রাত ১২.৫০। ঘুমানোর অনেক চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে উঠে বসলাম। আগামীকাল বিজয় দিবস উপলক্ষে আমার বিল্ডিং এর পাশের ফাঁকা মাঠে বিশাল আকৃতির সাউন্ড বক্স লাগানো হয়েছে।
কানের পর্দা ফাটানো বলে যে ব্যাপারটা আছে, সেটাই ঘটছে। শুনছি…
‘কুতকুতি মাইয়া….’
হাই ড্রামের তালে তালে একটা নারী কন্ঠ বলছে,’ডি জে আর কে’
সাথেই পুরুষ কন্ঠ বলছে,’মাথা খারাপ,গান দে’ আবার বলছে,’কাপড় নষ্ট হইয়া গেছে…’
বিজয় দিবসের সাথে কুতকুতি মাইয়া’র সম্পর্কটা বুঝতে পারলাম না। নাদান মনে করে ক্ষমা করবেন।
সন্ধ্যায় বিজয় দিবস নিয়ে কি লেখা যায় ভাবতে ভাবতে মা’কে ফোন দিলাম-
‘মা, ৭১ এ ছোট চাচা মারা যাবার ঘটনাটা আরেকবার বলেন তো ‘
মা প্রথমে বললেন, তিনি তখন বারো তেরো। বাবার সাথে তার তখনও বিয়ে হয়নি। যুদ্ধের পর বিয়ে হলে শ্বাশুড়ির মুখে শুনেছেন,
‘এ বাড়ির বড় ছেলে শরিফের বউ পাচঁ নাম্বার বাচ্চা পেটে নিয়া শেষ সময়ের অপেক্ষা করছে। কখন হঠাৎ মাতৃত্বজনিত ব্যথা তাকে গ্রাস করবে তা নিয়ে কারও মাথা ব্যথা নেই । এটা বুঝে মনজুআরা বেগমের মনটা খারাপ হলেও তার অভিযোগ করার কিছু নেই কারন এ বাড়ির মেঝো ছেলে আর সতেরো বছরের ছোট ছেলে দু’দিন হল নিখোঁজ। গ্রামের লোকজনের মুখে শোনা যায় যে, মুক্তিবাহিনী সন্দেহে গ্রামের সব জোয়ান ছেলেদের সাথে তাদের দু’ভাইকেও পাক হানাদারবাহিনী তুলে নিয়ে গেছে।
শরিফ সাহেবের বাবা সবেত আলী তার সমস্ত ধন সম্পত্তি বিলিয়েও তার দু’সন্তানকে ফিরে পেতে মরিয়া হয়ে গেছেন। শরিফ সাহেব অবশ্য এসব নিয়ে মোটেও বিচলিত নন। তিনি ব্যস্ত রোজ রাতের অন্ধকারে মুক্তিসেনাদের একবেলা খাওয়া পাঠানো নিয়ে। তার চিন্তাভাবনাটা এরকম যে, তার অসুস্থ স্ত্রী আর হারানো দু’ভাইয়ের তুলনায় একজন মুক্তিসেনার জীবন ঢের মূল্যবান। ছেলের এমন মনোভাবে সবেত আলী আহত হলেন। দু’ছেলের শোকে ব্যথিত হয়ে তিনি বড় ছেলের সাথে কথা বলা ছেড়ে দিলেন।
শরিফ সাহেব বাবার আচরনে মোটেও বিচলিত নয়। তিনি বরং তাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে তার অসুস্থ স্ত্রী আর মা’কে দিয়ে বড় বড় হাড়িতে রান্না করিয়ে মুক্তিবাহিনীর কাছে পাঠাতে থাকল। মনজুআরা শ্বাশুড়ির সাথে উনুনপারে বসে দেবরদের নানা রকম কথা তুলে আচঁলে মুখ ঢেকে কাঁদে। শ্বাশুড়ী মাঝে মাঝে ছেড়ে দেয়া গলায় কাঁদেন,’বাবা রে…. আমার বাপ….’
সময় এমনই কাটল চারদিন। পাচঁদিনের দিন মুক্তিবাহিনী খবর পেয়ে পাকসেনা এলাকায় দিন রাত গুলিবর্ষণ করতে লাগল। গ্রামের অবশিষ্ট মানুষ সবাই আত্মগোপন করে থাকে ভয়ে । সবেত আলী তার ছোট ছোট নাতীনাতকুর স্ত্রী, ছেলের বউদের সহ পরিবারের জন্য ঘরের মাঁচার নিচে লম্বা ড্রেনের মত মাটি খুঁড়ে গুপ্তঘর তৈরী করলেন। গুপ্তঘরের মুখে চাটাই ফেলে ঢেকে রাখা হয়। ড্রেনের মতো সরু এই গুপ্ত ঘরে সবাই গাদাগাদি করে বসে থাকে দিন রাতের অধিকাংশ সময়। গোলাগুলির শব্দ শুনলেই সবাই হুড়োহুড়ি করে গুপ্তঘরে ঢুকে যায়।
ঘটনা ঘটল এরকম এক সন্ধ্যায়। এ বাড়ির মেঝো ছেলে আধমরা কোনরকম বাড়ির উঠোনে এসে দাঁড়াল সেদিন । গুপ্তঘর থেকে মনজুআরার শ্বাশুড়ী ছুটে গেলেন। মেঝো ছেলেকে ফিরে পাবার আনন্দের মুখে তিনি চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন। ছেলের মুখেই ছোট ছেলের বর্ননা সহনীয় ছিল না তার জন্য।
গ্রামের পঁচিশ ত্রিশজন ছেলের সঙ্গে তার দুই ছেলেকেও পিছনের দিকে সবার একসাথে হাত, চোখ বেঁধে৷
দেয়া হয়। তারপর ঝড়ের মত গুলি করা হয় তাদের দিকে। গুলি বুকে যারা মাটিতে লুটিয়ে পড়েছিল, তাদের সাথে মরার মতো পড়েছিল তার মেঝো ছেলে। পাক সেনা সরে গেলে অনেক কষ্টে নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে ভাইয়ের খোঁজ করে দেখল, গুলিতে ঝাঁঝড়া হওয়া ক্ষত বিক্ষত দেহগুলোর সাথে ছোট ভাইয়ার রক্তাক্ত দেহটাও পড়ে আছে।
মধ্যরাতে গুপ্তঘরে খুব চুপি চুপি জন্ম নেয় মনজুআরার পঞ্চম ছেলে। নবজাতকের আগমনে এ পরিবারের কেউ খুশি হলনা। সবাই হারানোর দহনে কাতর।
মা বললেন, তোর দাদী সারাজীবন তার ছোটছেলের জন্য কেদেঁছেন। তার বুকের সেই শূন্যতা কিছুতেই পূরণ হয়নি।’
এ শূন্যতা আসলে পূরণ হয়না। হতে পারেনা। আমরা ১৬ই ডিসেম্বরকে কিভাবে চিনি, কি জানি তা সমন্ধে?
রাতভর ‘কুতকুতি মাইয়া ‘মিউজিক শুনে লাফালাফি করা কি এর মর্ম?
১৬ই ডিসেম্বর আমাদেরকে তবে কি দিয়েছে?
–বেলা প্রধান