মধ্যরাতের গল্প (লেট নাইট এডিশন):
রাত এগারোটা বাজতেই কেমন জানি একটা অস্বস্তি এসে ঘিরে ধরলো। পরিচিত সব অনুভূতির সাথে মিলিয়ে দেখলাম। লাভ হলোনা। একেবারেই অন্যরকম কিছু। শায়লা থাকলে নিশ্চিত বলতো,
– এসব ফালতু চিন্তা বাদ দিয়ে ঘুম দাও। দেখবে সকালে উঠে সব ঠিক হয়ে যাবে।
শায়লার কাছে অবশ্য দুনিয়ার সবকিছুই এমন। কোন কিছু নিয়ে বাড়তি আগ্রহ কিংবা উত্তেজনা তার ভেতর কাজ করেনা। বিয়ের প্রথম রাতেই আমি সেটা টের পেয়েছিলাম। সুন্দরীদের একটা তালিকা করলে শায়লা যে সেটার প্রথম দিকে থাকবে তা নিয়ে বোধহয় কারো কোন সন্দেহ নেই। এরকম একটা মেয়ে কিভাবে দিনের পর দিন হাজারো ছেলের চক্ষুদৃষ্টি উপেক্ষা করে আমার জন্য টিকে ছিলো তা একটা বড় রহস্যই বটে। কেবল মুখশ্রী কিংবা গাত্রবর্নই শুধু নয় আকর্ষনীয় দেহসৌষ্ঠবের অধিকারী শায়লাকে বিয়ে করতে পারায় আমার উপচে পড়া উচ্ছাস কারো কাছে গোপন ছিলোনা। কিন্তু বিয়ের এক সপ্তাহের মাঝেই আমার সেই উচ্ছাসে ভাটা পড়ল। আমি আবিস্কার করলাম শায়লার নিজের ভেতরের দুনিয়া আশ্চর্য রকম ঠান্ডা। যার প্রভাব তার শরীরেও বিদ্যমান। অনেক চেষ্টা করেও কোন লাভ হয়নি। বরং মনে হয়েছে আমি যেন বিরাট কোন পর্বতমালার গায়ে অহেতুক ঢিল ছুড়ে চলেছি। তবে শায়লার একটা গুন ছিলো। তার হাতের রান্না ছিলো অসাধারন। সেটা সামান্য আলুভর্তা হোক কিংবা পোলাও কোর্মা হোক। তবে শায়লা আমাকে ছাড়া আর কাউকে তার রান্না করা খাবার খেতে দিতো না। এমনকি নিজেও খেতোনা। অনেকবার প্রশ্ন করার পরও এর কোন উত্তর সে আমাকে দেয়নি। শায়লাকে বিয়ে করার পর আমার জীবন তাই কেমন জানি এক রহস্যের চোরাগলিতে আটকে রইলো। এর থেকে বেরিয়ে আসার কথা যে দু’একবার ভাবিনি তা নয়। কিন্তু ডিভোর্সের মতো এতোবড় ডিসিশন আমার পক্ষে নেওয়া সম্ভব হয়নি। আর তাছাড়া শায়লার রান্নার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম আমি। সেটাও হয়তো আমার আটকে থাকার একটা কারন। এর ভেতর হঠাৎ করেই আমাকে সুনামগঞ্জ বদলি করে দেওয়া হলো। আমি ঢাকা শহরে বড় হয়েছি। ঢাকার বাইরে তেমন থাকা হয়নি। রীতিমতো বিপদে পড়ে গেলাম। শায়লা বরাবরের মতোই নির্বিকার। খুব ঠান্ডা স্বরেই বললো,
– ঢাকার বাইরেও তো মানুষ বাস করে। তুমি আগে যেয়ে জয়েন করো। এক সপ্তাহের ভেতর আমিও যাচ্ছি সেখানে।
