অনুধাবন ( ১৮তম পর্ব )

লিমা আর আসলাম দুজনেই তাদের মধ্যকার উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় অন্য কেউ শুনতে পাইনি ভেবে যে যার ঘরে ঢুকে গেলেও বাড়ির সদর দরজার পাশেই আঁধারে দাঁড়ানো আরো একজনও শুনে ফেলে কথোপকথনটুকু। তিনি আর কেউ নন এ বাড়ির গৃহকর্তা তালুকদার সাহেব স্বয়ং। নিজের মেয়ে হলে আজ নিশ্চিত লিমার পিঠে উনি গর্বভরে চাপড়ে দিতেন। নিজের সিদ্ধান্ত সঠিক হয়েছে, যথার্থ মানুষ তিনি নির্বাচন করেছেন নিজের প্রতিপত্তি টিকিয়ে রাখতে এই খুশীতেই বুঝি তার একান ওকান পর্যন্ত হাসি ছড়িয়ে পড়ে। শুধু একটাই শংকা। রেহানার স্বামী আসলাম। সে যে আড়ালে আবডালে তার শত্রুপক্ষের সাথে হাত মিলিয়েছে সেটা তালুকদার সাহেব জানতে পেরেছেন। মেয়ের জামাই না হলে বহু আগেই একে অন্যজগতে পাঠিয়ে দিতেন হয়তো বা। আড়তে একটু কড়কে দেয়ার পরে ভেবেছিলেন আসলাম সহসা আর এ বাড়ি মুখো হবে না। কিন্তু এতো অল্প সময়েই আবারো চলে আসাটা খুব একটা ভালো কোন লক্ষণ অবশ্যই নয়। তালুকদার সাহেবের মাথায় শুধু একটা লাইনই ঘুরছে, ‘পিপীলিকার পাখা গজায় মরিবার তরে’। কিন্তু কি শাস্তি দিলে যে সাপ ও মরবে লাঠি ও ভাঙবে না সেটাই সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। থাক কাল ও এ ব্যাপারে চিন্তা করা যাবে ভাবতে ভাবতে নিজের ঘরে ফেরেন তালুকদার সাহেব।

……………..

কথায় বলে কোন কিছু ভাবার হলে বা করার হলে তা সাথে সাথে করে ফেলা ভালো নয়তো প্রায়শই সময় বা সুযোগের অভাবে পস্তাতে হয়। এই যে তালুকদার কাল ভাববে ভেবে আসলামের ভাবনা আপাতত দূরে সরিয়ে রাখলো, কিংবা লিমা যা বলা হয়েছে অনেকই বলা হয়েছে ভেবে আর আসলামকে নিয়ে মাথা ঘামালো না; সেই সময়টুকু কিন্তু আসলাম ঠিকই ব্যবহার করে ফেললো। রাতের অন্ধকারে সেই বিকালে লিমার রুমের হিসাবের ফাইলের মধ্য থেকে কিছু প্রয়োজনীয় কাগজ ওদের অনুপস্হিতিতে যা সরিয়ে রেখেছিল পৌঁছে দেয় ওয়াদুদ আর রতনের কাছে।

এই মূহুর্তে জমিজমা সংক্রান্ত ঐ কাগজ পেয়ে রতন আর ওয়াদুদ যে খুব খুশী হয় তা কিন্তু না। কারণ যাদের দিয়ে ঐ কাগজ সহ তালুকদারের মুখোমুখি হওয়ার কথা তারা যে এখনো হাসপাতালের বিছানায় আটকে আছে। তার ওপর তালুকদারের বুদ্ধির জেরে রতন এখন তাদের কাছে দুষ্ট আত্মীয়ের অন্য নাম। রতন অনেকবার বোঝাতে চেয়েছে এমনকি হাসপাতাল পর্যন্ত গিয়ে বলতে চেয়েছে, ওদেরকে আটকে রেখে ওর কি লাভ? সে কথার জবাবে হাকিম উল্টো বলেছে, ‘যাতে আপনে তালুকদার চাচার আরো দোষ দিতে পারেন। আমরা যে সেদিন ওখানে যাব সেটা তো আপনি আর তালুকদার চাচা ছাড়া আর কেউই জানতো না। তার ওপর আমার সমস্ত চিকিৎসার খরচ উনি দিচ্ছেন। আপনি তো একটা ফুঁটো পয়সাও সাধেন নি।’ রতন হাকিমকে বোঝাতে পারেনি তার সামর্থের কথা। বরং নিজের করা কূটচাল তালুকদারের বুদ্ধিতে এমন বুমেরাং হয়ে তার দিকে চলে আসবে সেটার ভারেই তখনো সে মর্মাহত।

আসলামের এনে দেয়া ঐ কাগজের মূল্য এখন শূন্যের কোঠায় হলেও তাতে একবার চোখ বুলিয়ে কখন কি কাজে লেগে যায় ভেবে সেটা সরিয়ে রাখে রতন। হাকিমদের ঘটনার পর থেকে ওরা ডেরা পাল্টেছে। আগে নাজমার সৎমায়ের ঘরের পেছনে একটা ছোট ছাপড়া ঘরে বসতো ওদের সব রকমের আড্ডা। হাকিমদের ঘটনার পর থেকে ওরা ডেরা পাল্টে ওয়াদুদের বাড়ির পেছন কোণে এক ঘরে বসে। একটু মদ গাঁজা হলেই নেশার কাজ হয়ে যায় ওদের। সমস্যাই হচ্ছে ওদের টাকা দিয়ে তাস খেলা নিয়ে। সবারই হাতে টাকা দরকার হয় খেলার জন্য। সে কারণেই ভাইয়ের সাথে গন্ডগোল লাগিয়ে দিতে পিছপা হয়নি রতন। ওয়াদুদ তালুকদার সাহেবের হয়ে কাজ করলেও জমিজমার হিসাব নিয়ে হওয়া গন্ডগোলে সে ও এখন দুমুখো সাপের মত আচরণ করছে। আসলামের উপস্থিতিতে খেলা আর নিজেদের আলোচনা থামিয়ে কথা বলে উঠে রতন।

বসো জামাই, তুমি তো বহুত কামেল আদমি আছো। আরো কয়েকটা দিন আগে আনতে পারলে কাজ হইতো যদিও। তবু দেখা যাক কি করন যায়।

আমার একটা আবদার আছে আপনেগো কাছে রতন চাচা?

এতো ভনিতা করো কেন জামাই, কইয়া ফালাও।

হাকিম ভাই গো বাদ দিয়া অন্য কোন বুদ্ধি বাইর করেন। আমি একটা প্রতিশোধ চাই। আজকা রাসেল ভাইর বড় বৌ আমারে যা না তা কইয়া অপমান করসে।

কও কি? কেন তুমি কি করসো?

নিজের অংশটুকু রেখে ঢেকে বলে লিমার বলা অংশটুকুই আরেকটু ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বলে আসলাম খানিক বেশী সহানুভূতি আর সাহায্যের আশায়।

ওর চোখের দিকে তাকিয়ে যে কেউ বুঝি বলে দিতে পারবে যে ও অনেকটাই বানোয়াট কথা বলছে। লিমাকে রতন যতদূর চেনে ও এতো মুখরা রমনী মোটেও নয়। তবু আসলামকে এখন হাতছাড়া করা ঠিক হবেনা ভেবেই গলায় যথেষ্ট পরিমান সান্ত্বনা ঢেলে ওর সাথে গলা মেলালো।

আইচ্ছা তুমি বাসায় যাও আসলাম, দেখি আমরা কি করা যায়। তোমারে লাগলে খবর দিলে চইলা আইসো।

রতন আর ওয়াদুদ মিলে তার শ্বশুরকে কিছু একটা শিক্ষা দিতে পারবে বলেই আসলামের দৃঢ় বিশ্বাস। যদিও শ্বশুরের কিছু হলে আখেরে তার লোকসান। তবু বেটা মানুষের ইজ্জত না থাকলে আর আছে কি? যে রেহানা আগে চোখ তুলে কথা কইতো না শেষবার ওদের বাড়ি থেকে যাওয়ার পর থেকে সে যা মুখে আসে বলে দেয়। আসলাম চাইলেই আর আগের মতো রেহানাকে যখন তখন কটু কথা বলার সাহসটুকু করতে পারেনা। আর যাই হোক এরকম কিছু তো ঘরের বৌয়ের কাছ থেকে মেনে নেয়া যায়না। ঘরের বৌ হবে পা মোছার কাপড়ের মতো। সাত চড়ে রা তো করবেই না বরং ঘুরে এসে আবার পা মোছার কাজে লাগবে।

ওয়াদুদের ডেরার খবর আসলাম পায় ওর সম্বন্ধী ইকবাল অর্থাৎ শাহানার স্বামী। আসলাম প্রায়শই ভাবে ও কি বোকা নাকি নয়তো সূদুর প্রবাসে থেকেও ইকবাল দেশের এতো খবর জানে আর সে কিছুই তেমন জানেনা। মনে মনে ইকবালের ওপর রাগ ও একটু আছে। কি রকম শ্বশুরকে তেল দিয়ে দুবাই চলে গেলো আর সে কি না বিশ ত্রিশ হাজার টাকা নিয়েই থেমে থাকতে হচ্ছে। তাও আবার আজকাল টাকার হিসাব নেয়ার লোক ও এসে হাজির হয়েছে। বিদেশ চলে যেতে পারলে তো সে ও কত কত টাকা কামাই করে ফেলতো। এই শ্বশুরের ফালতু সম্পদের দিকে কে তাকিয়ে থাকতো?

বাড়িতে ফিরতে বোধহয় একটু রাতই হয়ে গেল। বাইরের সদর দরজা বন্ধ। এই রাতে কি করবে, কোথায় যাবে বুঝতে না পেরে কিছুক্ষণ থম ধরে দাঁড়িয়ে রইলো বাইরেই। তারপর আলতো টোকা দিল দরজায়। কয়েকবারের টোকায় ওপাশ থেকে কোন শব্দ না হওয়াতে একটু জোরেই ধাক্কা দিল। আর মনে মনে শাপ শাপান্ত করছিল তার বৌ রেহানাকে। জামাই এতো রাত অব্দি বাড়ি ফেরেনি উনি নিশ্চয়ই দিব্যি নাকে তেল দিয়ে ঘুমাচ্ছেন। যিনি দরজা খুললো তাকে সামনে দেখার কোন প্রস্তুতিই বুঝি আসলামের ছিল না।

কি, আসলাম; এতো রাত পর্যন্ত কোথায় ছিলে? দোকানে মাল উঠাচ্ছো বুঝি? রেহানা কে বলে গেলে তো রাত বিরাতে ও ই দরজা খুলে দিতে পারে। কাজের লোকগুলো শুয়ে যায় তাড়াতাড়ি, নয়তো সকালে ঘুম থেকে উঠবে কিভাবে? তুমি জামাই হলেও তো আমার ঘরের ছেলের মতই, তাই না?

ধরা পরার আতংকে সিঁটিয়ে যাওয়া আসলাম কোন কথাই না বলতে পেরে না মানে না মানে আপনাকে কষ্ট দিলাম বলতে বলতে এক প্রকার দৌড়েই ঘরে ঢুকে গেল। পেছনে তাকালে দেখতে পেতো এক অদৃশ্য হাসিতে তালুকদারের পুরো মুখ ভরে আছে।

আসলামের ব্যাপারটা নিয়ে সে রাতে পাত্তা দেবেনা ভেবেছিল তালুকদার। কিন্তু সে এতো রাতে বাড়ি থেকে বের হয়েছে সেটা বাড়ির সদর দরজায় কাজ করা কামলা জানিয়ে যায়। শুনেই কেমন সন্দেহ হয় তালুকদার সাহেবের। মোটামুটি ধারনা থাকায় আসলামকে লক্ষ্য করে এগিয়ে যাওয়া তালুকদারের লোকের পক্ষে খুব একটা কঠিন কিছু হয়নি। তালুকদারের সব শংকাকে সত্য প্রমান করে দিয়ে আসলাম ওয়াদুদের ডেরাতেই গিয়েছে এটা জানার পরপরই তালুকদার নিজে বাড়ির সদর দরজা বন্ধ করে দেন।

আসলামের জন্য অপেক্ষায় জেগে থাকতে থাকতে তালুকদার ভাবেন, রেহানা ও আসলামকে কিছু বুঝতে না দিয়ে ওদের সাথে একটু বসা দরকার। আসলামকে বিদেশ পাঠিয়ে দিলে কেমন হয়? তাহলে দেশে অন্তত বড় মেয়েটা শান্তিতে থাকবে। কিন্তু যে অলস আসলাম, সেই লোক বিদেশের মাটিতে কষ্ট পেয়ে দুদিনেই না পালিয়ে আসে। ইকবালের সাথে কথা বলা যায়। কিন্তু সেটাও যে আরেক দুই নাম্বার।

নিজের ভাগ্যে মাঝে মাঝে তালুকদারের অবাকই লাগে। দুইটা মেয়ের জামাই কারো কিভাবে খারাপ হয়। তা ও ভালো ছেলের বৌ টা অন্তত ওদের মতো হয়নি। নয়তো সব ফেলে একদিকে পালিয়ে যাওয়া ছাড়া বোধহয় কোন উপায় থাকতো না। কাঁহাতক ভালো লাগে ঘরের এসব কূটকচালী সামলাতে। ব্যবসাতে ও তো প্রতিপক্ষ কম নয়। এ সময় নিজের লোকেরা হাতে না থাকলে সামনে আগানোই যে ভীষণ কষ্টকর হয়ে যায়।

-ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস

চলবে…

https://www.facebook.com/groups/1749042645384412/permalink/2215391675416171/

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *