রুনু চলে গেছে দু’সপ্তাহ হলো। হয়তো সে কারনেই আমি কিছুটা একা অনুভব করছিলাম। রাত দুপুরে চা বানিয়ে দেওয়া আর ভোররাতে বোবায় ধরলে পাশের রুম থেকে দৌঁড়ে এসে দাদা,দাদা বলে দরজা ধাক্কাবেনা কেউ ভেবে আমার কিছুটা কষ্টও হচ্ছিলো।
আমি একাকীত্বের এই পুরো সময়টা মায়ের ডায়রিতে ডুবে রইলাম। সেখানকার লেখা সমস্ত ঘটনাগুলো আমার সামনে ঘটতে থাকলো। আমি মায়ের কষ্টগুলো নিজে মনে অনুভব করলাম। ইস, কি যন্ত্রণাদায়ক ছিল বাবার অকথ্য কথাগুলো! যেসব কথা বলে মা’কে অপমান করতো। কি নির্মম ছিল বাবার ব্যবহার!! যা মা’কে ভেঙ্গেচুরে ফেলেছে প্রতিনিয়ত। বাবা আঙ্গুল দিয়ে বুঝিয়ে দিতেন মায়ের সে ঘটনার জন্য সে নিজেই দায়ী।
আর তারপর বাবার জীবনে তার আর জায়গা ছিলনা।
সব কিছু বুঝেও আমার অল্পশিক্ষিতা মা ভেবে পাচ্ছিলেন না, সে কি করবে? কোথায় যাবে। পুরো দু’বছর তিনি সব সহ্য করলেন আমার দিকে তাকিয়ে। অবশেষে বাবা তার ধৈর্য্যের বাধঁ ভাঙ্গতে এক বিকালে ছোটমাকে নিয়ে উপস্থিত হলেন। অপমানের,লজ্জার এই ধাক্কা মা সামলাতে পারলেন না। নিরবে আমাকে নিয়ে সেদিন সে বাড়ি ছেড়ে দিলো। বাবা হাফ ছেড়ে বাচঁলেন।
মা নানীর সাথে আমিও বোঝা হয়ে গেলাম মায়ের ভাইয়ের সংসারে। সেখানকার যন্ত্রণায় কাতর মা নিরুপায় হয়ে আমাকে বাবার কাছে পাঠিয়ে দেন তারও দু’বছর পর। আজ এতোবছর পর সেখানে তার বাকি জীবন কেমন কেটেছে তা বুঝতে আমি একবার নানাবাড়ি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম।
রুনু যাবার পর এ বাড়িতে দু’দফা পুলিশ এসেছে। কারণ কেয়ার মৃত্যুর আগের লাস্ট লোকেশন ছিল আমাদের বাড়ি। নানা প্রশ্নের সব উত্তর আমাকে দিতে হয়েছে। বাবা নিরব থাকলেন পুরোটা সময়। হয়তো আমার উপর তার কিছুটা রাগ হয়েছে সে কারণে। আমি তা বুঝেও আজ সকালে নাস্তার টেবিলে বাবাকে বললাম,
‘আমি একবার নানাবাড়ি যাব’
বাবা বড় বড় চোখ করে আমার দিকে তাকালেন। বেশ বিরক্তি নিয়ে বললেন,
‘তুই ছোটবেলায় একবার ওখান থেকে আসার পর আর যেতে চাস নি। আজ যেতে চাচ্ছিস কেন?’
আমি আচমকা বাবাকে বললাম,
‘না গিয়ে তুমি করেছ অন্যায়, আর আমি করেছি ভুল বাবা। আমার মা জীবনের শেষদিন পযর্ন্ত তোমার স্ত্রী ছিলেন। তার প্রতি তোমার কিছু দ্বায়িত্ব ছিল। অথচ তুমি তার খোঁজ রাখনি।’
বাবা আমার কথায় হতবাক হলেন। বারবার ডান হাতে কপাল মুছতে লাগলেন। আমাদের কথাবার্তা ছোটমা শুনছিলেন। সেও হয়তো বাবার মতো অবাক হলেন, কিন্তুু কিছু বলছিলেন না। তিনি হয়তো কথা খুঁজে পাচ্ছিলেন না কি বলবেন?
আমি বাবার চোখের দিকে তাকিয়ে আবারও বললাম,
‘সারাজীবন ধরে একটা অন্যায় কি করে তুমি করলে বাবা? কেন তোমার একবারও মনে হলোনা তুমি কি দারুণ অন্যায় আমার মায়ের প্রতি করেছ?’
তারপর বাবার বিস্ময়ে ফেটে পরা দৃষ্টি উপেক্ষা করে আমি উঠে এলাম। বাবার মতো নিজের প্রতিও নিজে কিছুটা অবাক হলাম, বাবাকে এমন কথা কি করে বলতে পারলাম? কিছুটা অপরাধবোধ হতে লাগলো সেজন্য মনে মনে।
আমি ব্যাগ গুছিয়ে সকালেই বেড়িয়ে পড়লাম। সবকিছুর উর্ধ্বে আমাকে মায়ের স্মৃতির স্পর্শ টানছিল। গাড়িতে চড়বার আগে মীরার কথা মনে করে ফোন দেওয়ার জন্য পকেটে হাত রেখে বুঝতে পারলাম, ফোনটা ফেলে এসেছি বাসায়। মনে মনে শান্তি অনুভব হলো। ভালোই হয়েছে, নিজেকে বন্ধনমুক্ত লাগছিল। পালকের মতো হালকা সুখময় আনন্দ হচ্ছিল মনে।
নানা বাড়ি পৌঁছলাম রাত বারোটার কিছুপরে…..
-বেলা প্রধান