শায়লার কথার জোরের হয়তো আমি সুনামগঞ্জ এসে পৌছালাম। হাওড় অঞ্চল। ঢাকার একেবারেই বিপরীত। মনে হচ্ছিলো পঞ্চাশ বছর আগে ফিরে গিয়েছি। যে বাসায় উঠলাম সেটা বেশ পুরানো। শহরের শেষ মাথায় স্যাঁতসেঁতে মেঝে আর নোনা ধরা দেয়ালের একতলা বাড়ি। বাড়ির মালিক দেশের বাইরে থাকেন। প্রথম দু’একদিন বাইরের থেকে খাবার আনিয়ে খেলাম। কিন্তু শায়লার রান্নার সাথে অভ্যস্ত জীহবা যেন প্রতিবাদ করে উঠলো। সাতদিন যেন অনন্তকাল। সেই অনন্তকাল পেরিয়ে সাতদিন পর শায়লা এলো। এসেই সব এমনভাবে গোছাতে শুরু করলো যেন এইটা আমাদের ঢাকার বাড়ি। শায়লা আসায় আপাততো খাওয়া দাওয়ার সমস্যা সমাধান হলো। কিন্তু এখানে রাত নয়টা বাজতেই যেনো গভীর রাত। আমরা ঢাকা শহরের মানুষ গভীর রাতের সাথে অভ্যস্ত নই। তাই খুব ভয় লাগতো। কোনভাবেই রাতে যেনো ঘুম না ভাংগে সেই টেনশনে থাকতাম। শায়লা ঘুমিয়ে যেতো। আমার ঘুম আসতে দেরি হতো। এভাবে মাসখানেক কাটার পর আমি স্বাভাবিক হয়ে গেলাম। আর আমাদের জীবনও স্বাভাবিক নিয়মেই কাটতে লাগলো। এর মাঝে হঠাৎ একদিন শায়লার ছোটবোন লোপা এসে হাজির। উদ্দেশ্য সিলেট ভ্রমন। লোপা আবার শায়লার একদম বিপরীত। চঞ্চল লোপা শায়লার মতো অতো সুন্দরী না হলেও ফেলে দেওয়ার মতো নয়। আমাদের বাড়িটা যেনো হঠাৎ করে প্রান পেলো। আমি অফিস থেকে সাতদিনের ছুটি নিলাম। এই সাতদিন আমরা সিলেট, মৌলভীবাজারের সব দর্শনীয় স্থান ঘুরে বেড়ালাম। কিন্তু একটা বড় ধরনের সমস্যা হয়ে গেলো। আমি লোপার প্রেমে পড়ে গেলাম। জড় শায়লার সাথে থাকতে থাকতে দমবন্ধ আমি যেনো লোপার মাঝেই মুক্তি খুঁজে পেলাম। সমস্যাটা আরো বড় হয়ে গেলো যখন লোপা সেটা টের পেলো। ভাবলাম গুরুতর কিছু ঘটবে। কিন্তু না। আমাকে অবাক করে দিয়ে উলটো প্রশয় দেওয়া হলো। দিনগুলো খুব ভালো কাটছিলো। বরাবরের মতো শায়লা তখনো নির্লিপ্ত। পনেরো দিন কেটে যাওয়ার পরেও লোপা সেখানেই রয়ে গেলো। শায়লা কিছু আঁচ করতে পারছিলো কিনা বুঝতে পারছিলাম না। তবে আমার অন্ধকার মুছে আলোর উপস্থিতি আশপাশের মানুষের দৃষ্টি এড়ালোনা।
একদিন অফিস থেকে বাড়ি ফিরে জানতে পারলাম শায়লা আগামীকাল লোপাকে রেখে আসতে ঢাকা যাবে। শোনার পর আমার মুখ আবার অন্ধকার হয়ে গেলো। কি করবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। মনটা ভীষন খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। রাতে খাওয়ার পর চুপচাপ শুয়ে পড়েছিলাম। শায়লা ঘুমিয়ে যাওয়ার পর পা টিপে টিপে লোপার ঘরে গিয়েছিলাম। দেখলাম এলোমেলো বিছানার শূন্য খাট। চমকে উঠলাম। কিন্তু পরক্ষনেই বাথরুম থেকে পানির শব্দ আসায় বুঝলাম ভয়ের কিছু নেই। আমি আবার ফিরে এলাম আমার রুমে। শায়লার পাশে শুয়ে পড়লাম। না। সে রাতে আর কিছুই হলোনা। পরদিন সকালে লোপাকে নিয়ে শায়লা চলে গেলো। আমি আবার একা হয়ে গেলাম। সেই সাথে রাতের ভয়টা আবার ফিরে এলো। ওরা চলে যাওয়ার তিনদিনের ভেতর লোপার মৃত্যুসংবাদ পেলাম। একমাত্র জামাই হিসেবে আমার তখনই ছুটে যাওয়া উচিৎ ছিলো। কিন্তু কেন জানি মন বলছিলো কোনভাবেই ওখানে যাওয়া যাবেনা। আমি অফিসের ঝামেলার দোহাই দিয়ে কোনরকম কাটিয়ে গেলাম। তারপর মোবাইল ফোনটা বন্ধ করে ঘরে ফিরলাম। ঘরে ফিরেই দরোজা জানালা সবকিছু লাগিয়ে চুপচাপ বসে রইলাম। সারাদিন খাওয়ার কথা মনে ছিলোনা। সন্ধ্যার পর খালি পেট তার খালি থাকার কথা জানান দিলো। অভ্যাসবশত ফ্রিজ খুললাম। শায়লা সাতদিনের খাবার রান্না করে ফ্রিজে রেখে গিয়েছে। ফ্রিজ বন্ধ করে দিলাম। খেতে ইচ্ছা করছেনা। ঠান্ডা পানির একটা বোতল রাখা আছে। বের করে বোতল থেকে পানি ঢেলে দু’গ্লাস পানি খেলাম। ঘড়ির কাটা আস্তে আস্তে সামনে এগোতে লাগলো।
এখন এগারোটা সাঁইত্রিশ বাজে। আমি এক অপরিচিত অনুভূতিকে সংগে নিয়ে বসে আছি। গলাটা আবার শুকিয়ে গিয়েছে। পানি খেতে পারলে ভালো হতো। পানির কথা মনে পড়তেই লোপার কথা মনে পড়লো। মাত্র তিনদিন আগেই পাশের রুমে ছিলো মেয়েটা। মেয়েটার কথা মনে পড়তেই পাশের রুমে যেতে ইচ্ছে হলো। রুমে ঢুকেই চমকে গেলাম। খাটে লোপা পা তুলে বসে আছে। আমাকে দেখেই রাগ রাগ মুখে বললো,
– আসতে এতোক্ষন লাগে? সাঁইত্রিশ মিনিট ধরে অপেক্ষা করছি!
– মানে!!!!! তুমি!!! কোত্থেকে? তুমি না মারা গিয়েছ?
– হ্যাঁ। আজ দুপুরে। শায়লাপু মেরে ফেলেছে আমাকে।
– কি বলো? কেন???
– আপনার সাথে সম্পর্ক করায়। শায়লা আপু কখনো কাউকে ক্ষমা করেনা।
– তাহলে তুমি এখন কথা বলছো কিভাবে?
– আমিতো কথা বলছিনা।
– তাহলে আমি তোমার কথা শুনছি কিভাবে?
– আপনি আমার কথা শুনতে পাচ্ছেন না। আপনি আমার কথা অনুভূতির মাধ্যমে বুঝতে পারছেন। মৃতরা নিজেদের ভেতর এভাবে অনুভূতি বিনিময় করতে পারে।
– মানে বুঝলাম না! তুমি তো মৃত। আমিতো জীবিত। তাহলে……………।
এবার হেসে ওঠে লোপা,
– বেঁচে থাকতেও ছেলেরা বোকা থাকে, মরে গেলেও তেমনি বোকাই রয়ে যায়! ঠান্ডা পানি খাওয়ার কথাটা ভুলে গেলেন?
– কেন? কি ছিলো ঐটায়?
– কি ছিলো সেটা শায়লা আপু জানে। শায়লা আপু কখনো কাউকে ক্ষমা করেনা। তবে একটা সুবিধা হয়েছে। এখন আমরা যা খুশি করতে পারবো। শায়লা আপু টেরও পাবেনা। হা হা হা।
লোপা হাসি থামাতেই পারছেনা। আমি ঘামতে শুরু করলাম। ভালো করে চোখ কচলে আবার দেখলাম। লোপাকে আর দেখা যাচ্ছেনা। তবে তার হাসিটা এখনো শোনা যাচ্ছে। আমি ঘামতে শুরু করলাম। কে জানে, মৃতরা ঘামে কিনা!
-রুমেন আহমেদ