মধুরেণ সমাপয়েৎ

আজ ইমন আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। না একেবারে যাচ্ছে না। তবে আমাদের বিচ্ছেদের পর্বটা শুরু হতে যাচ্ছে আজ থেকে। তার মানে কি দাঁড়াল এতদিন আমরা একসাথে ছিলাম? আদৌ ছিলাম কি? প্রশ্নটা একটু বেশি কঠিন হয়ে গেল না?

ইমনকে ভালো না লাগার প্রথম কারণ হচ্ছে ওর নামটা। দুনিয়ায় এত নাম থাকতে ওর বাবা মায়ের এই নামটা রাখার কি এমন দরকার পড়েছিল? প্রতিবার ইমনকে ওর নাম ধরে ডাকতে গেলে আমার বুকের ভেতরটা মোচড় দিয়ে উঠে। বাসর রাতে তো বিরক্তিতে বলেই ফেলেছিলাম,

—  এই আপনার নাম ইমন কেন? এই নামটা শুনলেই আমার অসহ্য লাগে।

 — কেন ? তোমার এক্স বিএফ এর নাম বুঝি ইমন ছিলো ?

আচ্ছা, এই বুড়োটা জানলো কী করে আমার মনের কথা? বিয়ের প্রথম দিনেই দেখি একেবারে মনের ভেতর ঢুকে বসে আছে।

ইমন নামে সত্যিই একজন ছিল আমার জীবনে। কৈশোরের প্রেম বলে কথা। তাই হয়ত আজও সেই স্মৃতি গুলো যখন তখন মনে দোল দিয়ে যায়। তখন আমাদের দুজনেরই বয়স কম ছিল। তাই দুজনের শরীরে চলছিল অক্সিটসিন আর ডোপামিনের বেখেয়ালি দৌড়াদৌড়ি। এই দুই হরমোন যা মানুষের প্রেমের সময় রক্তে প্রবাহিত হয় খুব করে। যা দুজনকে কাছাকাছি আনার জন্যে দায়ী এবং যা দুজনের ভালবাসার পেছনে মূল নিয়ামকের একটা কাজ করে। এই দুই হরমোনের কারণেই একে অপরের স্পর্শ পেতে ভালো লাগে। একান্তে থাকতে ইচ্ছে করে। আমাদের মধ্যেও তাই হয়েছিল। তবে ইমনের অনুভূতিগুলোতে যে এত তাড়াতাড়ি ধুলোর আস্তরে ঢাকা পড়বে তা কখনো ভাবতে পারিনি। যখন বুঝতে পারলাম, তখন একটু একটু করে নিজেকে ওর কাছ থেকে সরিয়ে নিলাম। সেই থেকেই ইমন নামটা শুনলেই আমার কান ঝাঁ ঝাঁ করে ওঠে।বেছে বেছে কিনা এই নামেরই একটা ভ্যামড়া বুড়োর সাথে ঠিক হলো আমার বিয়ে ! মাকে যখন বললাম এই বিয়েতে আমি কিছুতেই রাজী নই, মাও কিন্ত তখন আমাকে কম কথা শুনায় নি।

— বলি আর কত জ্বালাবি আমাকে? জন্মের পর থেকে জ্বালানো শুরু করেছিস। এবার তো ক্ষান্ত দে।এই ছেলে সব দিক দিয়ে ভালো। তারপরেও তুই এত কথা বলিস কোন সাহসে?

— উনি আমার চেয়ে দশ বছরের বড়। একটু তো বোঝার চেষ্টা করো মা। 

— তা তুই কি কচি খুকী! ভুলে যাস না, তোর বয়সও কম হয় নি।

— আমার বয়স যাই হোক না কেন মা, উনি সারাজীবনই আমার চেয়ে দশ বছরের বড় থাকবে।

আমার কথার কোনো উত্তরে না গিয়ে মা বললেন,

— আজ তোর বাবা বেঁচে থাকলে কী আমার এত চিন্তা করতে হত রে মা! আমি কয়দিনই বা বাঁচব।যাবার আগে আমার মেয়ের হাতটা এমন কারো হাতে তুলে দিতে চাই, যার উপর আমি চোখ বুজে ভরসা করতে পারি। ইমন ছেলেটা সত্যিই একটা হীরার টুকরো। তুই অমত করিস না মা।

ইমোশোনাল ব্ল্যাকমেইল আর কাকে বলে ! এরপর কী রাজী না হয়ে পারা যায়?

বাসর রাতে আমার হাতটাও ওকে স্পর্শ করতে দিলাম না। সেই সাথে আকারে ইঙ্গিতেও বুঝিয়ে দিলাম আমায় নিয়ে মনের ভেতর স্বপ্নের জাল বুনে কোনো লাভ নেই। একটা হাবড়া বুড়োর সাথে ভালবাসাবাসি করার আমার অত শখ নেই। বিয়ের পর দিন থেকে শুরু হলো আমাদের রবোটিক জীবনযাপন। সারাদিনে আমাদের দুজনের প্রয়োজনীয় দুএকটা কথা ছাড়া তেমন কিছুই বলার থাকত না। এক্ষেত্রে দোষটা আসলে আমারই।ইমনকে আমিই কখনো ধারেকাছে ঘেঁষতে দিতাম না। বেচারা অবশ্য অনেক চেষ্টা করেছে। শুধু একদিন ওর সাথে সারারাত বকবক করেছিলাম।যদিও সেদিন আমি জ্বরের ঘোরে একটু বেশি আবোল তাবোল বকছিলাম। কথা বলতে বলতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম তা নিজেও জানি না।ভোরের সোনালী আলো পর্দার ফাঁক গলে আমার চোখের পাতা ছুঁয়ে দিতেই ঘুম ভেঙ্গে গেল। চোখ মেলে দেখি ইমনের বুকে মাথা রেখে আমি শুয়ে আছি। ইমন এক হাত মাথার নীচে ভাঁজ করে শুয়ে আরেক হাতে আমাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। ওর উষ্ণ নিঃশ্বাস বারবার আমার কপালের ওপরের ছোট ছোট চুলোগুলোকে এলোমেলো করে দিচ্ছিল। ওর চোখে চোখ পড়তেই লজ্জায় মরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছিল।

— আমি তো আহামরি সুন্দরী না। তাহলে এমন ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকেন কেন সবসময়?

আমার লাজুক হাসি দেখে ইমন দুষ্টু হেসে বলেছিল,

— তোমরা মেয়েরা জাতে মাতাল তালে ঠিক। কিভাবে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে অন্যের মুখ থেকে নিজের প্রশংসা শুনতে হয় তা ভালোই জানো। 

সেদিনের পর থেকে ইমন কেমন যেন পাগল পাগল হয়ে থাকত আমার জন্য। মুখে কিছুই বলত না। তবে ওর চোখের ভাষা আমাকে নীরবে অনেক কিছু বলে দিত; কিন্ত তাতেও আমার মন গলেনি। কোনো ভাবেই আমি ওকে আপন ভাবতে পারছিলাম না। পারছিলাম না নাকি….চাইছিলাম না?

দিনগুলো যেমন তেমন করে একরকম কেটে যাচ্ছিল। দেখতে দেখতে আমাদের প্রথম বিবাহ বার্ষিকীর দিনটা ঘনিয়ে এলো। জানি না ইমনের এই দিনটা ঘিরে বিশেষ কোন আয়োজন ছিলো কিনা। তবে আমি বহু দিন আগে থেকেই মনে মনে সব ঠিক করে রেখেছিলাম। ও অফিস থেকে ফেরার পর সব বলে দিলাম। এই লোক দেখানো ভালো থাকার অভিনয় আমাকে দিয়ে আর হবে না। আমি এই অদৃশ্য শেকল থেকে মুক্তি চাই। ইমন গালে হাত রেখে গভীর মনোযোগ দিয়ে আমার সব কথা শুনছিল।এরপর খুব স্বাভাবিক ভঙ্গিতে রাতের খাওয়া দাওয়া শেষ করে ঘুমিয়ে পড়ল। ভাবটা এমন যেন কিছুই হয়নি। ইমনকে দেখে বোঝার কোন উপায় নেই ওর মনের ভেতর কী চলছে। কথাগুলো বলে উল্টো আমি নিজেই যেন ধাঁধার মধ্যে পড়ে গেলাম। সকালে উঠে ইমন ব্যাগ গোছাতে গোছাতে বলল, ওর পোস্টিং নাকি এবার টাঙ্গাইলে হয়েছে। আপাতত একাই ওখানে যাচ্ছে। তাই আমিও নিজের মত করে ভাবার সময় পাব। দু-তিন মাস বা চাইলে এর চেয়ে বেশি সময় একা থাকার পর আমার যদি সত্যিই মনে হয় আমি ওর সাথে থাকতে চাইছি না, তাহলে ও আর কোনো বাঁধা দেবে না।

দাঁতে দাঁত চেপে ওর সব কথা চুপচাপ শুনছিলাম। কী বলব? রাগে তো গা জ্বলে যাচ্ছে। টাঙ্গাইলে পোস্টিং হয়েছে এতবড় কথাটা সে নাকি ব্যাগ গোছাতে গোছাতে আমাকে বলছে। ওদিকে তখনো কিন্ত আমার নিজের মনের খবরই আমার কাছে নেই। ওকে ছাড়া মাস, সপ্তাহ আর দিন কাটানো তো দূরের কথা এক মুহূর্তও আমি থাকতে পারব না। কবে থেকে আমি ওকে একটু একটু করে ভালোবাসতে শুরু করেছি তা নিজেরও জানা নেই।এই কথাটা বুঝতে আমার একটা বছর লেগে গেল ! ইমন না বললেও আমি জানি ও আমাকে কতটা ভালোবাসে ; কিন্ত ভালোই যদি বাসে তাহলে এভাবে আমার ছেড়ে যাওয়ার কথা চুপচাপ মেনে নিলো কেন? কেন নিজের ভালবাসার প্রতি কোন অধিকার দেখালো না? কেন আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল না, 

— স্মরণীকা তুমি আমাকে ছেড়ে কোথাও যেতে পারবে না।

হাতের তালু দিয়ে চোখ মুছে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালাম। কান্নাকাটি করে সময় নষ্ট করার মত সময় এখন আমার হাতে নেই। যেতে যেতে ওর ট্রেন যেন কটায় বলেছিল ইমন? যাওয়ার সময় নাস্তাটা পর্যন্ত করে যায় নি লোকটা। মাঝে মাঝে ওকে যে কী করতে ইচ্ছে হয় আমার? এখন গিয়ে যদি স্টশনে ওকে খুঁজে না পাই? না পেলেও সমস্যা নাই। ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল যেতে দু-আড়াই ঘন্টার বেশি লাগে না নিশ্চয়। দরকার হলে আমিও যাব।

স্টেশনে পৌঁছে যখন আমি হণ্যে হয়ে ইমনকে খুঁজে বেড়াচ্ছি, তখন ও কিনা পকেটে হাত গুঁজে গুটিগুটি পায়ে আমার পিছু পিছু এগোচ্ছিল। একটু দূর থেকে পেছন পেছন আসছিল বলে খেয়াল করিনি। হঠাৎ কী কারণে যেন পেছন ফিরতেই চমকে উঠলাম। ইমন কিছু বলার আগেই আমি এক দৌড়ে ওকে জড়িয়ে ধরলাম। বেচারা ইমন কী বলে আমার কান্না থামানো যায় ভেবে পাচ্ছিলো না।

— আমি জানতাম তুমি আসবে। তবে এমন সিনেমেটিক স্টাইলে ছুটে আসবে অতটা ভাবিনি।আরে পাগলী, তোমাকে ছেড়ে আমি কোথাও যাব নাকি ! 

আমি দ্রুত কান্না থামিয়ে বললাম,

— তাহলে তখন যে বললে ? 

ইমন দুষ্টু হেসে বলল,

— আরে আমার কোনো বদলি ফদলি হয় নি। ওটা তো বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষ্যে তোমার ভালবাসার পরীক্ষা নিচ্ছিলাম।

আমি ওর বুকে আলতো করে দিলাম কটা ঘুষি মেরে। ইমন বাঁধা দিয়ে বলল,

— আমিও প্রতিটা মারের শোধ নেব। তবে এখানে নয়, আগে বাসায় চলো।

আমি ইমনের মত অত দ্রুত পা চালাতে পারছিলাম না। তাই পেছন থেকে ওর জ্যাকেট টেনে ধরলাম।

— বাসায় যাব না। চলো তোমার টাঙ্গাইলে দুটো দিন ঘুড়ে আসি তারপর ফিরব। ওখানে জমিদার বাড়ি, ডিসি পার্ক আরো কি কি যেন আছে সব ঘুরে আসবো।

— সত্যি যাবে?

ইমনের চোখে মুখে খুশির ঝিলিক।

— কিন্ত এই অবস্থায়? 

— মেয়েদের মত করবে নাতো, এখন এতকিছু ভাবাভাবির মুড নেই। তুমি অফিসে ফোন করে দু-একদিনের জন্য ছুটি নাও। তারপর জলদি টিকিট নিয়ে এসো।

— আচ্ছা।

ইমন হাসতে হাসতে টিকিট কাউন্টারের দিকে গেল।

আমি জানালার বাইরে তাকিয়ে দেখছিলাম ট্রেনটা ধীরে ধীরে প্লাটফর্ম ছেড়ে ছুটে চলেছে সামনের দিকে আশেপাশের কোলাহল পেছনে ফেলে। শীতের ঠান্ডা হাওয়াটা সেদিন অন্যান্য দিনের চাইতে একটু বেশি ভালো লাগছিল। এ যেন এক ভিন্ন অনুভূতি। আশ্বিন মাসের শীতের এই সময়টা আমার বেশ ভালো লাগে।ইমন আমাকে জানালার কাছ থেকে সরিয়ে ওর বুকে টেনে নিলো। এরপর আলতো করে আমার কপালে ওর ঠোঁট ছোঁয়াল। বিয়ের পর সেদিন প্রথম ওর ভালোবাসা মাখা উষ্ণ স্পর্শ পাবার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। যদিও সেটা ট্রেনের বদ্ধ কেবিনে। ইমন আমার খোপার কাঁটাটা খুলে চোখে চোখ রেখে বলল, ‘ হ্যাপি এ্যানিভার্সারি টু আস।’ 

এরপর দুহাতে মুখটা কাছে এনে ঠোঁটজোড়া দখল করে আমায় আপন করে নিলো খুব গভীর ভাবে। ইমনের আদর মাখা স্পর্শ পেয়ে আমি যেন মেঘের ভেলায় ভেসে যাচ্ছিলাম দূরে…বহু দূরে।

লেখা – জিনিয়া জেনিস