হঠাৎ ফোনের শব্দে ঘুম ভেঙে গেল ফাহিমের।
পৃথিবীতে আশি শতাংশ মানুষের সবচেয়ে অপছন্দনীয় কাজ হচ্ছে সকালে ঘুম থেকে ওঠা। ফাহিম সেই আশি শতাংশ দলেরই একজন। সকালের ঘুমটা অনেক প্রিয় তার, বিশেষ করে ছুটির দিনে। যত ইমারজেন্সিই হোক না কেন, এত সকালে সে কিছুতেই চোখ খুলবে না।
বেহায়া ফোনটা একবার থেমে গিয়ে আবার বেজে উঠল। তার এই একাকী জীবনে মাঝে মাঝে ফোনের রিং-টোন শুনতে খারাপ লাগে না। কিন্তু তাই বলে এত সকালে!
অনিচ্ছাসত্ত্বেও ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখল—অপরিচিত একটা নাম্বার। যা ভেবেছিল তাই, নির্ঘাত টেলিমার্কেটারদের ফোন—ছুটির একটা সকালেও নিস্তার নেই। ফাহিম ফোন কেটে দিল। প্রয়োজনীয় কল হলে ভয়েস মেসেজ তো রাখবেই। তখন কল-ব্যাক করলেই হবে।
শনিবার সকাল। ছুটির দিনে একটু দেরি করেই ঘুম থেকে উঠে ফাহিম। কিন্তু কোনো কারণে একবার ঘুম ভেঙে গেলে সহসাই আর ঘুমিয়ে পড়তে পারে না সে। বিছানায় কিছুক্ষণ গড়াগড়ি শেষে অগত্যা উঠে গিয়ে এক কাপ ইন্সট্যান্ট কফি বানিয়ে নিয়ে এসে দাঁড়াল জানালার পাশে। পর্দা সরিয়ে তাকাল সামনের ছোট পুকুরটির দিকে। ওখানে কৃত্রিমভাবে তৈরি ফোয়ারা থেকে ঝরনার পানির ওঠানামা করছে। কফিতে চুমুক দিতে দিতে নিরবচ্ছিন্ন ভাবনায় ডুবে যায় সে।
কী কারণে হঠাৎ করেই মেয়েটির কথা মনে পড়ে তার। মনে পড়ে সেদিনের সেই রাতটির কথা। কেমন ঘোরলাগা একটা সময়—অন্যরকম ভালোলাগার কিছু অনুভূতি তাকে গ্রাস করে রাখল।
ফাহিম সেদিন লিসার ফোন নাম্বার চায়নি। লিসাও তার নাম্বার রাখেনি। উবার প্রাইভেসির নিয়মে অবশ্য একজন কাস্টমার কিংবা ড্রাইভার তাদের আসল নাম্বার দেখতে পারে না। কাজেই চাইলেও লিসার সঙ্গে আর যোগাযোগ করার উপায় ছিল না। উবার ড্রাইভারদের কত ধরনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার কথা সে শুনেছে। অনেক ভয়াবহ এবং ভয়ংকর ঘটনাও আছে। সেদিনের রাতের ঘটনাও অনেক ভয়ংকর হতে পারত। কিন্তু হয়নি। বরং একটা সুন্দর অনুভূতি নিয়ে সে ফিরে এসেছিল।
‘বিপ বিপ…’
আবারো ফোনের শব্দে ফাহিমের নিরবচ্ছিন্ন ভাবনায় ছন্দপতন ঘটল। তার ফোনটি এখনও বিছানায়, বালিশের পাশেই পড়ে আছে। ফাহিম বিছানা থেকে ফোন তুলে দেখল সেই একই নাম্বার। সে ফোনটা হাতে নিয়ে ভ্রু কুঁচকে একটু বিরক্ত হয়েই বলল, ‘হ্যালো?’
অপরপ্রান্ত থেকে রিনরিনে কণ্ঠে একটি মেয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘মে আই স্পিক টু ফাহিম প্লিজ?’
‘দিস ইজ ফাহিম। হু ইজ দিস?’
‘ক্যান ইউ গেস?’ অপরপ্রান্তের মেয়েটির মুখে রহস্যপূর্ণ হাসি।
নিমিষেই ফাহিম চিনে ফেলল। কণ্ঠটি তার পরিচিত। আসলে খুবই পরিচিত। সে নিশ্চিত হয়েই বলল, ‘তুমি আমার সেই মধ্যরাতের যাত্রী। তোমাকে ভুলি কী করে?’
মেয়েটি হেসে ফেলল। হাসতে হাসতেই বলল, ‘কেমন আছ ফাহিম?’ তার কণ্ঠে উচ্ছ্বাস ঝরে পড়ল।
‘হুম, ভালো। তুমি?’
‘ভালো না।’
‘ভালো না কেন?’
‘জানি না।’
ফাহিম চুপ করে রইল।
‘আজ বিকেলে কী করছ?’ জানতে চাইল মেয়েটি।
‘এখনো কোনো প্ল্যান নেই। কেন বলো তো?’
‘আমি দেখা করতে চাই।’
‘দেখা করতে চাও?’
‘হ্যাঁ।’
একটু ভেবে ফাহিম জিজ্ঞেস করল, ‘কিন্তু কীভাবে? এত দূর থেকে কীভাবে আসবে?’
‘তা নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না। তুমি দেখা করবে কি না বলো?’
ভেতরে ভেতরে ফাহিম উত্তেজিত হয়ে পড়ল। কেউ যেন তার কর্ণগোচরে মধুর বাণী বর্ষণ করল। এমন মধুর কথা সে যেন তার জীবনে আর কখনোই শোনেনি। ফাহিম তার উত্তেজনা চেপে বলল, ‘দেখা করব।’
‘তোমার বাসার ঠিকানাটা টেক্সট করে দাও। আর বলো ঠিক কখন আসব?’
‘তা না হয় দিচ্ছি। কিন্তু তুমি আমার ফোন নাম্বার কোথায় পেলে?’ ফাহিম অবাক হয়ে জানতে চাইল।
সেই রহস্যমাখা হাসি দিয়ে লিসা বলল, ‘ইচ্ছে থাকলে সবই সম্ভব মি।’
‘হ্যাঁ তা তো দেখতেই পাচ্ছি—তবুও জানতে চাইছি।’
‘বলব না—দেখি তুমি ভেবে বের করতে পার কি না।’
ফাহিম কিছু বলল না। গভীর চিন্তায় পড়ে গেল সে। হঠাৎ করেই সেই রাতের কথা মনে পড়ে গেল আবার। মাত্র কিছুদিন আগের কথা। এর মধ্যে লিসার কথা তার প্রতিদিনই মনে পড়েছে। কিন্তু যোগাযোগের কোনো উপায় যেহেতু ছিল না, তাই সেও আর কিছু চিন্তা করেনি। তবে লিসা যেভাবেই হোক, তার ফোন নাম্বারটা যোগাড় করে নিয়েছে, এ বিষয়টি তাকে অভিভূত করল। এবং তার বেশ ভালোও লাগল। সে মনে মনে মেয়েটির বুদ্ধির তারিফ করল।
‘কই ঠিকানাটা পাঠাও।’ লিসা তাড়া দিল।
‘এক্ষুনি পাঠাচ্ছি।’
‘সি ইউ সুন।’ বলেই লাইন কেটে দিল লিসা।
ফাহিম তার বাসার ঠিকানাটি এসএমএস করে দিল লিসার নাম্বারে। তারপর ফোনটা হাতে নিয়ে বসে রইল কিছুক্ষণ। কফির কাপে চুমুক দিয়ে নামিয়ে রাখল। কফি ঠান্ডা হয়ে গেছে অনেক আগেই। হঠাৎ সে লক্ষ করল, তার বেডরুমের চারিদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে কাপড়-চোপড়, একটা প্লেটে আধ খাওয়া এক স্লাইস পিৎজা। বিছানার চাদরটাও বদলানো দরকার। সে দ্রুতহস্তে রুমটাকে পরিপাটি করে ফেলল। ছুটির দিনে সে সাধারণত শেভ করে না। গোসলের আগে সে শেভ করে নিল। ব্লু-জিন্সের সাথে সাদা একটা টি-শার্ট ছেড়ে দিল গায়ের ওপরে। তার ফেবারিট ভার্সাসে ব্র্যান্ডের কোলন স্প্রে করে দিল সারা শরীরে। অল্প সময়ের মধ্যেই নিজেকে তৈরি করে অপেক্ষা করতে লাগল ফাহিম।
ফাহিমের এমন লাগছে কেন কে জানে? লিসার ফোন পাওয়ার পর থেকেই তার ভেতরে এক ধরনের উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। লিসার ফোন করার ব্যাপারটা তাকে ভাবিয়ে তুলল। ফোনটা কি কাকতালীয়? লিসা কি ফাহিমের মনের আকুতি অনুমান করতে পেরেছিল? কী এক অদ্ভুত কারণে ফাহিম যখন ভাবছিল লিসার কথা আর ঠিক তখনই তার ফোনটা এল। একেই কি বলে টেলিপ্যাথি?
মনের কিছু শক্তি নিশ্চয়ই রয়েছে। মানুষের অজান্তেই সেই শক্তি কাজে লাগিয়ে এমন অদৃশ্য যোগাযোগ স্থাপন করে থাকে মানুষ। ফলে যিনি মনে মনে যে মানুষকে নিয়ে ভাবছে, অজান্তেই সেই ভাবনা ক্রিয়া করছে সেই মানুষটির মস্তিষ্কে। মানুষের মন যে কতটা শক্তিশালী তা ব্যবহার না করা পর্যন্ত মানুষ কল্পনাও করতে পারবে না। লিসার কাছ থেকে এভাবে ফোন আসাটাকে কীভাবে ব্যাখা করা যায়? ফাহিম ঘড়ি দেখল। সময় যেন থমকে আছে। ফাহিমের অস্থিরতা কাটছে না কিছুতেই। সে নিজেও বুঝতে পারছে না, এমন অস্থিরইবা কেন লাগছে তার?
…
সব অপেক্ষার শেষ হয় এক সময়। ফাহিমেরও হল।
ফাহিম দাঁড়িয়ে ছিল তার অ্যাপার্টমেন্টের সামনেই। বাইরে থেকে কিছু বোঝা না গেলেও ভেতরে ভেতরে তার অস্থিরতা ছিল প্রকট। কিছুক্ষণের মধ্যেই একটি গাড়ি এসে থামল তার অ্যাপার্টমেন্টের সামনের রাস্তায়। ফাহিম দূর থেকে দেখল এক শ্বেতাঙ্গী তরুণী গাড়ি থেকে নেমে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। ফাহিম সহাস্যে এগিয়ে গেল সামনে এবং অবাক বিস্ময়ে দেখল ছিপছিপে গড়নের এক অপূর্ব সুন্দরী তন্বী তরুণীকে।
ভোরের স্নিগ্ধ আলো ছড়িয়ে শিউলি ফুলের সুরভি মেখে সকল প্রতীক্ষার অবসান ঘটিয়ে মেয়েটি এগিয়ে এল। পরনে সাদা একটি লং স্কার্ট সাথে ব্লু-টপস। কাঁধের দুপাশে ছড়িয়ে আছে সিল্কের মত সোনালি চুল। মিষ্টি গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে তার আশেপাশে।
তরুণীর নীল চোখ গাঢ় আনন্দে চিকচিক করছে। একটুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে, ধীর নিশ্চিত পদক্ষেপে সে এসে দাঁড়াল ফাহিমের সামনে—কোনোরকম জড়তা ছাড়াই জড়িয়ে ধরল তাকে। যেন কতদিনের চেনা কেউ—কত আপনজন।
ফাহিমের শরীরে যেন বিদ্যুৎ তরঙ্গ ছড়িয়ে গেল মুহূর্তেই। লিসার উষ্ণ আলিঙ্গনে মুহূর্তেই নিজেকে হারিয়ে ফেলল সে। একজনের আলিঙ্গনে কারো শরীর এমন করে ভালোলাগায় শিউরে উঠতে পারে, কারো সামান্য স্পর্শে যে এত ভালোলাগা থাকতে পারে—নতুন করে অনুভব করল সে। এই উষ্ণতার, এই ভালোলাগার কি কোনো নাম আছে?
একটু সময় পার করে লিসা নিজের আলিঙ্গন শিথিল করে সরাসরি তাকাল ফাহিমের মুখের দিকে। তাকিয়েই রইল অনেকক্ষণ। তারপর আস্তে করে, ওর বুকের মধ্যে থেকে বলল, ‘কেমন আছ তুমি?’
ফাহিমের মনে হল, এত আবেগ নিয়ে এর আগে কেউ কোনোদিন তাকে এভাবে জিজ্ঞেস করেনি। সে বলল, ‘অনেক ভালো আছি—অনেক। তুমি?’
‘আমিও অনেক ভাল আছি—অনেক। কত যে খুশি হয়েছি তোমাকে বোঝাতে পারব না। মাত্র কয়েকদিন হল অথচ আমার কাছে মনে হচ্ছে, কতদিন পরে তোমাকে দেখলাম!’ লিসার কণ্ঠে উচ্ছ্বাস ঝরে পড়ল।
সাভানার আকাশে কনকনে রোদ। অথচ দুপুরের এই তীব্র রোদের মধ্যেই হঠাৎ আকাশ ভেঙে এক পশলা বৃষ্টি নেমে এল। ভিজে যাবার আগেই ফাহিম লিসার হাত ধরে দৌড়ে গিয়ে ঢুকে পড়ল তার অ্যাপার্টমেন্টের ভেতরে।
রুমে ঢুকে লিসা সব ঘুরে ঘুরে দেখল। দেওয়ালে টাঙানো দুটো পোস্টার—একটা বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমের আর একটি জাতীয় স্মৃতিসৌধের। দুটো পোস্টারেই বড়ো বড়ো অক্ষরে লেখা—বাংলাদেশ। লিসা ঘুরে তাকাল ফাহিমের দিকে। কৌতূহলী দৃষ্টি নিয়ে বলল, ‘সো ইউ আর ফ্রম বাংলাদেশ?’
‘ইয়েস। হোয়াই?’
‘আমি ভেবেছিলাম তুমি ইন্ডিয়ান।’
‘অনেকে তাই ভাবে। দেখতে আমরা অনেকটা একই রকম।’
‘এশিয়ানরা খুব দয়াল প্রকৃতির হন। এছাড়াও তারা খুব বিশ্বাসী হয়। জীবনের যে কোনো সময়ে পাশে পাওয়া যায়।’
লিসার কাছে থেকে এশিয়ানদের সম্পর্কে এমন উচ্চধারনা শুনে এবং নিজেকে এশিয়ান গোত্রের একজন হিসেবে বেশ গর্ব অনুভব করল ফাহিম। কিঞ্চিত অবাক হয়েই সে জানতে চাইল, ‘তুমি কী করে জানো?’
‘জেনেছি।’ মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়াল লিসা। বাইরে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি ঝরছে। বৃষ্টির ঝাপটায় জানালার কাচে ফোঁটা ফোঁটা জলের বিন্দু ভিড় করছে। জানালার কাচের আঁকিবুকি ভেদ করে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইল সে।
ফাহিম লিসার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। তার দৃষ্টি অনুসরণ করে সেও তাকাল বাইরে। লিসা মাথাটা এলিয়ে দিল ফাহিমের দিকে। ফাহিম হাত বাড়িয়ে কাছে টেনে নিল তাকে। দুজনেই বাইরে বৃষ্টি পড়ার দৃশ্য দেখতে লাগল।
লম্বা একটা বিরতি দিয়ে ফাহিম বলল, ‘আমাদের কিন্তু বাইরে লাঞ্চ করার কথা। খিদে পেলে জানাবে।’
‘খিদে পেয়েছে তবে অন্য কিছুর।’ ফাহিমের দিকে না তাকিয়েই লিসা কথাটা বলল এবং মিটিমিটি হাসতে থাকল।
ফাহিম চকিতে তাকাল লিসার মুখের দিকে।
‘বৃষ্টির মধ্যে বাইরে যেতে চাচ্ছি না।’ লিসার মুখে দুষ্টুমির হাসি।
ফাহিমেরও বাইরে যেতে ইচ্ছে করছে না। অন্য কোনো সময় হলে এই বৃষ্টির দিনে সে নির্ঘাত তার প্রিয় খাবার নিজেই বানিয়ে নিত। হঠাৎই ফাহিমের মনে হল, আচ্ছা খিচুড়ি রান্না করলে কেমন হয়। সাথে ডিমভাজি। যেই ভাবা সেই কাজ। ফাহিম বলল, ‘আমি তোমাকে একটা মজার আইটেম রান্না করে করে খাওয়াব। আমার খুবই প্রিয়।’
‘কী সেটা?’
‘খিচুড়ি।’
লিসা ভ্রু কুঁচকে তাকাল। এমন কোনো খাবারের নাম সে তার জীবদ্দশায় শুনেছে কি না সে মনে করতে পারল না। জ্যাকসনভিলে একবার একটা ইন্ডিয়ান রেস্টুরেন্টে সে গিয়েছিল ব্র্যাডের সঙ্গে—কিন্তু এমন কোনো নামের ফুড আইটেম তার চোখে পড়েছে বলে মনে হয় না। ব্র্যাডের কথা মনে হতেই লিসার চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। ব্র্যাডের ব্যাপারে সে ইতোমধ্যেই হার্ডলাইন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে—যতদিন বেঁচে থাকবে, ব্র্যাডের কোনো স্থান তার জীবনে আর কোনোদিনও হবে না—তার ব্যাপারে সে হাত পা ঝেড়ে ফেলেছে। লিসার অফলাইন-অনলাইন সব জীবন থেকেই তাকে ব্লক করা হয়েছে।
‘এ বস্তুর নাম কোনোদিন শুনেছি বলে মনে হয় না।’ বলল লিসা।
ফাহিম মনে মনে দ্রুত খিচুড়ির ইংরেজি কী হবে চিন্তা করতে লাগল, কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারল না। সে বলল, ‘এটাকে ইয়েলো রাইসও বলতে পার। ইটস অ্যা কম্বিনেশন অফ রাইস, লেন্টিল, ওনিয়ন, গার্লিক, গ্রিন চিলি, টারমারিক পাউডার অ্যান্ড সল্ট মিক্সড উইথ মাস্টার্ড অয়েল। সাথে থাকবে ফ্রাইড এগস আর ম্যাঙ্গো চাটনি। খেতে অসাধারণ। তুমি ট্রাই করে দেখতে পার।’
‘সাউন্ডস রিয়েলি ইয়ামি। আমার তো এখনই খেতে ইচ্ছে করছে।’
‘আমরা বাঙালিরা, বৃষ্টি হলেই খিচুড়ির আয়োজন করি। এটা অনেকটা ট্র্যাডিশনাল হয়ে গেছে।’
‘তাই? ইন্টারেস্টিং। কিন্তু বৃষ্টির সাথে খিচুড়ির কী সম্পর্ক?’
বৃষ্টির সাথে খিচুড়ির কী সম্পর্ক সেটা ফাহিম নিজেও জানে না। কখনো ভেবেও দেখেনি। হঠাৎ তার মনে হল, আসলেই তো! কীসের সম্পর্ক? এই সম্পর্কের বৈজ্ঞানিক, মনস্তাত্ত্বিক বা শরীরবৃত্তীয় ব্যাখ্যা কী? সম্পর্ক যা-ই হোক—আকাশ কালো মেঘে ঢাকলেই তার মন বলে ওঠে—আজ খিচুড়ি হয়ে যাক। শেষ অবধি হয়তো দেখা গেল যে বৃষ্টিটাই হল না, এদিকে খিচুড়ি খাওয়া শেষ।
ফাহিম মনে মনে হেসে ফেলল। লিসা অবাক হয়ে তাকাল। ফাহিম মাথা ঝাকাল, ‘কিছু না।’
লিসা হাসল। তার চোখে মুখে দুষ্টুমি। তাকাল ফাহিমের চোখের দিকে। কিছু বলল না। ফাহিমও অবাক চোখে তাকাল। তাকিয়েই রইল। কারো মুখে কোনো কথা নেই—শুধু চেয়ে থাকা।
মাঝে মাঝে চুপ করে কারো দিকে চেয়ে থাকলে চোখ অনর্গল এত কথা বলে যে, সে সময় মুখে কিছু বলতে ইচ্ছে করে না। কলম কিংবা মুখের ভাষা কোনোদিনও বোধ হয় চোখের ভাষার সমকক্ষ হতে পারবে না।
‘কী দেখছ অমন করে?’ মিষ্টি হেসে লিসা জানতে চাইল।
‘তোমাকে।’ বলল ফাহিম।
‘কী মনে হচ্ছে?’
‘মনে হচ্ছে, এই মেয়েটির চোখের দিকে তাকিয়ে যে কোনো ছেলে বছরের পর বছর কাটিয়ে দিতে পারবে।’
‘তুমি পারবে?’
‘হুম।’
‘ভেবে বলছ?’
‘হ্যাঁ।’
‘চল, তোমার বেডরুমটা দেখব।’
‘বেডরুমে কী?’ অবাক চোখে বলল ফাহিম।
লিসা ফাহিমের হাত ধরল। ‘সেটা গেলেই বুঝতে পারবে।’ বলেই সে ফাহিমকে টেনে নিয়ে গেল তার বেডরুমে। বেডরুমের একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে একটি ডাবল সাইজ বেড। সুন্দর পরিপাটি করে পাতা। রুমে ঢুকে চারিদিকে চোখ বুলিয়ে লিসা বলল, ‘আজ রাতটা যদি তোমার এখানে থেকে যেতে চাই, থাকতে দেবে আমায়?’
‘হ্যাঁ দেব। শুধু আজ কেন, যতদিন ইচ্ছে থাকতে পার।’
হঠাৎ কী হল লিসার কে জানে। সে কেমন অন্যমনস্ক হয়ে পড়ল। ফাহিমের হাত ছেড়ে দিয়ে সে বিছানার এক কোনায় চুপ করে বসল। ফাহিম দাঁড়িয়ে রইল—চুপচাপ।
‘এই ক’টা দিন আমি ব্র্যাডকে ভুলে ছিলাম তোমার কথা ভেবে। ব্র্যাডের অপমান আমি ভুলে ছিলাম তোমার কথা ভেবে। আমি ঘুমাতে যেতাম তোমার কথা ভেবে। আমার ঘুম ভাঙত তোমার কথা ভেবে। তুমি ছিলে আমার সমস্ত দিনে। সমস্ত সময়ে।’
ফাহিম অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে রইল লিসার মুখের দিকে।
‘অবাক হচ্ছ?’ লিসা আবার জিজ্ঞেস করল, ‘আমার এমন কেন হল বলতে পার?’
ফাহিম কোনো জবাব দিতে পারল না। কী বলবে সে। সে নিজেই বা কী জানে। সে নিজেও লিসাকে মিস করেছে, মনে মনে চাইছে দেখা হোক আবার। একবার হুট করে চলে গিয়ে লিসাকে সারপ্রাইজও দিতে চেয়েছিল সে। এ ক’দিন মেয়েটিকে নিয়ে কল্পনার জাল সে-ই বা কম বুনেছে? আবার, লিসাও তাকে মিস করেছে। এসবের মানে কী? এটা কি ভালোবাসা? প্রেম? এর কী ব্যাখ্যা?
ফাহিম লক্ষ করল লিসার চোখ ভেজা। আশ্চর্য! মেয়েটি কাঁদছে কেন? ফাহিম লিসার পাশে গিয়ে বসল—পরম যত্নে ওর একটা হাত টেনে নিল নিজের হাতে।
লিসা তাকাল ফাহিমের দিকে—গাঢ় দৃষ্টিতে বোঝার চেষ্টা করল কিছু। এক অবরুদ্ধ, অশ্রুরুদ্ধ নারীসুলভ কামনায় ওর সমস্ত শরীর থরথর করে কেঁপে উঠল।
তারপর হঠাৎ কী হল কে জানে, ফাহিম কে আলত করে বিছানায় ফেলে দিয়ে কি এক উষ্ণতার সঙ্গে তার ঠোঁট ছোঁয়াল ফাহিমের ঠোঁটের সঙ্গে।
…
দুপুরে ঝটপট খিচুড়ি রান্না করে ফেলল ফাহিম। লিসা আগ্রহ নিয়ে দেখল ফাহিমের রান্না। কী এক অদ্ভুত কারণে মেয়েটি সারাক্ষণ ছটফট করছে। এক ধরনের ভালোলাগায় বুদ হয়ে আছে তার শরীর মন। এক নাগাড়ে একা একাই কথা বলে যাচ্ছে সে।
‘আমি এভাবে চলে আসায় তুমি নিশ্চয়ই অবাক হয়েছ, তাই না?’
‘অবাক হব না? এভাবে তুমি দেখা করতে আসবে, এটা আমি কল্পনাও করিনি।’
‘না এসে কী উপায় বল? তুমি বিশ্বাস করবে কি না জানি না, ব্র্যাডের সঙ্গে ব্রেকআপের চেয়েও বেশি কষ্ট হচ্ছিল তুমি চলে আসার পর থেকে।’
ফাহিম অবাক হয়ে তাকাল।
‘এত সহজেই তোমাকে পেয়ে যাব, তা অবশ্য আমার ধারণা ছিল না। তবে আমি জানতাম, কোনো না কোনো ভাবে আমি তোমাকে খুঁজে বের করবই।’
‘তুমি কিন্তু এখনো বললে না।’
‘কী?’
‘আমার ফোন নাম্বার কোথায় পেলে?’
‘খুবই সহজ। উবারের লস্ট এন্ড ফাউন্ডে দিন-তারিখ-সময় দিয়ে বললাম, ওইদিন মধ্যরাতে আমাকে যে রাইড দিয়েছিল, সে আমার অতি মূল্যবান একটি জিনিস নিয়ে গেছে ভুলে—সেটি আমি ফেরত চাই।’
‘কি! তুমি কি কিছু ফেলে গেছ গাড়িতে?’ ফাহিম দ্রুত চিন্তা করে নিল। সে তো এর মধ্যে গাড়ি পরিষ্কার করেছে—কিছু চোখে পড়েছে বলে মনে হল না। সে বলল, ‘কই কিছু দেখিনি তো।’
‘দেখবে কী করে? ওটা তো তোমার গাড়িতে নেই।’
‘তাহলে?’
লিসা উঠে গিয়ে দাঁড়াল ফাহিমের সামনে। ফাহিমের বাম বুকের ওপর তর্জনী দিয়ে টোকা দিয়ে বলল, ‘এখানে আছে। ইউ স্টোল মাই হার্ট।’ লিসা এবার ফাহিমের বুকে নিজের কান লাগিয়ে বলল, ‘আই ক্যান হিয়ার দ্য বিট। ইট’স স্টিল দেয়ার।’
ফাহিম ভাষা হারিয়ে ফেলল। আবেগে তার চোখ দুটো আর্দ্র হয়ে এল। মাঝে মাঝে অনেক সুস্থ শরীরও কিছু আবেগ সহ্য করার শক্তি হারিয়ে ফেলে।
…
দেখতে দেখতে শনিবারের বিকেল, সন্ধ্যা, রাত এবং পরেরদিন রবিবারের অর্ধেকটা দিন চোখের নিমিষেই যেন পার হয়ে গেল। এদিকে লিসার ফিরে যাবার সময়ও হয়ে এল। দুপুর পেরিয়েছে অনেক্ষণ হলো—দিনের আলো থাকতে থাকতেই তাকে ফিরে যেতে হবে। আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে পরিপাটি করছিল লিসা। ওর চুল, ওর চোখ, ওর নাক, ওর কান, ওর দাঁত, ওর হাতের আঙুল, ওর পায়ের পাতা সব কিছুর মধ্যে এমন একটা পরিচ্ছন্ন দীপ্তি যে ফাহিম অপলক চেয়ে রইল লিসার দিকে।
হঠাৎ চোখে তুলে লিসা বলল, ‘কী দেখছ?’
‘তোমাকে!’
‘এখনো দেখা শেষ হয়নি? এখনো কি সন্দেহ আছে? দ্বিধা আছে আরও?’
‘জানি না।’
‘তবে এভাবে তাকিয়ে আছ কেন?’
‘তৃপ্তি মিটছে না—কী করব?’
‘কী করলে তৃপ্তি মিটবে?’
‘জানি না।’
একটুক্ষণ চুপ থেকে লিসা বলল, ‘আমার না একেবারেই যেতে ইচ্ছে করছে না।’
ফাহিম হেসে দিয়ে বলল, ‘থাকো না—কে যেতে বলল তোমাকে?’
লিসা ঘুরে দাঁড়াল। গাঢ় কণ্ঠে বলল, ‘আমি তোমার জীবনের একটা অংশ হয়ে থাকতে চাই—আমায় জায়গা দেবে একটু?’ বলতে বলতে লিসার চোখ ভিজে এল।
ফাহিম ওকে দু’হাতে কাছে টেনে নিল। লিসা ফাহিমের বুকে মুখ রেখে দাঁড়িয়ে রইল চুপচাপ। দুজনার মন কী এক আশ্চর্য কী এক অপ্রকাশ্য রোমাঞ্চকর উষ্ণতায় ভরে গেল।
লিসার আর্দ্র চোখে কী দারুণ এক খুশি ঝিলিক দিয়ে উঠল। মুহূর্তেই ওর চেহারার সব বিষাদ সরে গেল। লিসা ফাহিমের চোখের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসল। ফাহিম ফিরিয়ে দিল এক নির্ভরতার হাসি।
…
লিসাকে তার গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিতে হেঁটে এল ফাহিম। লিসা মুখ নিচু করে হেঁটে এল। কিছুই বলল না। গাড়ি পর্যন্ত এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল দুজনেই। কোনো কথা খুঁজে না পেয়ে ফাহিম বলল, ‘আবার কবে আসবে?’
‘তু্মি যেদিন আসতে বলবে। তবে এমন করে একদিনের জন্যে নয়—অন্তত কয়েকদিনের জন্যে আসব।’
‘একেবারেই চলে আস না?’
‘যখন আমাকে বাংলাদেশে নিয়ে যাবার জন্যে তৈরি হবে—তখনই আসব। একেবারে। রাতে যেসব কথা হয়েছে মনে থাকবে তো, না?’
‘অবশ্যই মনে থাকবে।’
লিসা তাকাল আকাশের দিকে। বিকেলের রোদ পশ্চিমাকাশে হেলে পড়েছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও সে বলল, ‘এবার যাই।’
‘এসো।’ অস্ফুটে বলল ফাহিম।
লিসা ফাহিমকে দ্রুত একটা হাগ দিয়ে উঠে পড়ল গাড়িতে। দেরি না করে গাড়িটা ছেড়ে দিয়ে ধীরে ধীরে বের হয়ে গেল অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স থেকে।
লিসার গাড়িটি দৃষ্টির আড়ালে চলে যাওয়ার পরেও অনেকক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল ফাহিম। লিসার সঙ্গে ফাহিমের অনেকখানি অশরীরী ফাহিমও উধাও হয়ে গেল।
(সমাপ্ত)
©ফরহাদ হোসেন
লেখক-নির্মাতা
ডালাস, টেক্সাস
ইউএসএ