“ডায়েরী —৭১” ( একটি অন্যরকম যুদ্ধ গল্প)

আমি জান্নাতুল ফেরদৌস (লিয়া)। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লিখতে আমাকে কখনো গল্প খুঁজতে হয়না। যুদ্ধই আমাকে গল্প দিয়েছে অনেক। যে গল্প আমি বয়ে বেড়াই, বয়ে বেড়াবো আমৃত্যু। ১৯৭১। তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মান প্রথম বর্ষের ছাত্রী। দারুন ভাবে প্রেমে পড়েছি তুখোড় আবৃত্তিকার ” আসাদ ইফতেখারের। আমার থেকে দুবছরের সিনিয়র এই মানুষ টার গাম্ভীর্য , পরিশালীত ব্যক্তিত্ব দারুণভাবে আকৃষ্ট করেছিল আমায়। ভয়ঙ্কর অবস্থা আমার। শুধু ও’কে দেখতে পাব একারনে সদস্য হয়ে গেলাম ওদের সংগঠনের। তাতে ফলাফল আরো ভয়াবহ হল। আসক্তি বাড়তে লাগল প্রচণ্ডভাবে। আমি বরাবরই সাহসী। খুব সাহস করে একদিন রিহার্সাল শেষে সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। বললাম — “কথা বলতে চাই।”
স্মিত হেসে সে বলল– ‘হ্যা বল।”

সারারাত ধরে প্রস্তুতি নিয়ে তৈরী করা কথার একটা ও বলতে পারলাম না আমি। তাকিয়ে রইলাম তার দিকে। পুরো শরীর জুড়ে আমার এক অদ্ভুত আলোড়ন হতে লাগল। আসাদ চোখ নামিয়ে নিল একসময়। প্রচণ্ড ঘোর নিয়ে আমি বাড়ী ফিরলাম। কিযে কষ্ট হচ্ছিল ! মনে আছে, খুব কেঁদেছিলাম সেদিন। কিছুই বলা হল না তাকে। দুদিন ভার্সিটি গেলাম না। তৃতীয় দিন ক্লাস শেষে হেনা এল খোঁজ নিতে। বললাম — শরীর ভাল না, তাই যাইনি। সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে হঠ্যাৎ পেছন ফিরল হেনা– ” আচ্ছা আসাদ ভাই খুঁজছিলেন তোকে, বলেছেন দেখা করতে।” আমার সমস্ত শরীরে বিদ্যুৎপ্রবাহ হল। মনেহল এক্ষুনি ছুটে যাই, এক্ষুনি।

আমাদের দেখা হল পরদিন সকাল ১০ টায়। অবনত চোখে আমি দাঁড়ালাম তার সামনে। যতবারই চোখ তুলে তাকাচ্ছিলাম, আমার দিকে তার নিবদ্ধ স্থিরদৃস্টি দারুণ ভাবে শিহরিত করছিল আমায়। কতক্ষণ কেটেছিল জানিনা। তবে বারবার মনে হচ্ছিল সময়টা শেষ না হোক, থেমে যাক এখানেই। কোন কথা হল না আমাদের। হাতে স্পর্শ পেতেই চোখ বন্ধ করলাম আমি। এজীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ ক্ষণ ছিল সেটি। দীর্ঘসময় আমার কোমল হাত টি আবদ্ধ ছিল বলিষ্ঠ হাতের মুঠোয়। হাত নয়, সেদিন আমি নিজেকে মনেমনে পুরোপুরি সমর্পণ করেছিলাম তাকে।

মার্চের মাঝামাঝি, দেশের অবস্থা খুব খারাপ তখন। আমি আর আসাদ মাঝেমাঝে দেখা করতাম রমনা লেকের পাড়ে। ও’ বলত এভাবে হুটহাট করে বের হয়োনা বাড়ী থেকে, নিরাপদ নয়। আমি জানি নিরাপদ নয়, তবুও প্রবল টান আমাকে বাধ্য করত। আমি অস্থির হয়ে যেতাম শুধু একবার ও’কে দেখবার জন্য।

এপ্রিলের শেষের দিকে। পুরো দেশজুড়ে যুদ্ধ চলছে। আসাদ আমার দেখা নেই বেশ কয়েকদিন। একদিন খুব সকালে হেনা এলো বাসায়। বলল গতরাতে আসাদ কে ধরে নিয়ে গেছে পাকিস্তানী মিলিটারি। আমি কথাই বলতে পারলাম না কোন। শরীরজুড়ে অসাড়তা নেমে এলো। বারবার চোখে ভাসতে লাগল– পাঞ্জাবী পড়া কালো ফ্রেমের চশমায় ঢাকা আসাদের স্নিগ্ধ মুখটা। আমি ধপ করে বসে পড়লাম, শক্ত করে আঁকড়ে ধরলাম হেনার হাত টা। কিযে তোলপাড় আমার বুকের মধ্যে! পুরো জীবনটা কেউ যেন উলটে দিয়েছে। আকুল হয়ে কাঁদলাম সারাদিন। তারপর হঠাৎ মনে হল – কিছু একটা করা দরকার, এক্ষনি।

আমি বিকেলবেলা বের হলাম। সেঁজুতি নামে আমার এক বান্ধবী আছে, যার বাবা সেনাবাহিনীর বড় অফিসার। চলে গেলাম ওদের বাসায়। সেঁজুতির বাবাকে খুলে বললাম- আসাদ কোন রাজনীতির সাথে জড়িত নয়, সাধারণ নিরীহ ছাত্র। যেকোনো ভাবে তাকে বাঁচাতে আমি সেঁজুতির বাবার কাছে হাতজোড় করে অনুরোধ করেছিলাম। চাচা দারুণ চিন্তিত হলেন। ফোন করে এদিক ওদিক খবর নিলেন সারাবিকেল। রাত আটটার দিকে তিনি জানতে পারলেন– গতকাল রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে কজন ছাত্রকে ওরা ধরেছে, তারা কলাবাগান ক্যাম্পে আছে। আসাদ ওখানেই আছে হয়ত, তবে নিশ্চিত নয়। তিনি কলাবাগান ক্যাম্পে খবর নিলেন, কিন্তু জানা গেল না আসাদ ওখানেই আছে কিনা!

আহা! কি দুঃসহ যন্ত্রণা আমার! আমি যেন স্পষ্ট দেখতে পেলাম — একটা অন্ধকার ঘরে অকথ্য অত্যাচার করছে ওরা আসাদের উপর। আমি আর পারলাম না। সেঁজুতির বাবার হাটুর উপরে মাথা রেখে কাঁদতে লাগলাম। বললাম– “চাচা ও’কে বাচান। ওরা মেরে ফেলবে ও’কে। তিনি মাথায় হাত রাখলেন আমার, বললেন– “চিন্তা করোনা মা, আমি আপ্রাণ চেষ্টা করছি।” রাতে গাড়ী করে বাসায় পৌছে দিলেন আমায়। খুব সকালে তিনি খবর পাঠালেন, আসাদ কলাবাগানেই আছে। আমি দ্রুত তৈরী হয়ে চলে গেলাম সেঁজুতিদের বাসায়। সাদা কাগজে লেখা একটা ঠিকানা হাতে দিয়ে চাচা বললেন— “আসাদ যে ক্যাম্পে আছে সেখানের প্রধান অফিসার ‘শাহবাজ বখতিয়ার।’ এটা তার বাসার ঠিকানা। তুমি চলে যাও তার কাছে। বয়স্ক মানুষ। তাকে খুলে বল সব। তুমি তার মেয়ের মত, উনি নিশ্চই বুঝবেন বিষয় টা। তাড়াতাড়ি যাও। এরা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললে সমস্যা হবে।” ঠিকানা টা নিয়ে আমি ছুটলাম।

সেগুনবাগিচা — ০৬। দোতলা বাড়ীটার সামনে কড়া নিরাপত্তা। আমি গেটে দাঁড়ানো আর্মিগুলোকে সেঁজুতির বাবার লিখে দেয়া চিঠিটা দেখালাম। এদের একজন চিঠিটা নিয়ে ওপরে গেল, ফিরে এল দ্রুত। তারপর আমি গেলাম দোতলায়। প্রশস্ত একটা কক্ষে বসে আছেন শাহবাজ বখতিয়ার। আমাকে ইশারা করে বসতে বললেন। বয়স ষাটের কোঠায়, কাঁচাপাকা চুল, চোখে পুরু লেন্সের চশমা। যথেষ্ট ভদ্র ও মার্জিত মনে হল তাকে। বাবার বয়সী এই লোক টাকে আমার একবারের জন্যও শত্রুপক্ষের কেউ বলে মনে হলনা। যতটা সম্ভব গুছিয়ে আমি আমার কথা বললাম তাকে। দীর্ঘসময় চুপ করে রইলেন তিনি। তারপর উঠে দাঁড়ালেন। বললেন—- “ইসতারহা কিসিকো ছোড়না ডিফিকাল্ট! মুমকিন নেহি।” আমি হাতজোড় করলাম– “ও’ খুব নিরীহ একটা ছেলে, আপনি ওকে ছেড়ে দিন প্লিজ!

সে ভাঙা ভাঙা বাংলায় বলল– “সে কে হয় তোমার?”

আমি মাথা নীচু করে রইলাম। তিনি আর কোন প্রশ্ন করলেন না। আমার অবনত চোখের জলে সে প্রশ্নের জবাব ছিল হয়ত। তিনি কাছে এসে আমার কাঁধে হাত রাখলেন, বললেন– “সামঝা ম্যায়, আব যাও তুম। উসকো কুচ নেহি হোগা।” আমি কৃতজ্ঞতায়, খুশীতে তার হাত ধরে কেঁদে ফেললাম।

তার পরদিন সন্ধ্যায় আসাদকে ছেড়ে দিল ওরা। আমি দাঁড়িয়েছিলাম ক্যাম্পের বাইরে। বিস্মিত চোখে আসাদ বেড়িয়ে এসেছিল। সে তখনও বোধহয় বিশ্বাস করতে পারছিল না, তাকে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। আমাকে দেখে দৌড়ে কাছে এলো। জড়িয়ে ধরে রাখল অনেক্ষণ। বাসায় ফেরার পথটুকু আমরা রিক্সায় ফিরেছিলাম। বাড়ীর কাছাকাছি যখন চলে এলাম, আসাদের হাত ধরলাম আমি। বললাম —- “একটা অনুরোধ করব, রাখবে?” সে তার স্বভাব অনুযায়ী হাসল, জবাব দিলনা। আমি খুব কাছে এগিয়ে ফিসফিস করে বললাম– “একটা চুমু দেবে আমায়!”

পরদিন অনেক যত্ন করে তৈরী হলাম আমি। জরিপাড়ের সবুজ শাড়ী, কপালে লাল টিপ, চোখে কাজলও লাগালাম। রমনার পূর্বদিকের লেকের ধারে আসাদ অপেক্ষা করবে আমার জন্য। আমি বেরিয়ে সোজা রিক্সা নিয়ে চলে এলাম সেগুনবাগিচা। আজ আর কেউ বাধা দিল না আমায়। দোতলার ডান দিকের ঘরটায় বসলাম আমি। বখতিয়ার সাহেবের শোবার ঘর। কাছে এলেন তিনি। অনাবৃত পিঠে ঠোঁট ছোঁয়ালেন। বললেন— “ইতনা গ্যাহেরা প্যায়ার ম্যায়নে কাভি নেহি দেখা। বো তুমহারা শ্রেফ আশিক হ্যায়, উসকে লিয়ে খুদকো বারবাদ কারনে কো তইয়ার হো ? তুম ল্যাড়কিয়া ইতনা বেওকুফ কিউ হো?”

আমি হাসলাম; বললাম — “একটা অনুরোধ রাখবেন আমার?”

“হাঁ হাঁ জরুর! বোলো।

“আমার ঠোঁটে চুমু দেবেন না প্লিজ! এটা না দিলে এমন তো ক্ষতি নেই। অনুরোধ টা রাখুন আমার!”

একটু একটু করে বিবস্ত্র হতে লাগলাম আমি। আশ্চর্য! নিজেকে ঢাকবার কোন চেষ্টাই করলাম না। নিজের নগ্ন শরীর টা দেখে বিন্দুমাত্র লজ্জিত হলাম না আমি। কেমন অনুভূতিহীন ছিল শরীরটা, মনটাও। ঠিক মৃতলাশের মত। বখতিয়ার অনুরোধ রেখেছিল। শরীরটাকে হায়নার মত খুবলে খেলেও ঠোঁট স্পর্শ করেনি একবারও।

আমি আসাদের মুখোমুখি হইনি। হয়ত সেদিন লেকের ধারে অপেক্ষা করতে করতে কত কি ভেবেছিল সে! তার কিছুদিন পর চলে গেলাম নরসিংদী দাদার বাড়ী। সত্যি কথা বলতে পালালাম আসাদের কাছথেকে। মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলো, তারও বেশ অনেকদিন বাদে আসাদ এসেছিল একদিন বাড়ীতে। আমি ফিরিয়ে দিয়েছিলাম তাকে। এ প্রত্যাখ্যান অপ্রত্যাশিত ছিল। একটা কথাও বলল না সে। প্রচণ্ড বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে ছিল শুধু। সে দৃষ্টিতে অনেক প্রশ্ন ছিল, আর ছিল ঘৃনা। আহ! কি দুঃসহ যন্ত্রণা হয়েছিল সেদিন! আজও হয়। আমি মনে রাখতে চাইনা দিন টা, একদম না। মনে যখন তীব্র কষ্ট হয়, আমি দৌড়ে গিয়ে দাঁড়াই খোলা আকাশের নীচে। বুকভরে নিঃশ্বাস নেই, তারপর চোখ বন্ধ করি। আমার সামনে ভেসে ওঠে জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ ক্ষণটি— আমি আসাদ মুখোমুখি, তার প্রথম স্পর্শের শিহরণ জাগানো অনুভূতি , ছড়িয়ে যায় আমার মনে, মনথেকে শরীরে। আমি শান্ত হই ধীরেধীরে, একেবারে শান্ত!

আমি জান্নাতুল ফেরদৌস (লিয়া)। গল্প খুঁজতে হয়না আমাকে। যুদ্ধই গল্প দিয়ে গেছে আমাকে………………।

-নাঈমা পারভীন অনামিকা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *