ফিরে আসা দুঃস্বপ্ন ( ২য় পর্ব,বীরাঙ্গনা ভাগ্য )

বীরাঙ্গনাদের এখন বয়স কত? কতজন আর বেঁচে আছেন? হিসেবটা কি কারও জানা আছে? জানা নেই বোধকরি৷
তবে সবার সাথে একটা ব্যাপার মনে হয় যায় আর সেটা হল তারা কেউ ভাল নেই৷ সেই একাত্তরের দুঃসহ যাতনা অত্যাচার নীপিড়ন পেরিয়ে আজও যারা ধুকে ধুকে জীবন্মৃত হয়ে বেঁচে আছেন তারা তাদের শরীর টাই বয়ে বেড়াচ্ছেন!
নানান রকম আশ্বাস নানান রকম সান্তনা তারা এযাবৎ সকল সিস্টেম থেকেই পেয়েছেন৷ তবু আড়ালে আবডালে ফিসফিস শুনেছেন, মা…, কেউ না চাইলে কি আর মিলিটারীরা তারে করতে পারে!
দুঃসহ যাতনায় তাদের দিন কেটে গেছে, দিন কেটে যাচ্ছে৷ যে যুদ্ধ সাতচল্লিশ বছর পূর্বে শেষ হয়েছে তার জের বীরাঙ্গনারা আজও বয়ে বেড়াচ্ছেন নির্বাক চোখে অন্তহীন কষ্টের ভেতর দিয়ে!
আচ্ছা কেউ কি বলতে পারবে উনারা কে কোথায় আছেন এখন? পরিবারের অন্য সদস্যরা তাদের কি আদর সোহাগে রেখেছেন নাকি….!
এই “না কি’র ” পরের শব্দটা বা শব্দ গুলোর কথা আমরা সবাই জানি৷ শব্দ বা শব্দগুলো লাঞ্ছনা, গঞ্জনার সমার্থকই৷
আছিয়া বেগমের বয়স সত্তুরের কাছাকাছি৷ সেই হিসেবে একাত্তরে উনার বয়স বিষ বা এর কাছাকাছি থাকার কথা৷ বিশ না লিখে বিষ লিখলাম কেননা এতে দুটো ব্যাপার বুঝানো যায়৷ সেটা হল বিশের বিষাক্ততা৷
একাত্তরের ভয়াল কোন এক রাতে আছিয়া বেগম নির্যাতিত হয়েছিলেন৷ প্রথমে পাক বাহিনীর এক ক্যাপ্টেন দ্বারা পরবর্তিতে তাদের দোসর আলবদর বাহিনীর আরও চারজন দ্বারা৷
মৃত মনে করে ওরা আছিয়া বেগম কে পাটক্ষেতে ফেলে রেখে যায়৷ জীবনের হিসেব ফুরোয়নি হয়ত তখনও৷ ধুকে ধুকে বেঁচে যান আছিয়া বেগম৷
যুদ্ধের পরের বছরে জন্ম দেন ফুটফুটে এক কন্যার৷ শিশুটির টানা টানা চোখ গৌরবর্ণ শরীর মায়াময় চাহনি কিছুই আছিয়া বেগমকে টানেনা৷ তিনি শূন্য চোখে চেয়ে থাকেন৷
সেসময় মিশনারী ডাক্তার ছিলেন রবার্ট মিলফোর্ড৷ যুদ্ধবিধ্বস্ত একটা দেশ সেই দেশের মানুষের দুর্দশা দেখে রবার্ট মিলফোর্ড থেকে গিয়েছিলেন৷ তার হাতেই আছিয়া বেগমের শিশুটি ভূমিষ্ঠ হয়৷
শারীরিক ভাবে তখন আছিয়া বেগমের অবস্থা ভীষণ খারাপ৷ অপুষ্টিতে হাতপায়ের চামড়া ঝুলে পড়েছে৷ কোটরাগত চোখ৷ মাথার চুল মুঠিতে মুঠিতে এমনিই উঠে আসছে৷ জীবন সংশয়৷
এ অবস্থায় একটা শিশুর দায়িত্ব নিতে পারার কথা না৷ আছিয়া বেগমের আত্মীয় পরিজনের কথাও কেউ জানে না৷
রবার্ট মিলফোর্ডের স্ত্রীও তখন সেই ক্যাম্পের ডাক্তার হিসেবে কর্মরত৷ তিনি মেয়েটাকে তার স্ত্রী স্তেফানা’র হাতে তুলে দিলেন৷ স্তেফানার একটা আঙুল ছোট্ট শিশুটা কোনভাবে ধরে ফেলল৷ সেটা সে আর ছাড়ে না৷ বড় বড় চোখে সে স্তেফানার দিকে তাকিয়ে ফোকলা মুখে স্বর্গীয় হাসি দেয়৷ স্তেফানার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠে৷ যুদ্ধশিশুটাকে তিনি বুকে জড়িয়ে ধরেন প্রবল মমতায়৷
রবার্ট মিলফোর্ড আর স্ত্রী সেই শিশুটাকে দত্তক নেন৷ প্রায় অপ্রকৃতস্থ মায়ের কোলে রেখে স্মৃতি হিসেবে কয়েকটা ছবি তুলেন৷ আর ছ’মাস পর নিজেদের দেশ জার্মানীতে ফিরে যান৷
দীর্ঘ পয়তাল্লিশ বছর একেকটি দিন বেঁচে থাকার সংগ্রামে আছিয়া বেগম অতীত কে ভুলে যান৷ শুধু স্মৃতিতে থেকে যায় একটা ছোট্টশিশুর কথা, কিভাবে থেকে যায় কে জানে!

সাতষট্টি বছরেও আছিয়া বেগম বেশ শক্ত সামর্থ্য৷ নিজের কামাইয়ে খান৷ যখন যা পান করেন৷ তবে ভিক্ষের জন্য হাত পাতেন না৷ রেস্টুরান্টের এঁটো বাসন ধোঁয়া সহ বুয়ার কাজ করেন৷ চুপচাপ এই মানুষটা বস্তিতে থাকেন৷ সবাই কেন জানি এই মানুষটাকে খুব পছন্দ করে৷ আছিয়া বেগম অবশ্য সরকারী ভাবে কোন সাহায্যপান না৷ বেশিরভাগ মানুষই তার বীরাঙ্গনা হবার কাহিনী জানেন না৷ সবাই মনে করে ঘরপোড়া অসহায় স্বল্পভাষী একজন মানুষ তিনি৷ নিজের অতীত নিয়ে তিনি কিছুই বলেন না৷
বুয়া হিসেবে তিনি যে বাসায় কাজ করেন সেই বাসার বেগব সাহেবা এবং সাহেব দু’জনেই চাকুরী করেন৷ বেগম সাহেবা নিজেরই একটা কাপড়ের দোকান চালান৷ কাজেই আছিয়া বেগম তিনটে চারটের দিকে ছাড়া পেয়ে যান বুয়ার কাজ থেকে৷
সেদিন শুক্রবার৷ সাহেবের পড়ার টেবিলে খবরের কাগজে একটা ছবি দেখে হঠাৎ চমকে উঠেন আছিয়া বেগম৷ তার হাত থেকে ঝাড়ু পড়ে যায়৷ মূর্তির মতো ছবির দিকে তাকিয়ে তিনি কাঁপতে থাকেন৷৷
বেগম সাহেবা তাকে ঐ অবস্থায় দেখে ফেলেন৷
তিনি বললেন আছিয়া কি হয়েছে৷
আছিয়া বেগম ঘুরে দাঁড়ালেন৷ হাতে পত্রিকাটা ধরা৷ বললেন আম্মা এইটা কিসের ছবি!
বেগম সাহেবা হেডলাইন দেখে বললেন এটা এক বিদেশীনির ছোটবেলার ছবি৷
আছিয়া বেগম বললেন আম্মা! এই রকম ছবি আমার কাছে আছে একটা! আর এই মাইয়াডা আমি!
বেগম সাহেবা হতবাক হয়ে যান৷ তিনি বললেন কি বলছ তুমি!
আছিয়া বেগম বললেন আমি এক্ষুনি আসতেছি আম্মা…
আছিয়া দৌঁড়াতে থাকেন …
বেগম সাহেবা পেপারের খবরটা পড়েন৷ তারচোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠে৷ স্বাধীনতার সাতচল্লিশ বছর পর এমন একটা খবর পড়বেন সেটা বেগম সাহেবা কল্পনাও করেন না৷

আছিয়া বেগমের আনা ছবি আর পেপারের ছবি মিলিয়ে বেগম সাহেবা এবং সাহেব দু’জনেই নিশ্চিত হন সেই বীরাঙ্গনা আর আছিয়া বেগম একই ব্যক্তি৷
আছিয়া বেগম দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে কাঁদতে থাকেন৷
বেগম সাহেবা ও সাহেব গাড়ি বের করতে বলেন ড্রাইভার কে৷ পেপারে হাসপাতালের নাম দেওয়া আছে৷ মূমূর্ষ এক বিদেশীনি সেই হাসপাতালএ মৃত্যুর প্রথর গুনছেন৷
উনারা আছিয়া বেগম কে নিয়ে রওয়ানা হন৷

মেরি মিলফোর্ড নামের জার্মেনীর একজন মহিলা বেশ ক’বার বাংলাদেশে আসেন৷ তার পালক পিতা রবার্ট মিলফোর্ড ও মা স্তেফানা তার পরিচয় কখনও লুকোননি তার কাছে৷ মেরি মিলফোর্ড তাই মাঝে মধ্যে সময় সুযোগ পেলেই বাংলাদেশে আসেন৷ আছিয়া বেগম নামের এক অসহায় মহিলাকে খুঁজতে আসেন তিনি৷ ছেচল্লিশ বছর বয়সেও তিনি দেখতে যথেষ্ট আকর্ষণীয়া৷ শেষবার তিনি একাই আসেন৷ কাউকে না জানিয়ে৷ উঠেযাওয়া সেই মিশনারী হাসপাতালের একজনের খোঁজ পেয়েছেন হঠাৎ করে৷ তার উদ্দেশ্য সেই লোককে ধরে যদি আছিয়া বেগমের খোঁজ পাওয়া যায়৷
রাতে এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলে যাবার সময়ে ভাড়া করা গাড়িটা নষ্ট হলে তিনি নেমে দাঁড়ান৷ রাত তখন পৌনে একটা৷
তিনি খেয়াল করেন না পেছনে প্রায় ফাঁকা একটা বাস আসছে৷ চারপাঁচজন দ্বিপদ জানোয়ার তারমুখ ধরে বাসে তুলে নেয়৷ টেক্সিড্রাইভারের গাড়ির বনেট তখনও খোলা৷ ওটা নামিয়ে সে বিদেশীনিকে দেখতে পায় না৷
কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে সে উত্তরা মডেল থানায় রিপোর্ট করতে যায়৷ একজন বিদেশীনি’র মিসিং রিপোর্টে পুলিশ তৎপরহয় যতটা দ্রুত সম্ভব ততটা৷ তবুও মাঝে তিনচারঘন্টা সময় অতিবাহিত হয়ে যায়৷ প্রায় উলঙ্গ ও রক্তাক্ত অবস্থায় মেরিমিলফোর্ডের অচেতন দেহ রাস্তার পাশ থেকেই উদ্ধার করে পুলিশ৷
আশ্চর্যজনক ভাবে ছেঁড়া ট্রাউজারের পকেটে পেপারে যাওয়া ছবিটা পুলিশ উদ্ধার করে৷
বেগম সাহেব আর সাহেবের সাথে যখন আছিয়া বেগম মেরি মিলফোর্ড কে দেখতে যান এর কিছুক্ষণপর খবরটা বিদ্যুৎ বেগে সব জায়গায় ভাইরাল হয়ে যায়৷
পরদিন একটা পেপারে একই সাথে দুটো ছবি আসে৷ একটা সেই ছেচল্লিশ বছর পূর্বের অন্যটা বর্তমানের হাসপাতালের আই সি ইউ’র৷ দুটো ছবির মধ্যে একটা আশ্চর্য মিল খুঁজে পায় অনেকে৷
পুরোনো ছবিতে আছিয়া বেগমের চোখে যে দূর্বোধ্য অচেনা ভাষা সেই ভাষাই বর্তমান ছবিতে তার চোখে বিদ্যমান!

টিভি’র রিপোর্টার লাইভে দর্শকদের উদ্দেশ্যে বলছেন,

মেরি মিলফোর্ড! ১৯৭১ এর যুদ্ধ শিশু৷ তার মা আছিয়া বেগমের খোঁজে এদেশে এসেছেন বেশ ক’বার৷ শেষের বার তাড়াহুড়ো করে এসেছিলেন তিনি৷ তার মায়ের খোঁজে৷ আছিয়া বেগম মানে তার হারিয়ে যাওয়া মা একাত্তরের বীরাঙ্গনা৷ সেই সময় পাকবাহিনীর যে পশুরা তার মাতৃত্ব নারীত্ব মমত্ববোধ ছিন্নভিন্ন করেছিল তাদের পাশবিকতায় স্বাধীনতার ঠিক সতচল্লিশ বছর পর একই ভাগ্য বরণ করতে হল তার হারিয়ে যাওয়া শিশু মেরি মিলফোর্ড কে!
শুধু তাই না ধর্ষণের পর এই নব্য হায়েনারা ধারালো কিছু দিয়ে মেরির জননাঙ্গ ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে রাস্তার পাশে ফেলে দেয়! স্বাধীনতার সাতচল্লিশ বছর পর আবার সেই পুরোনো ক্ষত তাজা হয়…. ধুর! আমি আর বলতে পারব না রে ভাই… রিপোর্টার মাইক নামিয়ে চোখ মুছে৷ লাইভ এ হাজার হাজার দর্শক তার চোখমোছা দেখে!

পলাশ পুরকায়স্থ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *