প্রখর রোদের তাপদাহে পুড়ে বাসায় ফিরে শারমিন দেখে গেইটে লক করা! জুবায়ের তো বাসায়ই ছিল, এখন আবার গেল কোথায়? রাগে গজগজ করতে করতে শারমিন সেকেন্ডারি চাবি দিয়ে তালা খুলে ভিতরে প্রবেশ করে জুবায়েরকে ফোন করে। জুবায়ের সেলুনে চুল কাটতে গেছে।
শারমিন ভাবছে জুবায়েরকে কি এখনি চুল কাটতে যেতে হল! সে কি ভাবছে? ললিতাকে সে সাহায্য করবেনা!শারমিন মনে মনে আওড়াচ্ছে,”আজ জুবায়ের আসুক বাসায়, ওর মুখোমুখি আমাকে হতেই হবে। কিসের এত দম্ভ তার। মানুষকে মানুষই ভাবে না! ”
এরই মধ্যে ললিতার ফোন,
— অাফা,কিছু করছেন?
— ললিতা, তোমার ভাই বাইরে গেছে, আসুক। ভয় পেয়ো না।
— আফা কয়জনের মুখে শুনতাছি তারারে চালান কইরা দিব কোর্টে। আমি অহন কি করবাম আফা?
— আমি এক্ষুনি আসছি, হারিছের কিছু হবেনা। তুমি নির্ভয়ে থাকো।
ফোনটা কেটে ললিতার চোখ থেকে টপটপিয়ে পানি পড়তে লাগলো। হারিছের সঙ্গে ধরা পড়া ছেলেগুলোর বাড়ির লোক এসেছে, তারা বেশ ভদ্রগোছের। পোশাকে আশাকে দেখতে বিত্তশালী মনে হয় ললিতার কাছে। ললিতা ভাবে এরা হয়তো তাঁদের ছেলেদের টাকা পয়সা দিয়ে ছাড়িয়ে নিয়ে যেতে পারবে, কিন্তু হারিছ রে সে কেমনে বাঁচাবে? শারমিন আপাই তার একমাত্র ভরসা এখন।
ললিতার ফোন পেয়ে শারমিন আবার হন্তদন্ত হয়ে বের হতে উদ্যত হয়,তখনি চোখে পড়ে বেসিনের কাছে জুবায়েরের এনড্রয়েড ফোনটা পড়ে আছে,তার মানে জুবায়ের শুধু নরমাল ফোনটা নিয়ে বেরিয়েছে? শারমিন ফোনটা হাতে নিয়ে একটা আনন্দের হাসি হাসলো, আল্লাহর কাছে শোকরিয়া আদায় করলো। মনে মনে দোয়া পড়তে থাকলো যেন এ ফোনে অতনুর নাম্বারটা সে পেয়ে যায়।
ফোন ঘাঁটছে শারমিন অতনুর নাম্বার জন্য কিন্তু পাচ্ছেনা,অনেক রকমভাবে চেষ্টা করছে নাম্বারটা বের করতে,কিন্তু ম্যাচ করছেনা। অবশেষে ইংরেজিতে দোস্ত লিখে সার্চ দিয়ে দেখে দোস্ত এসআই লিখা একটা কন্টাক্ট নাম্বার আছে। অজানা এক আনন্দ খেলে যায় তার মনে, শারমিন ভয়ে ভয়ে কল দেয়, ওপর প্রান্তে অতনু ফোন ধরে,
— কি রে দোস্ত,আমার কথা মনে হল যে!
— আসসালামুআলাইকুম। আমি ভাবী বলছিলাম।
— অলাইকুমআসসালাম। ভাবী কি খবর? এটা কি অনিচ্ছাকৃত কল?
— না ভাই এটা অনিচ্ছাকৃত কল নয়,ইচ্ছাকৃতই।একটা দরকার ছিল আপনার সাথে।
অতনু অবাক হয়!
— কি দরকার ভাবী বলুন! আমার সাথে আপনার কি দরকার থাকতে পারে?
— আমি এতক্ষণ থানায় ছিলাম, কিন্তু আপনার ডিউটি নাকি দুইটার পর। আপনার বন্ধুও আমাকে নাম্বারটা দিয়ে হেল্প করছিল না।
— এখন কোথায় আপনি? আর আমাকেই দরকার কেন? জুবায়েরের বিরুদ্ধে কোন মামলা টামলা করবেন নাকি?
— আমি এখন বাসায়। না অাপনার বন্ধুর ব্যাপারে আমারে আমার কোন অভিযোগ নেই,আসলে আমার আপনার সাহায্য চাই।
— হ্যাঁ বলুন কি হেল্প করবো!
— গতরাতে আপনি মাদক ব্যবসায়ী অভিযোগে তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছেন, তার মধ্যে একজন হচ্ছে রিক্সাচালক হারিছ মিয়া।
— হ্যাঁ হ্যাঁ ভাবী গ্রেপ্তার করেছি। ওরা আপনার কেউ হয়?
— দাদা, সবসময় আপন মানুষও আপন হয় না, আবার কোন সময় পর মানুষও অনেক কাছের হয়।
—ঠিক বলছেন ভাবী। তো আপনি কি হারিছের সম্পর্কে কিছু বলতে চাচ্ছেন?
—আসলে আমি আগে জানতে চাই, রিক্সাওয়ালা হারিছের কাছে কি আপনি কোন মাদকদ্রব্য পেয়েছেন?
—হ্যাঁ ভাবী পেয়েছি। গাঁজা ছিল ৫০০ গ্রামের মত।
— এটা রিক্সাওয়ালা হারিছের কাছেই ছিল?
— হ্যাঁ। কিন্তু এটা হারিছের নয়।অন্য দুজনে নিরাপদে পার হওয়ার জন্য হারিছের কাছে রাখে, একথা হারিছ আর অন্য দুইটা স্বীকার করছে।
—ভাই আমার বিশ্বাস ছিল হারিছ এ কাজ করতে পারেনা। সে খুবই গরীব আর সৎ মানুষ। দাদা আমার একটা অনুরোধ রাখবেন?
— হ্যাঁ বলুন!
— হারিছকে ছেড়ে দেয়া যায়না? তার স্ত্রী বড্ড অসহায়,আমার বাসায় কাজ করে কিন্তু সে আমার ছোটবোনের মত। আমি কথা দিয়েছি তাকে সাহায্য করবো। প্লিজ দাদা আমাকে সাহায্য করুন।
—ভাবী আমি দেখছি কি করা যায়।
— আমি আসবো থানায়? আপনার দেরি হবে ডিউটিতে যেতে?
— না ভাবী আসতে হবেনা। আমি থানার দিকেই যাচ্ছি।
—রাখি তাহলে।
অসহায় ললিতা থানার ভিতরে গাছের নিচে বেঞ্চগুলোতে বসে আছে। অতনু থানায় প্রবেশ করার সময় ললিতাকে একনজর দেখে। থানায় ঢুকেই লকাপের দিকে যায়। এক নজর হারিছের দিকে চোখ বুলিয়ে সে আবার তার নিজের চেয়ারে ফিরে এসে বসে। শারমিন বাসায় বসে থাকেনি, সে ললিতাকে একা ফেলে বাসায় বসে থাকবে! আবার ছুটে আসে থানাতে।
অতনু হাতের কিছু কাজ করছিল, তখনই শারমিন ললিতাকে নিয়ে হন্তদন্ত হয়ে অতনুর অফিসরুমে ঢুকে সালাম দেয়। অতনু জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালে শারমিন তার পরিচয় দেয়। অতনু হেসে শারমিনকে বসতে বলে, শারমিন চেয়ারটা টেনে বসে সাথে ললিতাকেও বসতে বলে। ললিতা বসেনা, সে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে। অতনু শারমিনকে কিছু খাওয়ার কথা বললে শারমিন আপত্তি জানিয়ে হারিছের প্রসঙ্গ টানে। ললিতাকে দেখিয়ে বলে, “এ হারিছের স্ত্রী ললিতা। ”
—হুম উনাকে বাহিরে বসে থাকতে দেখেছি।
ললিতা আকুলতা প্রকাশ করে বলে,”স্যার খাইতে পাইনা বলে মানুষের বাসায় কাজ করি,কিন্তু হে কোনদিন কোন অসৎপথে টাকা কামাই করে নাই! আজ কেমনে কি বিপদ হইলো।”কথাগুলো বলতে বলতে ললিতার দুচোখ গড়িয়ে পানি পড়তে থাকে আর সে সন্তর্পনে অাঁচল দিয়ে দুচোখ মুছে। অতনু ললিতার কথাটা মনযোগ দিয়ে শোনে ললিতাকে বলে,”আপনি চেয়ারটায় বসুন।আমি ভেতর থেকে আসছি। ”
অতনু আবার লকাপের ভেতরে যায়, হারিছকে আলাদা করে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করে অতনু সাথে করে নিয়ে আসে। কিছু সই স্বাক্ষর রেখে হারিছকে ছেড়ে দেয় পুলিশ।
রাতে পুলিশ হারিছকে অনেক মেরেছে, তাই হারিছ ভাল করে হাঁটতেও পারছিল না। থানা থেকে ললিতা হারিছকে পরম মমতায় ধরে ধরে নিয়ে বের হয়।হারিছের এ অবস্থা দেখে ললিতার চোখ থেকে টপটপ করে অশ্রু গড়ায়।শারমিন দেখছে স্বামী স্ত্রীর প্রতি ভালবাসা আর মমত্ববোধ। সে অনুভব করছে জুবায়েরকে।আর জুবায়েরের পরিবর্তনকে।
বিয়ের বছর শারমিনের গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা থেকে আকস্মিক পেট ব্যাথা হয়েছিল,জুবায়ের সেদিন কতটা উদ্বিগ্ন যে হয়েছিল! দৌড়ে গিয়ে মোড় থেকে রিক্সা এনে নিজেই কোলে করে শারমিনকে রিক্সায় তোলে। সবাই বলেছিল এটা গ্যাস্ট্রিকের ব্যথা,গ্যাসের ট্যাবলেট খেলেও কমে যাবে, বাড়ির কাউকে তোয়াক্কা না করেই জুবায়ের সেদিন তাকে হাসপাতালে নিয়ে ভর্তি করে। ডাক্তারের প্রেসক্রাইব করা একটা ইনজেকশনে কিছুক্ষন পরেই ব্যথা কমে যায় কিন্তু জুবায়ের সে রাতে তাকে হসপিটালে এডমিট করে, এবং সারা রাত শারমিনের পাশে বসে থাকে।
প্রায়ই শারমিনের অল্প অসুস্থতা কিংবা মন খারাপে জুবায়ের অনেক বেশি আকুল হত কিন্তু প্রমোশন পাওয়ার পর থেকে টাকার পিছনে ছুটতে শুরু করে সে তাই সংসার,বউ এসবের দিকে তার আর নজর পড়েনা। এইতো কিছুদিন আগেই শারমিনের মায়ের মৃত্যুবার্ষিকী ছিল,শারমিন সেদিন অফিস থেকে ছুটি নিয়ে একটা এতিমখানাতে যায়, সেখানে এতিম ছেলেদের কিছু খাবারের ব্যবস্থা করে। সবকিছু শেষ করে বাসায় ফিরতে ফিরতে শারমিনের রাত হয়ে যায়,জুবায়ের বাসায় ফিরে শারমিনকে বাসায় না পেয়ে ফোন করে, শারমিন আসতে একটু রাত হবে বলাতে জুবায়ের তার সাথে যাচ্ছেতাই আচরণ করে। সেদিন শারমিনের মায়ের মৃত্যুবার্ষিকী ছিল বিধায় তার মনটা এমনিতেই বিষন্ন ছিল কিন্তু জুবায়েরের কোন ভ্রুক্ষেপ নেই তাতে।
বাসায় ফিরে শারমিন জুবায়েরের সাথে একটা কথাও বলেনি, জুবায়েরও শারমিনের সাথে কথা না বলে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। অনেক কেঁদেছিল সেদিন শারমিন জুবায়েরের পাশে শুয়েই অথচ জুবায়ের! সে টেরই পেল না।
থাক ওসব কথা, ললিতাকে ঠিকঠাক তার বাড়ি পাঠানোর ব্যবস্থা করতে ছুটে শারমিন। এরই মধ্যে তারা থানার মাঠ পেরিয়ে বড় রাস্তায় উঠে। ললিতাকে দেখে রিক্সা নিয়ে এগিয়ে আসে মিলন। উৎসুক হয়ে জানতে চায় হারিছেন এহেন অবস্থা কি করে হল? শারমিন ললিতাকে বললো রিক্সায় উঠতে,মিলনও নেমে এসে হারিছকে রিক্সায় তুলে নিল। শারমিন মিলনকে বললো স্থানীয় হাসপাতালে যেতে,আর পরিচিত কেউ থাকলে হারিছের রিক্সাটা থানা থেকে নেয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। মিলন কাছেই থাকা রিক্সা ড্রাইভার লিজনকে ডেকে আনে, হারিছের রিক্সাটা থানা থেকে নিয়ে আসার জন্য। লিজন শারমিনের সাথে আবার থানার ভেতরে যায় আর অতনুর সাথে কথা বলে শারমিন হারিছের রিক্সাটাও ছাড়িয়ে আনে। লিজন সে রিক্সা করে শারমিনকে নিয়ে হাসপাতালে ছুটে চলে।
ললিতা হারিকেনের অালো জ্বেলে হারিছের মাথার কাছে বসে হাওয়া করছে। হারিছ ঘুমাচ্ছে, অনেক বড় ধকল গেছে তার উপরে। গ্যারেজের মালিক রহমান মিয়া আসছিল সন্ধ্যায়, ললিতার হাতে ৫০০ টাকা দিয়ে গেছে উনি হারিছের জন্য ঔষধপত্র আনতে। সমস্ত বস্তির লোকজন তো হারিছের এমন অবস্থা দেখে অবাক!
বস্তির প্রায় অনেকেই আছে যারা আজেবাজে কাজে জড়ায় কিন্তু হারিছ তাদের থেকে সম্পূর্ন ভিন্ন একজন মানুষ। সহজ সরল মনের একজন মানুষ কখনো কারোর সাথে কোন বাক বিতন্ডায় জড়ায় না,কেউ জোর করেও তাকে কোন অশালীন কাজের সামিল করতে পারেনা অথচ এ হারিছই কিনা আজ পুলিশের মার খেয়ে বাড়ি ফিরেছে!
গত শীতকালে বস্তির পাশেই যাত্রাপালা হচ্ছিল, বস্তির সব মেয়ে পুরুষ সে যাত্রা দেখতে যায় কিন্তু হারিছ কিছুতেই যেতে রাজী হয়নি ললিতাকে বলেছিল যাত্রাতে নোংরামি হয়,ওসবে যেতে নেই।
পাড়ার অনেকে নেশাটেশা করে,হারিছ বিড়ি সিগারেট পর্যন্ত খায়না আর সে হারিছ গাঁজাসহ পুলিশের হাতে ধরা খায়!
বস্তিতে ললিতার মাথা নত হয়ে যায় লজ্জায়। হারিছের শারিরীক কন্ডিশন এখনো ভাল নয়, ডাক্তারের দেয়া ইনজেকশনে হারিছ অঘোরে ঘুমাচ্ছে তাই ললিতার জানা হচ্ছে না কি করে হারিছ এ ছেলেগুলোর পাল্লায় পড়লো!
ক্লান্ত শারমিন বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই দুচোখ ভারী করে ঘুম এসে ধরা দেয়। তন্দ্রাচ্ছন্ন শারমিনের দুচোখে ফুঁটে উঠে ললিতার পতিভক্তি। শারমিনও চায় জুবায়েরকে এমন ভালবাসতে,কিন্তু জুবায়েরের উচ্ছৃঙ্খল আচরণের হেতু শারমিন ধীরে ধীরে কেমন জানি জুবায়েরের থেকে দূরে সরে যাচ্ছে।
চলবে….
-অরুন্ধতী অরু