ঘুমন্ত বাচ্চাকে পাশে নিয়ে শিলা শুয়ে শুয়ে ভাবছিল শফিকের কথা। এত রাত হয়ে গেল, মানুষটা ফিরছে না কেন? এমন সময় ক্ষীণ কন্ঠে ডাক শুনতে পেল শিলা। দরজা খুলে দিতেই বিধ্বস্ত, ক্লান্ত শফিক ঘরে ঢুকল। শিলা আপাদমস্তক এক দৃষ্টিতে কিছুক্ষন তাকিয়েই বুঝতে পারল কিছু একটা সমস্যা হয়েছে। সে বিচলিত কন্ঠে জানতে চাইল, ‘কি হইছে তোমার?’
শফিক নিশ্চুপ।
‘কথা কও না ক্যান?’
‘কেউ বাকী দেয় না।’ বলেই শফিক ধপ করে বসে পড়ল বিছানায়।
এরপরে আর কোনো কথা হয় না ওদের। এক ধরনের নীরবতায় ছেয়ে গেল ঘরটা। এক পর্যায়ে ডুকরে কেঁদে উঠল শিলা।
‘ভাত আছে?’ ঘামে ভেজা জামা খুলতে খুলতে শফিক শিলার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল।
‘না ভাত নাই। ঘরে কি চাউল আছে? সন্ধ্যা থিকা বইসা আছি, তুমি আসলে রান্না করব।’
কিছু না বলে চুপ করে থাকল শফিক। কিন্তু শিলার বুঝতে কষ্ট হলো না যে সারাদিন তার কিছু খাওয়া হয় নাই। সে আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইল, ‘সারাদিন কিছু খাও নাই, না?’
শফিক কিছু না বলে চলে গেল রান্না ঘরে। জগ থেকে ঢেলে একগ্লাস পানি খেয়ে এসে ক্লান্ত শরীরটাকে এলিয়ে দিল বিছানায়। তাকিয়ে তাকল শুন্য দৃষ্টিতে। আবারো নীরবতায় ছেয়ে গেল ছোট্ট ঘরটার মধ্যে। হঠাত সিয়াম জেগে উঠে কান্না শুরু করল। শিলা চেষ্টা করল বাচ্চার কান্না থামানোর। সিয়ামের কান্না কিছুতেই থামছে না। ছোট্ট সিয়ামের ক্ষুধার কান্না আরো বেগবান হলো। বুকের কিংবা বোতলের কোনো দুধই সে পর্যাপ্ত পরিমাণে পাচ্ছে না। শিলা বাচ্চাকে বুকের দুধ দেবার চেষ্টা করল। এতে সাময়িক ভাবে থেমে গেল তার কান্না।
‘বুকের দুধও শুকাই যাইতেছে। সিয়ামরে বাঁচাব ক্যামনে?’
শফিক ঘুরে তাকালো শিলার দিকে। কিছু বলতে পারল না। নির্বাক তাকিয়ে দেখে শিশু সিয়ামের দুধ পানের দৃশ্য, অনেকক্ষন তাকিয়ে থেকে নিজের অজান্তেই অনেকটা মুখ ফসকে বলে ফেলল, ‘চল সিয়ামরে আমরা বেইচা দেই।’
‘কী?’ শিলা চমকে তাকাল শফিকের দিকে।
শফিক আর কিছু না বলে চুপ করে থাকল। শিলা অবিশ্বাস্য চোখে আবার জিজ্ঞেস করল, ‘কী বললা তুমি?’
‘তাছাড়া আর উপায় কি? আমাগো সাথে থাকলে ছেলেটারে তো বাঁচান যাবে না।’
আবার নীরবতা। সিয়াম চুকচুক করে দুধ টানার চেষ্টা করছে, কিন্তু পর্যাপ্ত পরিমানে পাচ্ছে না। হঠাৎ সে চিৎকার করে কান্না শুরু করল। শিলা চেষ্টা করল বাচ্চার কান্না থামানোর। কিন্তু ক্ষুধা নিবারিত না হওয়ায় তার কান্নার বেগ বেড়ে গেল। অসহায় মা তবুও চেষ্টা করতে থাকল।
চায়ের দোকানের এক পাশে চুপ-চাপ বসে শফিক ভাবছিল তার অনিশ্চিত জীবনের কথা। পাওনাদারদের ভয়ে বেশিক্ষন বাসায় থাকতে পারে না। একরকম পালিয়েই বেড়াতে হচ্ছে তাকে। এদিকে নতুন করে আর কেউ ধার-দেনাও দিচ্ছে না। অনেক চেষ্টা করেও আর একটা কাজের জোগার করতে পারছে না। সিয়ামের জন্যে দুধ কেনার মত সামান্য কিছু টাকাও তার কাছে অবশিষ্ট নেই। অন্যমনষ্ক শফিকের ভাবনায় ছেদ পড়ল। তার কিছু বন্ধুরা দোকানে ঢুকে তার পাশে গিয়ে বসল। একজন জানতে চাইল, ‘কিরে মুখ কালা কইরা বইসা আছস ক্যান?’
শফিক কোনো উত্তর না দিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল।
‘চা-টা কিছু খাইছস?’ আরেক বন্ধু জানতে চাইল।
’ছোট একটা বাচ্চার দাম কত হইতে পারে, কইতে পারস?’
হঠাৎ করে শফিকের এমন প্রশ্ন বন্ধুদের কেউ বুঝতে পারল না। কিছুক্ষন চুপ থেকে বোঝার জন্যে একজন জিজ্ঞেস করল, ‘কিসের বাচ্চা?’
‘মানুষের।’
‘কি? মানুষের বাচ্চা কে বেচব?’
‘আমি… ভাবতেছি আমাগো সিয়ামরে বেইচা দিমু।’
‘তোর মাথার ঠিক আছে তো?’ এক বন্ধু অবাক হয়ে জানতে চাইল, ‘কি উলটা-পালটা কথা কস?’
‘উল্টা-পাল্টা না। ঠিকই কইতেছি। দেখতো কেউ কিনব কিনা?’
‘শালা কি কস? পাগল হইলি?’
‘হ পাগল হইছি। কত দাম উঠে আমারে জানাইস।’ বলতে বলতে শফিক উঠে দাড়াল।
শফিক বের হয়ে গেল চায়ের দোকান থেকে। অবাক দৃষ্টিতে দোকানের সবাই তাকিয়ে রইল তার গমন পথের দিকে। শফিক কি সত্যি সত্যিই পাগল হয়ে গেল?
শফিক তার ছেলেকে বেচতে চায়—এক কান দু’কান করে মোটামুটি মহল্লার সবার কানেই পৌঁছে গেল একথা। মহল্লার আরেক মাতবর নওয়াব আলীর ছোট ভাই রহমত আলীর কানেও গেল কথাটা। শফিকের কাছে রহমত আলীও বেশ কিছু টাকা পায়। সুযোগটা কাজে লাগানো যায় কিনা তাই ভেবে রহমত আলী শফিকের বাড়িতে এসে হাজির হলো।
‘শফিক ঘরে আছো?’
দরজা খুলে শফিক দেখল রহমত আলী দাঁড়িয়ে আছে। সাথে তার কয়েকজন চেলা। শঙ্কিত শফিক ভয়ে ভয়ে জানতে চাইল, ‘কি ব্যাপার রহমত ভাই?’
‘ব্যাপার কিছু না। অনেকদিন দেখা সাক্ষাত নাই। ভাবলাম একটু খোঁজ-খবর নিয়া যাই।’
‘ও বুচ্ছি…।’ শফিকের ধারনা দেনার টাকা চাইতেই রহমত আলী তার দরজায় এসে হাজির হয়েছে। সে বলল, ‘আপনার টাকাটা তো এখন দিতে পারব না রহমত ভাই। আমারে আরো কয়টা দিন সময় দিতে হবে।’
‘না না। পাওনা টাকা চাইতে আসি নাই। শুনলাম তুমি তোমার ছেলেটারে বেচতে চাও। ঘটনা কি সত্য?’
শফিক কোনো উত্তর দিল না।
‘আমার কাছে ভালো একটা পার্টি আছে। দশ হাজার টাকা দিব, নগদ।’ রহমত আলী কোনো ভনিতা ছাড়াই প্রস্তাব দিল সরাসরি।
‘না রহমত ভাই। ছেলে বেচব না।’
‘বেচবা না? তয় আমি যে শুনলাম…’
রহমত আলীকে কথা শেষ করতে না দিয়েই শফিক বলল, ‘এখন আর বেচতে চাই না।’
‘বেচতে চাওনা ভাল কথা। তয় আমার টাকাটা দিয়া দাও। আমি চইলা যাই।’
‘আপনের টাকা আমি দিয়া দিব। সবার টাকাই আমি দিয়া দিব।’
‘সবার টাকাই আমি দিয়া দিব। এই একখান ডায়লোক বহুদ দিছ। এইবার ডায়লোক বদলাও। তুমারে শ্যাষ চান্স দিয়া যাইতেছি। টাকার ব্যবস্থা কর। নাইলে তুমার ব্যাবস্থা আমরাই করমুনে। এই চল তোরা।’
চেলা-চামুন্ডাদের নিয়ে রহমত আলী চলে গেল। কিন্তু শফিকের চিন্তা আরো বেড়ে গেল।
রাত অনেক হয়েছে। কিন্তু শফিকের চোখে ঘুম নেই। সে শুয়ে শুয়ে ভাবতে থাকে রাজ্যের ভাবনা। পাশে শিলা শুয়ে আছে শিশু সিয়ামকে নিয়ে। তার চোখেও ঘুম নেই। শফিক অন্ধকারেই শিলার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল সে ঘুমিয়েছে কিনা। তারপর আস্তে করে বলল, ‘বউ ঘুমাইছ?’
‘না।’ শিলা ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলে উত্তর দিল।
‘এই মহল্লায় তো আর থাকা যাবে না। এখন কি করব?’
‘আমার মাথায় কিছু আসে না।’
‘চলো, পলায়ে যাই।’
‘কোথায় যাব?’
‘জানিনা।’
এরপর দুজনের কেউ আর কোনো কথা বলল না। চার জোড়া চোখ অন্ধকারে তাকিয়ে থাকে ছাদের দিকে। কারো চোখে ঘুম নেই। মুখে কোনো কথাও নেই। সুনসান নীরবতা।
পরেরদিন শফিক কাজের সন্ধানে বের হলো। যেভাবেই হোক একটা কাজ তাকে খুঁজে বের করতেই হবে। দিন-মুজুর, কুলি যে কাজই হোক—তার চাই। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত হলো। শফিক ফিরে আসছে না দেখে শিলা চিন্তায় পরে গেল। আরেকটা সমুহ বিপদের আশঙ্কায় তার বুক কেঁপে উঠল। তাহলে কি সে? নাহ, শিলা সেরকম কিছু ভাবতে চায় না।
পরের দিন সকালেও শফিক ফিরে এল না। সারাদিন চলে গেল। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত। শফিকের কোনো খবর নেই। শিলার আর বুঝতে বাকী রইল না। সে-কি আর ফিরে আসবে না তাহলে? এরপর তিনদিন কেটে গেল—মানুষটা আর সত্যি সত্যি ফিরে এলো না।
অর্থ কষ্ট আর দেনার ভার সহ্য করতে না পেরে স্ত্রী আর সন্তানকে ফেলে রেখা গা ঢাকা দিল শফিক।
এর মাঝে একদিন রহমত আলী এসে হাজির হলো আবার। শফিকের অন্তর্ধানের খবরটা তার কাছে আর অজানা নেই। সে এসে শফিকের নাম ধরে ডাক দিল।
শিলা দরজা খুলে বাইরে আসতেই রহমত আলী জানতে চাইল, ‘শফিক বাড়িত নাই?’
‘না।’
‘গেছে কই?’
‘জানি না।’
‘জানো না? ও আচ্ছা…’ কিছুক্ষন ভেবে নিয়ে রহমত আবার বলল, ‘ও যে পলাইছে সেইটা কি তুমি জানো?’
‘ক্যান পলাবে ক্যান? সে-কি কারোডা চুরি করছে যে পলাবে।’
‘সেইডা তুমি খুব ভালো কইরাই জানো।’
শিলা আর কোনো কথা বলতে পারল না। তার বলার আছেই বা কী?
রহমত আবার বলল, ‘আমি অহন যাইতেছি। তয় আমি আবার আসমু। তহন কিন্তু আমি খালি হাতে যামু না। কথাটা মনে রাইখ শিলা বেগম।’
শিলা চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।
‘ভাদাইম্যাডারে পাইয়া নেই—এমুন শিক্ষা দিমু!’ আরো অনেক কিছু বলতে বলতে রহমত আলী চলে গেল।
ফজরের আজানের আগেই শিলা ঘুম থেকে উঠে পড়ল। রাতেই সে ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছিল। সিয়ামকে কোলে তুলে নিয়ে একটা ছোট্ট ব্যাগ সাথে করে শিলা বের হয়ে গেল ঘর থেকে। অন্ধকার তখনো মিলিয়ে যায়নি। ঘরে তালা ঝুলিয়ে চারিদিকে একবার তাকাল শিলা। তারপর সন্তর্পনে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেল। কিন্তু বেশীদূর যেতে পারল না। তার আগেই একটা হাই-বীম টর্চ লাইটের আলো তার মুখের উপর এসে পড়ল। ভয়ে আর্তনাদ করে মুখ সরিয়ে নিয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কে?’
আচমকা একদল মানুষ অন্ধকার ফুঁড়ে বেরিয়ে এলো। ধীরে ধীরে সবাই জড় হয়ে শিলাকে ঘিরে ফেলল এবং হঠাত তাদের পেছন থকে সামনে এসে দাড়াল রহমত আলী। দিশেহারা শিলা কি করবে বুঝে উঠত পারল না। সে ভয়ে কেঁদে ফেলল।
রহমত আলী বিজয়ের হাসি মুখে নিয়ে বলল, ‘আমার অনুমান কখনো মিথ্যা হয় না। তুমিও যে পলাইবা সেইটা আমি জানতাম। তাই এট্টু পাহারার ব্যাবস্থা করছিলাম। হে হে হে।’
শিলা চারিদিকে একবার তাকিয়ে দেখলো অনেক গুলো চোখ তারদিকে নেকড়ের দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।
‘পাওনা টেকা না দিয়া তুমি কই যাও শিলা বেগম? টেকা না দিয়া তো তুমি কুথাও যাইতে পারবা না। অহন আমাগো সাথে তুমার যাওন লাগব।’ বলেই রহমত খপ করে শিলার হাত ধরে ফেলল।
শিলা বুঝতে পারল এই হাতের থাবা থেকে তার নিস্তার নেই। এই হিংস্র আর ভয়াল থাবার ভয়াবহতা অনুধাবন করে শিউরে উঠল। সে কোনো রকম প্রতিবাদ করতে পারল না। নীরবে কাঁদতে থাকল। এক পর্যায়ে অনেকটা জোড় করেই শিলাকে নিয়ে গেল রহমত আলী আর তার গ্যাং।
ফরহাদ হোসেন
লেখক-নির্মাতা
ডালাস,টেক্সাস