নপুংসক (১০ম পর্ব)

রুনুর ধাক্কা-ধাক্কিতে দুপুরের অলস ভাতঘুমটা ভাঙ্গল। আমি রেগে গিয়ে বললাম,

‘তোর সমস্যা কি? এমন ভাবে ধাক্কা-ধাক্কি শুরু করেছিস যেন কোন প্রলয় হয়েছে!’

আমার কথায় রুনু আহত না হয়ে লাজুক লাজুক মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল,

‘দাদা, তোমাকে বাবা ডাকছেন?’

‘কি হয়েছে বলবি তো? ঘুমিয়েছি বাবাকে বলিস নি?

‘তুমি যাওনা একবার ওঘরে’

অনিচ্ছায় উঠে গেলাম। বাবা আমাকে দেখে বিছানা ছেড়ে উঠে এলেন। কাঁধে হাত রেখে বিছানায় বসিয়ে আহ্লাদী গলায় বললেন,

‘বাবু বোস, জানিস, বিরাট একটা ঘটনা ঘটে গেছে রে।’

আমি কিছু বলার আগেই ছোটমা রান্নাঘর থেকে প্রায় ছুটে এসে আমার মাথায় হাত রেখে বললেন,

‘বাবলু, বিকালে মতিনের বাবা আসবেন আমাদের বাসায়’
‘আমি বুঝতে পারলাম না এতে এতো উল্লাসের কি হলো?বাবা আমার অবাক হওয়া মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলার আগেই ছোটমা বাবাকে থামিয়ে দিয়ে আবার বললেন,

‘একা আসবেন না। লোকজন নিয়ে আসবেন। আমাদের রুনুকে তারা আংটি পড়াবেন আজকে। ‘

বাবাকে উচ্চস্বরে কখনও হাসতে দেখিনি। তার গা কাঁপিয়ে মৃদুহাস্যে ভরা মুখ আমার ভিতরটা আনন্দে ভরে দিল। তিনি হাসতে হাসতে বললেন,

‘মতিনের মতো এমন ছেলে পাবো ভাবিনি কখনও। আল্লাহ্‌ পাকের অসিম রহমত। ‘
তিনি এগিয়ে এসে আমার হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বললেন,

‘আমি নিয়্যত করেছি, যতদিন বাচঁবো ফজরের নামাজের পর আল্লাহর দরবারে দু’রাকাত শুকরানা নামাজ পড়ব আজ থেকেই।’

অস্থিরের মতো আবার বললেন, ‘তুই বসে থাকিস না। কি করতে হবে কর। দৌড়াদৌড়ি যা করার তোকেই তো করতে হবে।’

আমি বাবার দিকে তাকিয়ে মনে মনে বললাম,’তুমি অনেক ভাল একজন বাবা। অনেক ভাল। বাবা, আমি তোমাকে অনেক ভালবাসি।’

ঘরে এসে দেখি রুনু এখনও দাঁড়িয়ে আছে। ওর চোখের প্রশ্ন উপেক্ষা করে আমি মতিনকে ফোন দিলাম-
ফোন ধরেই মতিন বলল,

‘কি রে সারপ্রাইজড করেছি কেমন বল? জানি তো তুই ফোন দিবি। তোর ফোনের অপেক্ষা করছিলাম।’

‘তুই আমাকে তো কিছু বললি না। ‘

‘তোকে এতো বলার কি আছে শালা? সম্পর্কে বড় বা ছোট যাই হ, তুই এখন থেকে আমার শালা।’

‘ আচ্ছা যাহ্, আমি তোর শালা। শালাকে পায়ে হাত দিয়ে সালাম করতে হবে এখন হা হা হা….। পরক্ষনেই কিছুটা দমে গিয়ে বললাম,
‘মতিন, তুই রুনুর ব্যাপারটা তো জানিস্….’

‘কিসের মধ্যে কি বলিস? ওসব বাদ দে।তোকে এখন যা বলবো মন দিয়ে শোন..

আমি বাবাকে বলেছি,শুধু আংটি পড়ানো হবে। আসলে ব্যাপার ভিন্ন। আমাদের সাথে আশরাফ চাচা,আমার একমাত্র ফুপি আর আমার অফিসের বস যাবেন। ফুপিকে ম্যানেজ করে রেখেছি,আংটি পড়ানো হয়ে গেলেই ফুপি বলবেন,
‘বিয়েটা আটকে রেখে লাভ কি? ওটাও হয়ে যাক। আজকালকের ছেলে শ্বশুরবাড়ি ঘন ঘন আসবে, এদিকে বিয়ে হয়নি ভাল দেখাবে না।’ বাবা ভেবে দেখবেন, ঠিকই তো। ব্যস রুনুকে নিয়ে আমরা চলে আসবো। তুই মোটামুটি সব ব্যবস্থা করে রাখিস। বুঝতে পেরেছিস, কি বলেছি?’

আমার বুঝতে আসলেই কষ্ট হচ্ছে। কেমন অবিশাস্য লাগছে। মনে হচ্ছে,কিছুক্ষণ পর হয়ত দেখবো-এগুলো কিছুই সত্যি নয়, সবই আমার ভাবনা। আজকাল সবই ধোঁয়াটে অস্পষ্ট লাগে। দিনরাত ভাবনার মধ্যে থেকে থেকে সব কল্পনাই মনে হয়।

রুনু কেমন অদ্ভুত ভয়ার্ত মুখে আমার দিকে চেয়ে আছে। আমি মতিনের সাথে কথা শেষ করে রুনুর মাথায় হাত রাখলাম,

‘তুই ভয় পাবি না। মতিন অনেক ভালো ছেলে। মা আমাকে আগেই বলেছে,তুই সুখি হবি। মা আজকাল আমার আশপাশেই থাকেন। কত কথা বলেন! তার কথা দেখ সত্যি হয়ে গেল হা. হা হা..। ‘
রুনু কিছু বুঝলো না। তার দৃষ্টিতে আবারও প্রশ্ন চলে এলো। আমি জামা গায়ে দিয়ে বেড়িয়ে এলাম।

ঘন্টা দুয়েক সময়ের মধ্যে আমাদের অসুস্থ, দুঃখী দুঃখী বাড়িটা আনন্দে ভরে গেল। উপর থেকে নাজমা আন্টি তার নতুন বিয়ে দেয়া মেয়েটা চলে এলো। নিজাম চাচার ছেলে,ছেলের বউ, রুনুর বান্ধবীরা আমাদের কাছের সব আত্মীয়-স্বজনরা চলে এসেছে। অনেক নিষেধ করার পরেও কেয়া তার কিছু হিজড়া বান্ধবীদের নিয়ে এলো। ওদের ঢোলের তালে নাচগান চলছে। তানিয়া তার গ্রামের বাড়ি খুলনা থেকে আসতে পারলো না বলে দুঃখ করলো ফোনে।

বাবা ছোটবাচ্চাদের মতো অস্থির হয়ে ছুটোছুটি করছেন। ছাদে সামিয়ানা টানানো হয়েছে। সেই সামিয়ানা এই বৈশাখ মাসের টানা বাতাসে দু’বার উড়ে গেল। মহল্লার ছেলেরা আর ডেকোরেশনের লোকজন তৃতীয় বারের মত সামিয়ানা বাঁধছে।
বাবা ছুটে এসে আমাকে বললেন,

‘বাবু, আকাশের অবস্থা দেখেছিস? ঝকঝকে রোদ। খাওয়া দাওয়ার সময় যেন বৃষ্টি -বাদল না এলেই হয়। আমার এই মেয়ে বৃষ্টি কপাল মেয়ে।তার বিশেষ বিশেষ দিনে বৃষ্টি আসবেই। জন্মাবার সময় বৃষ্টি নিয়ে এসেছে। আজ কেবল ভিন্ন হলো।
আমি হাসলাম, মনে মনে আবার বললাম,

‘তুমি অনেক ভাল একজন বাবা। আমি তোমাকে ভালোবাসি, ভীষণ ভালোবাসি।’

রাত দশটায় রুনুর বিয়ে হয়ে গেল। কি সুন্দর যে লাগছে ওকে! বিয়ে বাড়ির ভিডিওম্যান বলেছে,’ভাই, ফার্স্টক্লাস লুকিং। কি জিনিস বানায়ে দেব চিন্তাও করতে পারবেন না।’
বাবার ধারণা ঠিক প্রমান করে খাওয়া-দাওয়ার সময় শিলা বৃষ্টি শুরু হলো। ছোটমা সারক্ষণ কান্নাকাটি করছেন। বাবা তাকে প্রশ্ন করলেন,

‘এতো কান্নাকাটি কিসের? আজ হাসহাসির দিন’
ছোটমা চোখ মুছে বললেন,

‘দেখছো না, লোকজন খেতে বসেছে ওমনি ঝড়ে সামিয়ানা উড়ে গেল? খাবার প্লেট রেখে সব দৌঁড়ে নিচে নেমে এলো!’

যাবার সময় রুনু বেশকিছু সময় আমাকে জড়িয়ে বসে থাকলো। ঠিক ছোটবেলায় ছোটমা ধমক দিলে যেভাবে ও আমাকে জড়িয়ে ধরে রাখতো। মায়ের দেয়া পাঁচ লক্ষটাকার সঞ্চয়পত্র ভেঙ্গে পাওয়া আট লক্ষ টাকা পুরাটাই আমি রুনুর নামে করে রেখেছিলাম। একটা খামে ভরে সেসব কাগজপত্র ওর হাতে দেবার সময় রুনু বলল,

‘এটা কি দাদা?’

আমি বললাম,

‘ শক্তি,

সব মানুষের শুধু একার কিছু অসহায়ত্ব থাকে। তোর অসহায়ত্ব মোকাবেলা করার জন্য আমার মায়ের অসহায়ত্বে জমানো শক্তি তোকে দিলাম।’

দিনের শুরুটা যেমন এনেছিল ভয়াবহ আনন্দের খবর, শেষটা এনে দিল ভয়াবহ দুঃখের খবর । ভোর রাতে তানিয়া ফোন দিয়ে কান্নাকাটি করছিল,
‘বাবলু ভাই, কেয়াকে ঐ হারামজাদা শয়তান বেটা কাল রাতে গুলি কইরা মারছে। বিয়া বাড়ি থ্যেইকা আইতে গিয়া ওরে ধরছে রাস্তায়। পরে বাজারের নিচে ডোবায় নিয়া বুকে গুলি করছে বাবলু ভাই’

চলবে….

-বেলা প্রধান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *