সুজয়ের সুদিন ( ১ম পর্ব )


মাহফুজের বেশ সাজানো গোছানো সংসার। ঘরে সুন্দরী লক্ষী প্রতিমার মতো স্ত্রী। উপচে পড়া স্বচ্ছলতা না থাকলেও সুখের কমতি নেই তাদের ভালোবাসার সংসারে। সৌভাগ্য হাঁটি হাঁটি পা পা করে তার সংসারে থিতু হয়েছে। যে কাজেই হাত দেয় সে, সেখানেই এখন সোনা ফলে। একটাই অতৃপ্তি এবং বড় বেদনার কারণ। বড় দেরি করে সুখ তার ঘরের দরজায় পা রেখেছে। তমসাচ্ছন্নতা কাটতে একটু বেশি সময় লেগেছে। প্রায় জীবনসায়াহ্নে দাঁড়িয়ে আছে সে। বয়স তার পঞ্চাশ পেরিয়েছে। জীবনের উপর দিয়ে অনেক ঝড়ঝঞ্জা বয়ে যাবার কারণে বয়সের তুলনায় একটু বেশি বয়স্ক মনে হয়। যৌবনের বেশিরভাগ সময় ব্যয় হয়েছে সুখান্বেষনে। অমানুষিক পরিশ্রম করেছে সে যৌবন কালে। তাদের একমাত্র পুত্র সন্তান সুজয় ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে পড়ে। পড়ার চেয়ে অন্যান্য কাজের প্রতি তার প্রবল আকর্ষণ। বাড়ি থেকে এক কিলোমিটার দূরে সুজয়ের স্কুল। মা বাবা আদর করে ডাকে সুজা। তার সীমাহীন দুষ্টুমি তার নামে এসেছে পরিবর্তন। অনেকে আড়ালে তাকে সুচা বলে ডাকে। সারাদিন লেগে আছে অন্যের পেছনে, শুধুই খেলাচ্ছলে। সূঁচ হয়ে ঢুকে ফাল হয়ে বের হয়ে আসে এ বয়সেই। কোন গাছে কি পাখি বাসা বেঁধেছে, সে বাসায় কয়টি ডিম কিংবা কোন পাখির বাসায় ডিম ফুঁটে বাচ্চা বের হয়েছে সব তার মুখস্থ। দুরন্তপনার বাস্তব উদাহরণ হতে পারে সে।

সুন্দর ছিমছাম একটি গ্রাম। হিজল তমাল গাছের সারি গ্রামের সৌন্দর্যকে করেছে আরো দৃষ্টিনন্দন। প্রত্যেক বাড়ির ডোবার পাড়ে হিজল গাছের শাখা ঝুলে পড়েছে পানির উপর। বর্ষায় সে সব গাছে বসা গাছ ফড়িংয়ের লোভে পুটি, কই, শিং মাছের দৃষ্টিনন্দন লাফ দেখা যায় খটখটে দুপুর কিংবা পড়ন্ত বিকেলে। এখনো আধুনিকতার ছোঁয়া লাগে নি গ্রামের ওপর। বেশির ভাগ ঘরে সন্ধ্যা হলে জ্বলে কেরোসিনের কুপি। বিদ্যুৎ পৌঁছে নি তাদের গাঁয়ে। তথাপিও গাঁয়ে রয়েছে বিশাল এক বাজার। আছে গাঁয়ের এক মাথায় প্রাইমারী স্কুল। গাঁয়ের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে সর্পিল ধারায় প্রমত্তা নদী। বর্ষাকালে দুকূল ছাপিয়ে মাঠ ঘাট তলিয়ে যায় অথৈ জলে। তখন জাল ফেললেই মাছ। সুজয়ের বাবার খুব শখ ছিল মাছ মারার। এখন মাহফুজ বাজারে দোকান খুলে বসেছে। শিক্ষা না থাকলেও ব্যবসাটা তাকে মানিয়ে যায়। দিনে দিনে উন্নতি হতে থাকে ব্যবসায়।

মাহফুজের স্ত্রীর নাম সোফিয়া। তিনজনের সংসারে তেমন কাজ নেই। দিনের বেশিরভাগ সময় কাটে সোফিয়ার একমাত্র ছেলে সুজার পেছনে। কখন কোথায় থাকে সুজা তার কোন ইয়ত্তা নেই। নেই খাবার দাবারের কোন খেয়াল। খুব ভোরে ওঠে নামাজ শেষ করে সকালের খাবার তৈরি করা, সন্তানকে খাওয়ানো, তারপর স্বামীর খাবার বাজারে পাঠানো ইত্যাদিতে কাটে সোফিয়ার সময়। সকালে ঘুম থেকে উঠেই হাওয়া হয় সুজা। অনেক খুঁজে তাকে বের করে আনতে হয়। এটা নিত্য দিনের রুটিন সোফিয়ার। মাঝে মাঝে রাগ করে ছেলেকে পিটিয়ে একা একা বসে কাঁদে।

-কেন, আল্লা আমারে ইমন পোলা দিল? অহনো কিছুই বুঝে না।
কাঁদে আর আল্লার কাছে নালিশ জানায়।

-আল্লা তুই পোলাডার মাথা ঠিক কইরা দে।

সুজা ব্যস্ত আপন জগতে। ভালোবাসে অবারিত মাঠ, গাছের ছায়ায় নিস্তব্ধ দুপুর। প্রমত্তা নদীতে ঝাপাঝাপিতে বন্ধুদের ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রতিযোগিতায় মাতে প্রখর দুপুরে। মায়ের বিরক্তি, কষ্ট তাকে স্পর্শ করতে পারে না। বর্ষা মওসুমে সকালে ঘুম থেকে উঠেই ছুটে বড়শি নিয়ে মাঠে। ধান ক্ষেতের আলে বড়শি দিলেই শিং, কই, পুঁটি, মাঝে মাঝে শোল মাছও আটকে যায়। হাঁটু পানিতে বড়শি ফেলে সুজা। মাছের খাবার হিসেবে জোগাড় করে নিয়ে আসে কেঁচো। এখনো নদীর দুকূল ছাপিয়ে বর্ষা আসে নি। বাড়ি থেকে বেশ দূরে নিচু জমিতে মাঠ বেয়ে বর্ষার জল ঢুকেছে। বর্ষার পানির সাথে বিভিন্ন প্রজাতির ছোট মাছ ভীড় করে। পেট ভর্তি ডিম সহ ছোট মাছের লোভ সামলানো তার কাছে চকচকে মার্বেল হারানোর সামিল। জমির আলে বড়শি দিয়ে বাড়ি চলে আসে। এসে মাকে তাড়া দেয় নাস্তা দেবার। নাস্তা খেয়ে ছুটে আবার বড়শি দেখতে। বেশ কয়টাতে মাছ আটকে আছে। মাছ নিয়ে মহানন্দে ছুটে বাড়ির পানে। চিৎকার চেঁচামেচি করে বাড়ি মাথায় তোলে।

মা, দেখ কত মাছ নিয়া আইছি?
সোফিয়া ছেলের উপর রাগ করে থাকতে পারে না। ছেলের হাত থেকে মাছ নিয়ে তার হাত পা ভালো করে ধুয়ে দিয়ে পাঠায় স্কুলে। সোফিয়ার সকালটা কাটে মহাব্যস্ততায়।

বর্ষাকালটা সুজার স্কুলে যেতে বেশ ভালো লাগে। স্কুলকে কিংবা পড়াশোনাকে ভালোবেসে সে স্কুলে যায় না। তার সব ভালোবাসা প্রকৃতির বিভিন্ন উপসর্গ। বাড়ি থেকে বেশিরভাগ রাস্তা যেতে হয় পানি ভেঙ্গে। পানিতে পা ফেললে পানির যে ঝুপ ঝুপ শব্দ হয় তা তার মনে অন্য রকম আনন্দ ছড়ায়। সে অন্যদের থেকে কিছুটা পেছনে হাঁটে। যাতে শব্দটা পুরোপুরি উপভোগ করতে পারে। ভাবুক মন পানির শব্দে মাতোয়ারা থাকে। স্কুলের অবস্থান তার বাড়ির পূর্বদিকে। পানি ভেঙ্গে সকালের তেজি রোদে ঘেমে নেয়ে একাকার হয়ে স্কুলে যায় সুজা। ক্লাসে তার প্রিয় বন্ধু মাত্র একজন। তার বন্ধু হাবিব নিয়মিত স্কুলে যায়। তারা দুজন শিশু শ্রেণি থেকে এক সাথে পড়াশোনা করছে। হাবিব এখন নিয়মিত পড়াশোনা করে। অপরদিকে সুজার পড়াশোনায় মন নেই। দুজনের মাঝে দূরত্ব সৃষ্টি হতে থাকে। পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত কখনো দ্বিতীয় হয় নি সুজা। তার অস্থিরতা সব সময় ছিল এবং আছে। তবু পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত হাবিব চেষ্টা করেও ক্লাসে প্রথম হতে পারে নি। প্রথম হবার অধিকারটা যেন সুজয়ের একাই ছিল। নিয়মিত প্রথম হওয়া সুজয় এখন শেষ বেঞ্চের ছাত্র।

মাহফুজ সারাদিন বাজারের দোকান সামলে বাড়ি ফিরে আসে রাতে। রাতে তিনজন একসাথে বসে খাবার খেয়ে ক্লান্তিতে ঢলে পড়ে ঘুমের রাজ্যে। ছেলের সাথে দিনে কম করে হলেও দুয়েকবার তার দেখা হয়। নিজে পড়াশোনা করে নি। তাই তার একান্ত ইচ্ছা ছেলে পড়াশোনা করুক। তার সকালের কিংবা দুপুরের খাবারটা কদাচিৎ ছেলেকে দিয়ে পাঠায় সোফিয়া, তাতে প্রচন্ড ক্ষেপে উঠে সে। মাহফুজ কখনো ছেলের পড়াশোনার ক্ষতি মেনে নিতে পারে না। তাই ছেলে যখন যা চায় সে চেষ্টা করে সাধ্যমতো পূরণ করার। তার অভাবের দিন শেষ হয়েছে। একমাত্র ছেলের মঙ্গল চিন্তায় অহোরাত্রি অস্থির থাকে সে। তিনজনের সংসারে তার ভাবনার কেউ নেই।

বর্ষার ভরা যৌবনে সুজয়ের দিন কাটে মহানন্দে। স্কুল থাকে বন্ধ। বড়শি নিয়ে পানি ভেঙ্গে মাঠে যেতে হয় না। খেতে হয় না মায়ের হাতের মার। বাড়ির চারপাশে পানি। বড়শি নিয়ে কাটে তার সারাবেলা। ঘুম থেকে উঠে শুরু হয় তার কর্মব্যস্ত দিনের কার্যক্রম মাছ ধরার প্রস্তুতিতে। এক ফাঁকে তাড়াহুড়ো করে নাকে মুখে সকালের নাস্তা গুজে দুপুর পর্যন্ত বড়শি নিয়ে মেতে থাকে সুজয়। দুপুর থেকে বিকেল এ সময়টা সুজয়ের প্রচন্ড অপছন্দ। সময় কাটানোর কোনো উপকরণ থাকে না হাতের কাছে। বড়শি হাতে বসে থাকতে প্রচন্ড বিরক্ত লাগে। মাছগুলো মনে হয় ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যায়। কিন্তু সুজয়ের চোখে ঘুমের ছিটে ফোঁটাও নেই। মাছ ধরা শেষ করে কতোক্ষণ সময় কাটে পানিতে ঝাঁপাঝাপি করে। এক সময় মায়ের লাঠির ভয়ে উঠে আসে পানি থেকে। এরপর সময়টা থমকে দাঁড়ায়। নিথর দপুরের অলসতা বিরক্ত করে তোলে সুজয়কে। একেক দিন নৌকা পেলে চলে যায় বাজারে। বাবার দুপুরের খাবার নিয়ে যায়। বাজারে যাবার মূল আকর্ষণটা হলো তাদের দোকানের পাশের মিষ্টির দোকান। একটা কিংবা দুটো রসগোল্লা টপাটপ গিলে ফেলে মিষ্টির দোকানে ঢুকে। বাবা ঠিক বিলটা দিয়ে দিবে। মিষ্টির দোকানীকে মাহফুজ বলে রেখেছে। দোকানী অবশ্য দুটোর বেশি দেয় না।

বাবার নিরবিচ্ছিন্ন আদর, মায়ের শাসন মিশ্রিত টক স্নেহ এবং ভালোবাসায় সুজা তরতর করে এগিয়ে চলছিল মনের দিক দিয়ে। তার মানসিক বৃদ্ধি অবাক করার মতো। সে পাহারা দিয়ে বেড়ায় তার জানা শোনা সকল পাখির বাসা। কোন দুষ্টু বালক কখনো কোন বাসা থেকে ডিম কিংবা পাখির ছানা নামাতে পারে না। কখনো কোন বাসা ভাঙ্গা পেলে সেদিন তার নাওয়া খাওয়া সব বন্ধ। সে সারাদিন গোয়েন্দার ন্যায় চিরুনি তল্লাশী চালিয়ে বের করে সে প্রকৃত অপরাধীকে। তারপর তার হাতের মার থেকে রক্ষা নেই সেই অপরাধীর। দিনে একাধিক বিচার আসে মায়ের কাছে তার বিরুদ্ধে। মায়ের বকুনি কিংবা মার সে খুব একটা গায়ে মাখে না। এ বয়সেই সে ভালো মন্দের পার্থক্য বিচার করার বিবেচনা অর্জন করতে পেরেছে। সীমাহীন দস্যিপনায় মেতে থাকে সুজা, তার দস্যিপনায় প্রকৃতির কোন উপকরণের ক্ষতি হবে না।

বর্ষা বিদায় নিচ্ছে। জেগে উঠতে শুরু করেছে নদীর পাড়। সুজার ব্যস্ততা বেড়ে যায় প্রচন্ডভাবে। সকাল বিকাল বড়শি নিয়ে নদীর পাড়ে তাকে বসতেই হবে। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠে চলে যায় মাছের আড়তে। সেখানে কুঁচি চিংড়ি পাওয়া যায়। কুড়িয়ে নিয়ে আসে সুজা। সেই চিংড়ি দিয়ে বড়শি ফেললেই উঠে আসে বেশ বড় সাইজের বেলে মাছ। মাঝে মাঝে সাপের মতো মোটা বাইন মাছ উঠে আসে বড়শিতে। বড়শিতে যখন একটা মাছ উঠে, তখনকার আনন্দের তুলনা কোন কিছুর সাথেই হয় না। এসব কাজে তার কোন সঙ্গী নেই। বাড়ির আশে পাশে জঙ্গলে পাখির বাসা পাহারা দেয়ার ক্ষেত্রে তার কোন সঙ্গী নেই। একা এসব কাজ করে আনন্দ পায় সুজা। একমাত্র সন্তান, তাই মা তাকে খুব একটা কিছু বলে না। তার বাবা তো ছেলে বলতে অজ্ঞান। ছেলে যাই করুক, সব কিছুতেই তার নিরব সমর্থন।

চলবে…

-বাউল সাজু

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *