একগুচ্ছ ভালোবাসার কবিতা

মাহফুজ আল-হোসেন

১.
একটি ভালোবাসার কবিতা

বলো, ভালোবাসা কী দ্রোহের আরেক নাম নয়?
নাই যদি হবে কেনই অযথা আদি যুগলের স্বর্গচ্যূতি, গণদয়িতার জন্য ভ্যানগঘের স্বপ্রণোদিত কর্ণচ্ছেদ,
প্রণয়ী লেডি সিম্পসনের হাত ধরে
অষ্টম এডওয়ার্ডের রাজ- সিংহাসন ত্যাগ
কিংবা অবলীলায় ত্রিশ লাখ মানুষের আত্মাহুতি ।

বৈঠকী কবি, তোমার চাঁদ -ফুল- জোৎস্নার হাই তোলা কবিতাগুলোকে মীরাক্কেলের ভাঁড়ামিপূর্ণ পরিভাষায় ‘ভালোবাসা’ বলতে যেওনা, কারণ পেরেস্ত্রোয়কা গ্লাসনস্তের অব্যবহিত পর থেকে ভোদকা স্মিরনফের ছিপি গলে না বুঝে ঢুকে পড়ে খামোখাই খাবি খাচ্ছে বোতলবন্দি পঙক্তিগুলো আর লাল গুবরেপোকা।

২.
প্রিয়তি

প্রিয়তি তুমি তো ভালো করেই জানো
আমার বয়েস লুকানো প্রেম
কতোখানি আহ্লাদিত হয়
তোমার পেলব কোমল ঠোঁটের লবণাক্ততায়
অথচ শতাব্দীর দীর্ঘতম চুম্বন আজ
শতদ্রু তীরে পুরুষ্ট প্রতিরোধের সম্মুখীন
তোমার বাজারি মাস্কের মীরীয় মস্কারায়

প্রিয়তি তোমার জঙ্ঘার জংশনে
আমার আকাঙ্ক্ষার একান্ত এক্সপ্রেস ট্রেন
মৃত্যুপরোয়াহীন এক
সুতীব্র সবুজ সিগন্যালের অপেক্ষায়

দূরত্বহীন স্পর্শানুভবের এই শেষ রাত
কেবল তুমিই পারো প্রিয়তি
ওপারের চির -ভোর করে দিতে
তোমার আগ্ৰাসী আম্ফান
আলিঙ্গনাবদ্ধতায়

৩.
প্যাকেটজাত ভালোবাসা

প্রায় এক মিলেনিয়ামের গবেষণার ফল বলতে পারো
অ্যালকেমিস্টদের আরেক গোপন ড্রি্ম প্রজেক্ট
অবশেষে বাজারে আসছে প্যাকেটজাত ভালোবাসা
দুহাজার কুড়ির ভ্যালেন্টাইন ডে- তে গ্লোবাল লঞ্চিং
কঠিন তরল বায়বীয় এবং প্লাজমা
সবধররণের স্টেটেই পাবে
পেটেন্ট নিয়ে প্যাসিফিক আর আটলান্টিকের যে মামলা
পারমানেন্ট কোর্ট অব আরবিট্রেশনে বছর পাঁচেক পেন্ডিং
অবশেষে মোটা অঙ্কে দফারফার দ্বারপ্রান্তে
সিভিল সোসাইটি আর পরিবেশবাদীদের ম্যানেজ করতে
গুনে গুনে গচ্চা দিতে হয়েছে ক্লাসিফাইড গোপনীয়তায়
ট্রাস্ট আর এন্ডাওমেন্টের এক্সট্রা এইট বিলিয়ন ডলার
শেষ পর্যন্ত ছেলে ছোকরা বুড়ো হাবড়া থুত্থুড়ে বুড়িসহ সবাই
নগদে অনুভব করবে রগরগে ভালোবাসার শিরশিরানি
ডাউ জোন্স, নিকেই, সেনসেক্স, ডিএসই সর্বত্রই মারদাঙ্গা ভাব

রাখেন মিয়া, এইমাত্র মেসেজ পেলাম আফ্রোদিতির: লাভ ইউ বেবি….

৪.
তোমায় ভালোবাসতে

তোমায় ভালোবাসতে পুরোপুরি
ভারসাম্যহীন হয়ে যেতে চাই আমি
ভারিক্কিগুলো সব‌‌ খুট করে
ছেঁটে দিতে চাই মর্মের মগডাল থেকে
ভারটা যে আসলেই ধারে কাটছে না
সেটা কাঠঠোকরাও জানে
ভারের কথায় ভারাক্রান্ত না হয়ে
এসো এবার সাম্যের কথাই বলি
আকৃতির অসমতাকে পুঁজি করে
সেই যে ঈশ্বর বনে গিয়েছিলাম তোমার
বেআক্কেলে সেসব অনেককাল ধরেই চলছে
অনায্য উদ্ভট উচ্চতাটাই কী শেষাবধি
তোমার প্রেমার্দ্র নোনতা ঠোঁটের কাছে
আমায় পৌঁছুতে দিচ্ছেনা কিছুতেই …

৫.
আমি যে কোথায় ছিলাম

তুমি নাকি আজ সকালে আমায় দেখেছো
আমার অর্ধেক বয়েসি উদ্ভিন্ন-যৌবনা অচেনা এক তরুণীর সাথে রিকশায় ঘনিষ্ঠ যাত্রায়;

অথচ সেসময় লেখার টেবিলেই তো থাকার কথা ছিলো আমার
কিংবা পাশ্চাত্য সাহিত্য দর্শন
অথবা অধুনাবাদী কবিতার নতুন মাত্রায়।

জানিনা আসলে সে মুহুর্তে কোথায় যে ছিলাম
কিংবা কখন কোথায় কিসে যে ডুবে থাকি
এটি নিজের কাছেও এক ধরনের গোলক ধাঁধাই বটে!

তথাপি দৃষ্টি তোমায় যেটাই দেখাক
তুমি ছাড়া যে কেউ কখনো ছিলোনা আমার
এ কথাটি মিথ্যে হয়ে যাবে -যদি কাল পুবের সূর্যটা পশ্চিমে ওঠে।

৬.
তরমুজ

তার অনাদরের আটপৌরে কালচে সবুজ শাড়িটা পাল্টে ফেলে
সর্প-খোলসের মতো ডোরাকাটা বাহারি বেশভূষায়
মাংসাশী নিত্যনতুন খদ্দেরকে চমকে দিতে চেয়েছে
পৌর গণিকালয়ের কর্পোরেট কর্তৃপক্ষ;

খরতপ্ত রৌদ্রের রূদ্ররোষ উপেক্ষা করে মাটির মমতায় ক্রমশ নিজেকে
বাজারোপযোগী পরিপুষ্ট করে তুললেও-
যার বিরহী বুকের গভীরে প্রোথিত থাকে
প্রগাঢ় ভালোবাসার শোণিতধারা আর জলের কোরক,
সেই তো পারে নিঃশেষিত হতে হতে
আততায়ী লোভের জিহ্বাগ্ৰে
প্রতিস্পর্ধী মিষ্টতাকে ধরে রাখতে।

৭.
খোলা চিঠি

তথাপি তোমার কৌলিণ্যের শবাধারে
নিতান্তই গৌণ আমি -জিন্দালাশ,
যেন যুগের পর যুগ ঝিম ধরে পড়ে আছি
রিপ ভ্যান উইঙ্কলের কায়দায়
সুগভীর শীতনিদ্রায়।

ঢাউস কালবাউস কিংবা মস্ত মহাশোলের
কানকোর কিসিম গোপন গোধূলিতে
ওই ঝুল বারান্দা থেকে
তোমার ভাবলেশহীন তীর্যক দৃষ্টি
আর উদাস উপেক্ষার চিত্রল চাহনি
দ্যায়নি কোনো সদর্থক সংকেত
ইশারাভাষায়।

এক টুকরো উষ্ণ শয্যার জন্য
প্যাসিফিক পাড়ি দেয়া
পরিযায়ী পাখিদের পাখনার কারুকাজে
কখনো ম্যান্ডারিনে কখনো বা হায়ারোগ্লিফিক্সে
সুচিত্রিত তোমার লেখাজোখা থেকে
আজও স্থির করতে পারিনি
সেসব আদতেই কী ছিল
কুট্টি ভৎর্সনার খিস্তিখেউড়
নাকি রুশগল্পের নায়িকার না পাঠানো
অশ্রুসিক্ত ভালোবাসার চিঠি।

আর অস্তরাগে রাঙানো কমলাকোয়ার মতো
তোমার পেলব কোমল ঠোঁটের থিরথির প্রকম্পনে
জানিনা ছিল কিনা
প্রথম চুম্বনের কাঙ্ক্ষিত আহ্বান
নাকি রমাকান্ত কামার এর
হাবিয়াহ্ হাঁপরে পোড়া লৌহশলাকার মতো
নকশাল বাড়ির খুনে রাঙা লাল পতাকা।

পুনশ্চ :
জ্বলে পুড়ে নিঃশেষ হয়ে গেলে
বিষাক্ত নিঃশ্বাসের অনতিদূরে রাখা
অনাদরের ছাইদানিতে
একটুখানি ঠাঁই দিও আমায়
অ্যাশেজ টেস্ট ঐতিহ্যের ঐতিহাসিক প্রকরণে।

কবি পরিচিতি: মাহফুজ আল-হোসেন (১৯৬৮-) -নব্বই দশকের প্রথিতযশা কবি, প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক হিসেবেও সুপরিচিত; অধুনাবাদী চিন্তার লিটল ম্যাগাজিন ‘শালুক’ এর সহযোগী সম্পাদক এবং কোলকাতা থেকে প্রকাশিত আন্তর্জাতিক লিটারারি জার্নাল ‘লিটইনফিনিট’ এর সম্পাদনা বোর্ডের সম্মানিত সদস্য। ভালোবাসা তার কবিতার প্রধানতম উপজীব্য। অনন্য কাব্যভাষায় প্রেম- ভালোবাসার বহুস্বরিক (polyphonic) উপস্থাপনার কারণে তাকে ভালোবাসার কবি বললেও অত্যুক্তি হবেনা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *