেলেন। আসন্ন মৃত্যুর জন্য মনে মনে প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

অধ্যাপক তখনও জানেন না ওনার স্ত্রীর বোনের জামাই আর তার পরিবারে কী ভয়ঙ্কর বিপর্যয় হয়ে গেছে। পাকিস্তানী মিলিটারি সবার সামনে দিনের বেলায় গুলি করে ওনার ভায়রা ভাইকে হত্যা করেছে। বাবা তার ছেলের লাশ দেখে আর্তনাদ করছিল। তাকেও গুলি করে মেরেছে। তিন মাস বয়সী শিশু সন্তান নিয়ে ওনার শালী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পাবনার পথে রওনা হয়েছেন।

মনে মনে একটা অসম্ভব প্রতিজ্ঞা করলেন তিনি। এ জীবনে সন্তানদের বকাঝকা করবেন না। পর মূহুর্তেই হাসি পেল তার। সন্তানেরা অসম্ভব চঞ্চল । এই প্রতিজ্ঞা রাখতে পারবেন বলে মনে হয় না।

আজানের মধুর আহবান ভেসে আসছে। মাগরিবের ওয়াক্ত হয়ে গেছে। সেই ভোরবেলা থেকে হেঁটে হেঁটে উনারা পাবনা শহর থেকে নগরবাড়ি ফেরিঘাটে এসে পৌঁছেছেন। দশজনের মিলিটারি একটা দলের সঙ্গে এতক্ষণ এসেছেন। দেখলেন ওদের সঙ্গে আরেকটা বড় দল এসে যোগ দিল।

গুলির বাক্সগুলো দুইটা স্পীডবোটে তুলে দেবার নির্দেশ দিল ওরা। বেশিরভাগ পাকসেনা এখন স্পীডবোটের কাছে। পুরনো দলের বেশিরভাগ সৈন্য ওই স্পীডবোটে উঠেছে। নতুন যারা এসেছে তারা এখন অধ্যাপক আর তার সহকর্মীকে পাহারা দিচ্ছে।

বোটে উঠে যাবার সময় অধ্যাপক আর তার সহকর্মীকে দেখিয়ে কি একটা ইশারা করে গেল সেনা দলের একজন।অধ্যাপক বুঝতে পারছেন ওনার অন্তিম সময় নিকটে।

মাগরিব আর এশার মাঝামাঝি সময়ে ওনার স্রষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ হবে। শুকনো মাটি হাতে তুলে নিয়ে তৈয়াম্মুম সেরে নিলেন। মনে মনে স্ত্রী পুত্র কন্যাদের ছবি আরেকবার দেখছেন।

স্পীডবোট প্রায় দশমিনিট চোখের আড়াল হল। সঙ্গে সঙ্গে নতুন দলের একজন সেনা এগিয়ে এলো তাদের দিকে। এসে বলল ওনাদেরকে পালিয়ে যেতে। ওরা বলল যাবার আগে ওদেরকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে যেন এই দুই বাঙালিকে গুলি করে মেরে নদীতে লাশ ভাসিয়ে দেয়া হয়।

আর কখনো ওদেরকে দেখলে গুলি করে মারবে। নতুন সেনাদল পাকিস্তানের বেলুচিস্তান থেকে এসেছে। ওদের কথা অনুযায়ী পাঞ্জাবি পাকিস্তানীরা ওদেরকেও শোষণ করছে। তাই ওদের দয়া হয়েছে এই দুই নির্দোষ মানুষের ওপর। অধ্যাপক হতবুদ্ধি হয়ে তাকিয়ে আছেন।

মাগরিবের পবিত্র ওয়াক্তে তার প্রার্থনা মঞ্জুর করেছেন সৃষ্টিকর্তা। উনি আর ওনার বন্ধু প্রাণের ভয়ে দৌড়ে পালালেন। সারারাত সফর করে পরদিন দুপুরে মুক্তাগাছায় পৌঁছুলেন যেখানে নিরাপদে আছেন তার স্ত্রী আর সন্তানেরা।

ফারহানা সিনথিয়া

পুনশ্চ: আমি যখন এই লেখাটি লিখছিলাম তখন টরেন্টোর একটি পত্রিকার হেডলাইন ছিল বেলুচিস্তানের একজন মানবাধিকার কর্মী করিমা বালোচকে নৃশংস ভাবে হত্যা করা হয়েছে। বেলুচিস্তানের স্বাধীনতাপন্থীদেরকে সন্ত্রাসবাদী আখ্যা দিয়েছে অনেক দেশ। আমাদের একটি পতাকা, মানচিত্র আর নিজেদের মুখের ভাষা আছে।

উপরের লেখাটি আমার জবানিতে আমার নানার জীবনের গল্প। নানাভাই ফিরে এসেছিলেন। এই গল্প আমাকে শুনিয়েছেন। ওনার মুখে আমি শহীদ আনোয়ার পাশা, শহীদ অধ্যাপক জি সি দেব আরো অনেকের গল্প শুনেছি। যাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা এই দেশ পেয়েছি জাতীর সেই সব শ্রেষ্ঠ সন্তানদের গভীর শ্রদ্ধা ভরে স্মরণ করছি।