দহন ( প্রথম পর্ব )

এয়ারপোর্টের বাইরের খোলা অংশটায় প্রায় পনেরো মিনিট ধরে দাঁড়িয়ে আছে জহির। প্রচন্ড ঘামছে, তীব্র রোদে মাথা যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। অস্থিরতা নিয়ে শেষ পর্যন্ত হাঁটতে শুরু করল সে।

‘স্যার কি ট্যাক্সি খুঁজছেন?’

জহির পেছন ফিরে তাকাল। আনুমানিক ছাব্বিশ-সাতাশ বছরের একজন যুবক হলুদ ট্যাক্সিক্যাব ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছে, ‘মতিঝিল নিয়ে যেতে পারবে?’

মৃদু হাসল ছেলেটা, ‘আসুন।’

জানালায় চোখ রাখল জহির, ট্যাক্সি এয়ারপোর্ট এরিয়া ক্রস করতে পারেনি এখনো, মতিঝিলে বেশ নাম করা একটা হোটেল ছিল, নামটা মনে করতে পারছে না, পেছনের দিকে মাথা ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করল সে।

‘আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে, স্যার?’

‘না। ঠিক আছি এখন,নাম কি তোমার?

‘রিপন, স্যার।’

‘মোটামুটি মানের একটা হোটেলে উঠতে চাই। শহরে তোমার চেনাজানা কেমন?’

“স্যার বোধহয় অনেক দিন পর দেশে আসছেন?’

‘হ্যাঁ,প্রায় ছয় বছর।’

মতিঝিলের শাপলা চত্বরটার বাম দিকে ঘুরে ট্যাক্সি থামল। হোটেলটা বেশ পছন্দ হল জহিরের। একটু পুরনো ধাঁচের হলেও নিরিবিলি, পরিচ্ছন্ন ছিমছাম। রিসিপশনে ব্যাগ রেখে রিপন দাঁড়াল, ‘আসি স্যার।’

‘হ্যাঁ এসো। তোমার ফোন নম্বরটা দিয়ে যাও। দরকার হলে ফোন দেব, কেমন!’
রুমে ঢুকেই শুয়ে পড়ল জহির। মাথা ব্যথাটা কমেনি, রাজ্যের ক্লান্তি শরীরে, এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল সে। দরজা ধাক্কানোর তীব্র শব্দে ঘুম ভাঙল। ইউনিফর্ম পরা রুমসার্ভিস দাঁড়িয়ে। জহির বিরক্ত, ‘কিছু বলবে?’

‘স্যার, খাবার অর্ডার করবেন?’

হাত উল্টে ঘড়ি দেখল। বেলা দুইটা বাজে প্রায়! ‘হ্যাঁ ভাত দিবে, সঙ্গে সবজি, ডাল, চিকেন থাকলে চিকেন দিও। মাছ দিবে না, মাছ খাই না আমি।’ ব্যাগ খুলে কাপড় বের করল জহির, অনেক সময় নিয়ে গোসল করল সে। শরীরটা বেশ ঝরঝরে লাগছে, মাথাব্যথাও নেই এখন।

‘দুটার মধ্যে খাবারের অর্ডার দিলে ভালো, স্যার। পরে আর কিছু পাওয়া যায় না। একটা ভর্তা এনেছি।’ খাবার সার্ভ করেও দাড়িয়ে রইল ছেলেটা।

‘আচ্ছা যাও। খেয়ে নেব আমি।’

খাবার মুখে দিয়ে টের পেল প্রচন্ড ক্ষিদে পেয়েছে তার। বহুদিন পর বেশ তৃপ্তি নিয়ে খেল সে।

২.
টিভির কানেকশন দিয়ে গেছে ছেলেটা, হিন্দি চ্যানেলে গান হচ্ছে। স্বল্প বসনা একটা মেয়ে বেশ নেচে নেচে মিষ্টি গলায় গান গাইছে। শরীরের বেশিরভাগ অংশই অনাবৃত,চোখ টানে। মেয়েটার মুখটা খুব পরিচিত, নামকরা কেউ হবে। অনেক চেষ্টা করেও নাম মনে করতে পারল না জহির। আজকাল অনেক কিছুই ভুলে যায় সে,মনে করতে না পারা পর্যন্ত মাথার মধ্যে এক ধরনের ভোঁতা যন্ত্রণা হয়। প্রায় কাপড় ছাড়া মেয়েটা মাথার মধ্যে ঢুকে গেল। ঘড়ি দেখল সে, চারটা বাজে। দ্রুত কাপড় পাল্টে বাইরে বের হলো জহির, হোটেলের আশপাশে খুঁজে একটা ফোনের দোকান বের করল। ফোন করে ফুটপাতের পানের দোকান থেকে সিগারেট কিনল একটা। অবাক চোখে সে দেখতে লাগল চারপাশ, এক সময়ের অতি পরিচিত এই এলাকাটা কেমন অচেনা লাগছে।

‘সালাম স্যার।’

‘তোমার বাসা কাছে নাকি? এত তাড়াতাড়ি এলে কীভাবে?’

‘না স্যার, প্যাসেঞ্জার নামল কাছেই, তাই।’

‘আমার জরুরী কিছু জিনিসপত্র কেনা দরকার। একটা মোবাইল ফোন, সিম, নেইলকাটার, কয়েক প্যাকেট সিগারেট আর একটা রবীন্দ্র সংগীতের সিডি। ভালো কথা, তোমার ক্যাবে গান শোনার
ব্যবস্থা আছে?’

‘আছে স্যার।

‘তাহলে ভালো একটা শপিংমলে চলো।’ বেশ ঘোরাঘুরি করে অনেক কেনাকাটা করে ফেলল, জিনিস পত্রগুলি গাড়ির সিটে রাখল জহির। ছোট একটা প্যাকেট বাড়িয়ে দিলো, ‘নাও এইটা তোমার জন্য। হ্যাভক, তোমার বয়সে আমি এইটা খুব ইউজ করতাম।’

বডি ফ্রেশনারটা হাতে নিয়ে কৃতজ্ঞ চোখে তাকিয়ে রইল রিপন।

৩.
রাত নটা চল্লিশ। চুপচাপ রুমে বসে আছে জহির। আজ অনেক জায়গায় ঘোরাঘুরি করল রামপুরা, বাড্ডা, কাঁটাবন, পরিচিত বন্ধুগুলির কোনো খোঁজ পাওয়া গেল না। না পাওয়াটাই স্বাভাবিক। এই দীর্ঘ সময়ে সে কারও সঙ্গেই যোগাযোগের চেষ্টা করেনি, কে কোথায় আছে কিছুই জানে না সে।অদ্ভুত এক ক্লান্তিবোধ আচ্ছন্ন করল তাকে। সাড়ে দশটার দিকে হোটেলের ছেলেটা খাবার নিয়ে এল, জহির ডাকল তাকে, ‘শোনো, নাম কী তোমার? তোমার উিউটি কি সারাদিন, বাড়ি যাও না?’

‘না স্যার। ছয়তলার একটা রুমে আমরা কয়েকজন থাকি। আমরা প্রায় চব্বিশ ঘন্টাই সার্ভিসে থাকি। বাকি স্টাফরা অবশ্য চলে যায়। তারা শিফটিং কাজ করে। আমার নাম সোহেল।’ ছেলেটা দাঁড়িয়ে রইল, জহির তাকাল, ‘কিছু বলতে চাও?’

‘স্যার, যদি বিশেষ কিছুর প্রয়োজন হয় বলবেন আমাকে।’ কপালে ভাঁজ পড়ল জহিরের, ‘বুঝলাম না ঠিক, পরিষ্কার  করে বল ।’

‘না মানে অনেকেই এসে ডিমান্ড করেতো! তাই ব্যবস্থা রাখতে হয়। জিনিস ভালো, শিক্ষিত, খালি একটু রেট বেশি স্যার।’

জহির রাগ করতে গিয়েও হেসে ফেলল, ‘যাও তুমি। প্রয়োজন হলে বলব আমি।’

অনেক বেলায় ঘুম ভাঙল। ঘড়ি দেখল প্রায় দশটা। ঝটপট উঠে তৈরি হয়ে নিচে নেমে এল জহির। ‘অনেকক্ষণ ধরে বসে আছ, রিপন? এক্সট্রিমলি সরি। চল বের হই।’ ট্যাক্সি ইউনিভার্সিটি এরিয়ায় ঢুকল, রিপনকে নিয়ে টিএসসিতে বসল জহির। ‘শোনো, আমার বাড়ি নরসিংদী, এখান থেকে পাশ করেছি ২০০৫ সালে । তারপর দেশের বাইরে চলে যাই। কিছু বন্ধুবান্ধব ছিল আমার, কারো কোনো খোঁজ পাচ্ছি না। গতকাল তোমাকে নিয়ে আমি তাদেরকেই খুঁজেছি। এদের মধ্যে আমার একজন বন্ধু ছিল, নাম ফরহাদ হোসেন। তাকে খুঁজে পাওয়াটা জরুরী, খুব জরুরী। তার বাড়ি ছিল সাভার, বাবা স্কুল মাস্টার ছিলেন। এক ভাই এক বোন ছিল তারা, এটুকুই জানি আমি তার সম্পর্কে। ২০০৫-এর শেষের দিকে তার নামে একটা অস্ত্র মামলা হয়েছিল। বুঝতে পারছি না তাকে কীভাবে খুঁজে বের করব। আমি আমার এই কাজটা শেষ করে গ্রামের বাড়িতে যেতে চাই। তুমি কি আমাকে কোনোভাবে সাহায্য করতে পারবে? তুমি বুদ্ধিমান ছেলে। বলতো ফরহাদকে আমি কীভাবে খুঁজে বের করব?’

‘বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইল রিপন, ‘স্যার, যে থানায় কেস হয়েছিল, আমরা সেখানে খোঁজ নিতে পারি। বাড়ির ঠিকানার ডিটেল থাকবে রেকর্ডে।’

‘এটা আমিও ভেবেছিলাম কিন্তু এত বছর পর যদি আমরা এই কেসের ব্যাপারে জানতে যাই, পুলিশ প্যাঁচাবে। আমরা সাধারণ পাবলিক; বুঝতে পারছো ব্যাপারটা? বাংলাদেশের পুলিশ সম্পর্কে নিশ্চই আইডিয়া আছে তোমার? রমনা থানায় কেস হয়েছিল। ওসির নাম ছিল খোরশেদ জামান।’

‘স্যার রমনা থানায় আমার এক মামা কনস্টেবল। তাকে দিয়ে কাজ হতে পারে। দেখব?’

জহির চিন্তা করল কিছুক্ষণ ‘আচ্ছা দেখ! জাস্ট ফরহাদের বাড়ির ঠিকানাটা নিবা, তাহলেই হবে। এখনই কাজে লেগে যাও। আমি চলে যাব অন্য ট্যাক্সি ধরে।’

রিপন মাথা নাড়ল, জহিরকে পেছনে ফেলে হাঁটতে শুরু করল সে।

‘আর শোনো, এই টাকাটা নিয়ে যাও। পাঁচশত টাকার দুটো নোট এগিয়ে দিলো সে।’

‘স্যার টাকা লাগবে না। মামাকে বললে এমনিই বের করে দেবে।’

‘আরে রাখো না! বাংলাদেশে ঘরের বাইরে পেশাব করতে গেলেও টাকা লাগে। আর একান্তই যদি না লাগে তাহলে তুমি রেখে দিও।’

উদ্দেশ্যেহীন ভাবে হাঁটল কিছুক্ষণ জহির। জীবনের একটা সময় এখানেই ছিল তার সবচেয়ে ব্যস্ত পদচারণা, কত আড্ডা, কত হৈচৈ, আনন্দ! হাঁটতে হাঁটতে নীলক্ষেতের বইয়ের দোকানগুলোর সামনে চলে এল সে। ক্লান্ত লাগছে। একটা ট্যাক্সি ধরে সোজা ফিরে এল হোটেলে।

৪.
রুমসার্ভিসের ফোনটা এক নাগারে বেজে যাচ্ছে, চোখ খুলল জহির। প্রচন্ড বিরক্তি নিয়ে ফোন ধরল সে। ম্যানেজার জানাল রিসিপশনে আধঘন্টা ধরে বসে আছে রিপন। দেয়ালের ঘড়িতে সময় দেখল সে, এমন মরার মত ঘুম কখন এল কে জানে! দরজায় শব্দ হলো।

‘এসো রিপন। ঠিকানা জোগাড় করে ফেলেছো? গুড যব! দাঁড়াও এক মিনিট, ফোনে খাবারের অর্ডার দিলো জহির। দুপুরে খাওয়া হয়নি, ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ক্ষিধে পেয়েছে দারুণ! ফোনে খাবারের অর্ডার করে আরাম করে বসল জহির। ‘এখন বল বিস্তারিত।’

‘খুব খারাপ একটা খবর আছে স্যার! ২০০৫ সালের নভেম্বরে অস্ত্রমামলায় যে ফরহাদ হোসেন গ্রেপ্তার হন, সাতমাস পরে পুলিশের টর্চার সেলে তার মৃত্যু হয়। এ নিয়ে অনেক লেখালেখি হয় পেপার-পত্রিকায়। মিডিয়াতেও এ নিয়ে দারুণ হৈচৈ হয়েছে, প্রথম কদিন বেশ তোলপাড় হলেও পরে আস্তে আস্তে ঠান্ডা হয়ে যায় সব। বাংলাদেশে বরাবর যা হয় আরকি। এসবের কিছুই জানেন না আপনি?’

রুম সার্ভিস ছেলেটা খাবার নিয়ে এসেছে, সার্ভ করে চলে গেল সে। ‘খাও রিপন। এরা কাটলেটটা অসাধারণ করে। সস দিয়ে খাও ভালো লাগবে।’

রিপন খেতে শুরু করল, ‘বাড়ির ঠিকানাটা ডিটেল লিখে নিয়া আসছি।’ পকেট থেকে কাগজটা বের করে দিতে গিয়ে আঁতকে উঠল সে। জহিরের চোখ মুখ বিকৃত হয়ে যাচ্ছে, প্রচন্ড যন্ত্রণায় মানুষ যেমন কুঁকড়ে যায়, ঠিক তেমনই কুঁকড়ে যাচ্ছে সে। চিৎকার দিলো রিপন!
দিশেহারা হল ক্ষাণিকটা।

জহির হাত ইশারা করে শান্ত হতে বলল, ‘আমার খুব খারাপ একটা রোগ আছে, মাঝে মাঝে ভয়ংকর শ্বাসকষ্ট হয়। ব্যাগে একটা ইনহেলার আছে, বের কর প্লিজ! আমি কোনোভাবে এখন অসুস্থ হতে চাই না। রুমসার্ভিসকে খবর দাও।’ খুব কষ্ট করে কথগুলো বলল জহির।

ব্যাগ ওলটপালট করেও ইনহেলার খুঁজে পেলোনা রিপন। আতঙ্কে শরীর কাঁপছে তার! ব্যাগের সাইড পকেটে হাত দিয়ে বড় একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল সে, পাওয়া গেল ইনহেলার।

অনেক সময় পর চোখ খুলল জহির, শ্বাসকষ্টটা কমেছে, ঘামে শরীরটা ভিজে গেছে। ধীরে ধীরে শ্বাস নিল সে। ‘কাল খুব সকালে তুমি আসবে, এই ঠিকানায় যেতে চাই কালই। নিয়ে যেতে পারবে না?’

‘কিন্তু স্যার আপনার শরীর তো ভালো না, কাল দিনটা রেস্ট নিন। আমরা বরং পরশু যাই।’

জহির হাসল, ‘একদম ঠিক আছি। কাল সকাল নাগাদ একদম সুস্থ হয়ে যাব। এখন শুধু একটু ঘুম দরকার। তুমি বরং যাও, কাল সকালে চলে এসো তাড়াতাড়ি।’

রিপন যাবার পর খুব কড়া ডোজের একটা ঘুমের ওষুধ খেল জহির, ঘুম নেমে আসবে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই। ঠিকানা লেখা কাগজটা হাতে নিয়ে তাকিয়ে রইল, ফরহাদের মুখটা মনে করার চেষ্টা করল সে। মাথাভর্তি কোঁকড়া চুল। কানের পাশে লালচে একটা জট। চোখ ঝাপসা হয়ে আসছে ক্রমশ। ধীরেধীরে গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হলো জহির।

৫.
ট্যাক্সি সাভার এরিয়ায় ঢুকেছে দশ মিনিট, প্রচন্ড মানসিক শক্তি প্রয়োজন, অস্থিরতা কাটাতে মিউজিক প্লেয়ার অন করল জহির। কাঠফাঁটা রোদে বর্ষার গান বাজছে, “আজি ঝর ঝর মুখ বাদল দিনে”……..। চোখ বন্ধ করে মাথা এলিয়ে দিল পেছনটায়।

দশটা নাগাদ তারা পৌঁছে গেল গন্তব্যে। ফরহাদের বাড়ি খুঁজে পেতে সময় লাগল না একটুও, দাগী আসামীর পরিবার রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে যায়। আসামির মৃত্যুও এই খ্যাতি বিন্দুমাত্র কমাতে পারে না। জহির মাটির রাস্তা ধরে এগিয়ে গেল। রিপনও এলো পিছু পিছু। চারপাশে দেয়াল ওপরে টিনশেডের ছোট একচালা একটা বাড়ি। বাড়ির সামনে বৃদ্ধ একজন লোক গাছে পানি দিচ্ছেন। সালাম দিলো জহির, ‘আপনি কি মতিউর রহমান স্যার?’ ভদ্রলোকের কপালে ভাঁজ পড়ল।

‘আমি জহির আহমেদ। বাড়ি নরসিংদী।’

‘চিনতে পারছি না, বাবা। আপনি কি আমার ছাত্র ছিলেন?’

জহির পাঁ ছুঁয়ে সালাম করল। ভদ্রলোক আপ্লুত হয়ে জড়িয়ে ধরলেন , ‘কোন সালের ব্যাচ ছিলা তুমি? আসো, ঘরে আসো।’ ঘরে ঢুকে গলা তুললেন তিনি, ‘ফরহাদের মা, দেখ আমার একজন ছাত্র আসছে।’

‘আসলে চাচা আমি ফরহাদের বন্ধু, একসঙ্গে পড়তাম। দেশের বাইরে ছিলাম এতদিন,পরশু এসেছি। ফরহাদের খবরটা শুনে দেখা করতে এসেছি।’ জহির কিছুটা অপ্রস্তুত।

ফরহাদের বাবা তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ, ক্ষীণগলায় বললেন, ‘ও আচ্ছা। আর এই ছেলেটা?’

‘ওর নাম রিপন, আমার সঙ্গে এসেছে।’

‘বসো তোমরা। ফরহাদ মারা যাবার পর পর খবরের কাগজ, টিভি চ্যানেলের লোকজন খুব এসেছিল কিছুদিন। মাতামাতি করেছিল ফরহাদের ব্যাপারটা নিয়া। তারপর আস্তে আস্তে কমিয়ে দিলো আসা, একসময় পুরাই বন্ধ হয়ে গেল। গত তিনবছরে কেউই আসেনি ফরহাদের খোঁজ করতে। তাই একটু অবাক হলাম আরকি! দম নিলেন মতিউর রহমান।

‘টর্চার সেলে ছেলেটাকে মেরে ফেলল ওরা। জানতেও পারলাম না সে ও আদৌ অপরাধী ছিল কিনা। আমার ছেলেটা খুবই শান্তশিষ্ট ছিল, এসবের মধ্যে কিভাবে জড়াল কে জানে! এত টর্চার করেছে বুঝলা, লাশ যখন পেলাম আমার নিজের ছেলের চেহারা আমি চিনতে পারছিনা,বিকৃত হয়ে গেছে। সারা শরীরে কালচে লাল দাগ, খুব মেরেছে বুঝেছো! মারা যাবার আগে যদি একটা বার কথা বলতে পারতাম! জিজ্ঞেস করতাম আর কি। আমাকে মিথ্যা বলতো না ফরহাদ, ভুল করলে অবশ্যই বলতো।’ কাঁদছেন মতিউর রহমান, হালকা ছানি পড়া চোখের কোল বেয়ে অবিরাম নামছে জলধারা।

জহির উঠে দাঁড়াল,প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট হচ্ছে আবারও, মাথার মধ্যে ঝিমঝিম করছে। চোখটা ঝাপসা হয়ে আসছে ক্রমশ।

মতিউর রহমান ধরে ফেললেন তাকে, ‘আহা, এই ছেলের কী হলো!’ চোখে মুখে পানির ছিঁটা দিলেন। জহিরের পকেট হাতড়ে ইনহেলারটা খুঁজে পেল রিপন, ধরাধরি করে সামনের চকিতে শোয়ানো হলো তাকে।

সাফিয়া বেগম দরজায় ঢুকে অবাক, ‘কী হয়েছে? এরা কারা?’

মতিউর রহমান গলা তুললেন, ‘কই ছিলে এতক্ষণ? তাড়াতাড়ি একটু খাবার পানি দাও।’ ব্যস্ত হয়ে খাবার পানি নিয়ে এলেন সাফিয়া।

‘ছেলেটা আমাদের ফরহাদের বন্ধু ছিল। ফরহাদের কথা শুইনা অসুস্থ হয়ে পড়ছে। সহ্য করতে পারে নাই।’

সাফিয়ার চোখ অশ্রুসিক্ত হলো। তিনি জহিরের কপালে হাত রাখলেন। শীতল স্পর্শে চোখ খুলল জহির। মুখের ওপর ঝুঁকে থাকা এই ভদ্র মহিলা যে ফরহাদের মা বুঝতে একটুও অসুবিধা হলো না। চেহারায় কী আশ্চর্য মিল!

-নাঈমা পারভীন অনামিকা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *