আমার বড় বোন যে বছর ধর্ষিত হয়েছিল , আমি সে বছর সেভেন থেকে এইটে উঠেছি আর আমার মেঝবোন ক্লাস টেনে। আমার বয়স তখন তের ছুঁই ছুঁই।আমার বাবা মধ্যপ্রাচ্যের একটা দেশে ভাল বেতনের চাকুরী করত আর মা গৃহিণী। আমরা তিন বোন আর মা মফস্বলের এই বাড়িতে থাকি , বাবা তিন চার মাস পর পর একবার এসে দুই সপ্তাহের মত থাকেন । বেশ সুখী এবং হাসিখুশি আমাদের পরিবার ।
একদিন সন্ধ্যার দিকে বড় আপা কলেজ থেকে এক্সট্রা ক্লাস করে বাসায় আসার সময় নিখোঁজ হয় । আমাদের কে সাথে নিয়ে মা পাগলের মত সারা সন্ধ্যা আর রাত রাস্তায় রাস্তায় হেঁটে হেঁটে আপা কে খুঁজেছে । আমাদের বাড়িটা আত্বীয় স্বজন আর পরিচিত বন্ধু বান্ধবে ভরে যায় সেই রাতে, থানায় ডায়েরি করা হয় , মা পাগলের মত কাঁদতে কাঁদতে বাবাকে ফোন করে দেশে আসতে বলে ।
বড় আপাকে নিয়ে সবার চোখে মুখে একটাই আতঙ্ক ছিল, যেটা বুঝার মত বয়সের প্রথম ধাপে তখন মাত্র পা রেখেছি আমি। শারীরিক ভাবে মেয়ে হয়ে বেড়ে উঠছি একটু একটু করে প্রতিদিন। মেয়েলি যন্ত্রণা গুলোর শুরুর প্রথম কয়েকটা মাস পার করেছি মাত্র । কিন্তু এই যন্ত্রণা যে শুধু শরীর দিয়েনা জীবন দিয়েও মোকাবেলা করতে হয় সেই ধারনা বড় আপার নিখোঁজ হবার ঘটনার মধ্যে দিয়ে শুরু হয় আমার জীবনে।
সারারাত ভয়ংকর আতঙ্কের সমুদ্রে ডুবে যেতে যেতে আমরা সবাই যখন দিশেহারা , খুব সকালের দিকে বড় আপাকে পাওয়া যায় শহর থেকে একটু দূরে একটা ঝোপের ভিতরে ক্ষত বিক্ষত অবস্থায় । পুলিশ যখন আঠারো বছরের ছিপছিপে এক তরুণীর রক্তাক্ত নগ্ন শরীর উদ্ধার করে তখনো তার শক্ত জানটা ধুঁক ধুঁক করে বেঁচে থাকার সঙ্কেত দিচ্ছিল । বড় আপা যে কতটা শক্ত এবং অফুরন্ত জীবনী শক্তি সম্পন্ন একজন মানুষ সেদিন গ্যাংরেপ হবার পরও বেঁচে থেকে সে আজ অব্দি প্রতিদিন একটু একটু করে আমাদেরকে উপলব্ধি করায়।
শরীরের অসংখ্য ক্ষত , সেলাই আর রাতের অন্ধকারে মিলিয়ে যাওয়া আট থেকে দশজন হিংস্র পশুর আঘাত নিয়ে বড় আপা যেদিন হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে আসে বাবা সেদিন শক্ত গলায় কাছের দূরের সমস্ত স্বজনদের আমাদের বাড়ি আসতে মানা করে দেয় ।আমার সহজ সরল অমায়িক বাবার এমন উদ্যত আচরণের যথেষ্ট কারণ অবশ্য ছিল । বড় আপা যে কয়দিন হাসপাতালের বিছানায় শরীর আর মনের ব্যথায় ছটফট করেছে , বাবা সেসময় দেশে ফিরে পশুগুলোকে খুঁজে বের করার জন্য প্রশাসনের দরজায় দরজায় ধর্না দিয়েছে । পশুগুলো ততক্ষণে পোশাক পালটে জনস্রোতে মিশে গেছে আর আমার নিরীহ বোনটার জীবনে আলাদা করে উপাধি যুক্ত হয়েছে “ধর্ষিতা” শব্দের !!
বাবা সেদিন ঘরে ফিরে মা কে বলতে শুনেছি, ” ধর্ষকদের গায়ে তো কোন চিহ্ন থাকেনা তাই কেউ দেখতে পায়না , কিন্তু ধর্ষিতার গায়ে ওরা দাগ ঠিকই দিয়ে যায় তাই সবাই আমার মেয়েকেই দেখছে ” !
বাবার কান্না মাখা কথাগুলো শুনে আমি আর মেঝ আপা আলোচনা করলাম, সত্যিই তো ! ধর্ষকদের চিহ্ন থাকে তাদের মনে , মনতো আর বাইরে থেকে দেখা যায়না যে পুলিশ ধরবে !! বড় আপার সাদা মনটা কেউ দেখতে পায়না কেন ! কোন দোষ না করেও কেন আমার বোনটা সারা জীবন যন্ত্রণা বয়ে বেড়াবে ? তাও আবার ধর্ষিতা হবার যন্ত্রণা !! কেন মানুষ বোঝেনা যে ধর্ষণ ধর্ষিতার অপরাধ নয় , ধর্ষকের অপরাধ !!
বাবা আমাদের বাড়ির চারপাশে বার ফুট উঁচু দেয়াল তুলে দিল , দুর্গের মত উঁচু দেয়ালের উপরে আবার কাঁটাতারের বেড়াও দিল । বিশাল ভারী লোহার গেট বানানো হল , বড় তালা ঝুলানো হল সেই গেটে । বাবার এসব কাণ্ড দেখে আমাদের তিনজনের অবাক চোখের না বলা প্রশ্নটা নিশ্চয়ই পড়ে ফেলেছিল বাবা । তাই অপরাধী গলায় হেসে সেদিন বলেছিল , ” আমার ঘরে যে মণি রত্নের চেয়েও দামী জিনিস আছেরে মা ! দামী জিনিসগুলো আমি এভাবেই নিরাপদে লুকিয়ে রাখবো ” । আমরা তিনবোন বাবার বোকা বোকা কথা আর কাজ দেখে খিল খিল করে হাসতাম ।
বড় আপার এই ঘটনার পর পর আমাদের বাড়ির বাইরে বের হওয়া একদম নিষিদ্ধ হয়ে গেল , শুধুমাত্র স্কুল ছাড়া বাড়ির বাইরে যাইনা আমি আর মেঝ আপা । বড় আপা সারাদিন বাসায় বসে বসে পড়ে । বাবা চাকুরী ছেড়ে দিয়ে একেবারে দেশে চলে আসে , দেশে এসে বাবা আরো বেশী ব্যস্ত হয়ে উঠে আমাদের কে নিয়ে । আমরা আগাগোড়া কালো বোরকায় নিজেদের ঢেকে বাবার সাথে স্কুলে যাই , বাবা বিশেষভাবে অনুরোধ করে হেডমিস্ট্রেসকে আমাদের চোখে চোখে রাখার জন্য ।
আমরা তিনজন ঠিকই মা বাবা দুজনের অস্বাভাবিক সব আচরণ বুঝতে পারতাম ।
মা মিস্ত্রি ডেকে এনে আমাদের রুমের , বাথ রুমের দরজার ভিতরের দিকের সব ধরনের খিল ভেঙ্গে ফেললো একদিন । কারণ মা র সবসময়ই মনে হত রুমের দরজা আটকে বড় আপা আত্বহত্যা করতে পারে ! সারা রাত দুজনের কেউ না কেউ পা টিপে টিপে রুমে ঢুকে দোয়া পড়ে ফু দিয়ে যেত আমাদের গায়ে ।
বাড়ির একটা রুমকে নানান ধরনের বই কিনে লাইব্রেরি বানিয়ে ফেললো বাবা ।
মা নিজের সব ধরনের ক্রিয়েটিভিটিকে কাজে লাগিয়ে ছাদটাকে ছোট খাট একটা সবুজ বন বানিয়ে ফেললো।
প্রতিদিন অনেকবার করে আমাদের মনে হতে লাগল আমরা আবারো ছোট হয়ে গেছি !! বাবা বড় এক থালায় ভাত মেখে তিন জনকে একসাথে লোকমা করে খাইয়ে দিত । সেই ভাত বাবার হাত দিয়ে অনবরত মাখানোর কারণে ঠাণ্ডা শক্ত হয়ে যেত , তবুও বাবাকে খুশি করার জন্য আমরা ঠাণ্ডা চর্বি জমে যাওয়া মাংস দিয়ে মাখানো ভাত খেতাম চুপচাপ আর নিজেরা লুকিয়ে লুকিয়ে হাসতাম। সবচেয়ে হাস্যকর যে কাজ টা বাবা করত , মাসের ভিন্ন ভিন্ন সময়ে আমাদের মুখ শুকনো দেখলে গরম পানির ব্যাগ হাতে নিয়ে রুমে ঘুর ঘুর করত কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতো না । আমরা তিন বোন হেসে কুটি কুটি হতাম । বাবা লজ্জা পেত । মা হঠাৎ হঠাৎ ছাদে পিকনিক পিকনিক আয়োজন করত । জোছনা দেখার জন্য , বৃষ্টি দেখার জন্য নতুন নতুন আইডিয়া বের করতো । শাড়ির দোকানে , জুতোর দোকানে ফোন করে বাসায় পুরো দোকান বয়ে নিয়ে আসতো । আমরা হাত ভর্তি চুড়ি পড়ে ইচ্ছেমতো রঙের শাড়ি পড়ে ছাদের বৃষ্টিতে ভিজতাম , জোছনা দেখতাম ।মা বাবা কোন ধরনের সামাজিক অনুষ্ঠানে যাওয়া একেবারেই বাদ দিয়ে দিল । আত্মীয়দের আমাদের বাসায় আসা খুব একটা পছন্দ করতেন না বাবা , যদি মুখ ফসকে কিছু বলে ফেলে কোন সময় বড় আপার সামনে এই ভয়ে ।
বাইরের দুনিয়া থেকে আমরা ধীরে ধীরে আলাদা হয়ে যাচ্ছিলাম । বড় আপার শরীরের ক্ষত সারার সাথে সাথে মনের ক্ষতটা ততদিনে অনেকটাই সেরে উঠেছে ।
এক সকালে ঘটে যাওয়া একটা অদ্ভুত ঘটনা আমাদের এই স্বেচ্ছা নির্বাসনকে ভুল প্রমাণিত করে ।
বাসার বুয়া অসুস্থ হওয়াতে উনার মেয়েকে পাঠায় ।মেয়েটা আমাদের বাড়ি আসার পথে রাস্তায় কুকুরের সামনে পড়ে খুব ভয় পায় । আমাদের বাসায় এসে সে তার ভয়ের কথা সবাইকে জানায় । মা তাকে জিজ্ঞেস করে , সে কি একা ফিরতে পারবে নাকি সাহায্য লাগবে ? মেয়েটা মা কে আত্মবিশ্বাসেের সাথেই বলে, ” কুকুরের ভয়ে কি মানুষকে ঘরের দরজা লাগিয়ে বসে থাকলে হবে ? কামড় যদি দিয়েই দেয় ওষুধ আছে না !! কুকুরের কাছে মানুষ কেন মাথা নত করবে ” ?
সেদিন ঝুপড়িতে থাকা বুয়ার সেই অশিক্ষিত মেয়েটা আমাদের চোখের সামনে থেকে বিশাল এক কালো পর্দা সরিয়ে দেয় । আমাদেরকে আলো দেখায় । বড় আপা বাবাকে বলে , সম্পূর্ণ নির্দোষ হয়েও এভাবে চার দেয়ালের ভিতরে বন্দী হয়ে থাকার মধ্যে কোন যুক্তি থাকতে পারেনা । বাবা মা আর আমরা তিনবোন একসাথে বসে ঠিক করলাম আমরা স্বাধীন ভাবে কিছু একটা করব । আমার বাবার জমানো কিছু টাকা আর মা র কিছু গয়না বিক্রি করে আমরা একটা ফ্যাশন হাউজ করি। আমরা পড়াশুনার পাশাপাশি পুরোটা সময় এই ব্যবসাতে ব্যস্ত থাকি। নিজেরা ডিজাইন করি , সুবিধা বঞ্চিত মেয়েদের কাজ শিখিয়ে কাজে লাগাই । অত্যাচারিত , ধর্ষিত , মেয়েদের মন খুলে কথা বলতে শিখাই ।
আমরা প্রচুর দুই পা বিশিষ্ট পশু দেখতে পাই আমাদের চারপাশে !! কিন্তু তারও বেশী দেখি মানুষের সংখ্যা !! মানুষ হয়ে পশুদের ভয় পেলে কি চলে ? একটা পৃথিবীতে সবাই থাকবে । সবার সাথে মোকাবেলা করেই এই পৃথিবীতে টিকে থাকতে হবে ।
-তাসলিমা শাম্মী