একাকিত্ব

লোকটার ঘরে ঢুকেই ব্যাগের মধ্যে থেকে ছোট্ট আয়না বের করে নিজের লিপস্টিক ঠিক করে নিলো বিন্দু।চোখে একটু কাজল দিতে পারলে ভালো হতো। কিন্তু ব্যাগের ভিতরের সমস্তটা খুঁজেও কোথাও কাজল খুঁজে পেলো না। কাজটা যে অনুর সেটা আর বলতে হবে না। অনু ছাড়া বিন্দুর ব্যাগে হাত দেয়ার সাহস কারো নেই। বাসায় গিয়ে অনুকে আজ কিছু একটা বলা উচিৎ। দিনকে দিন মেয়েটার সাহস বেড়েই চলেছে।

~ আপনি কিছু নিবেন?

লোকটার কথা শুনে বিন্দুর চিন্তায় ছেদ পড়লো। হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে পড়ায় ও একটু সময় নিয়ে বললো, “একগ্লাস পানি যদি দিতেন “।

লোকটা চলে গেলে বিন্দু ঘরের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিলো। আধুনিকতার ছোঁয়া লেগে আছে ঘরের দেয়ালে। ঘরে ঢুকতেই বামপাশে একজোড়া সোফা। সাথেই একটা টি টেবিল। ডানপাশে মাঝারি সাইজের একটা বিছানা তাতে শোভা পাচ্ছে ধবধবে সাদা চাদর আর তার ঠিক সামনের দেয়ালে বিশাল সাইজের একটা টিভি। মাথার উপরে সোনালী রংয়ের ফ্যান। চারপাশে দেয়ালে অসংখ্য পেইন্টিং। দেখলেই বোঝা যায় খুব যত্ন করে ঘরটা সাজানো হয়েছে। বিন্দু মনে মনে ভাবলো লোকটার রুচি আছে। বিছানার সাথেই লাগানো ছোট্ট একটা বুকশেলফ। বিন্দু সেখান থেকে বুদ্ধদেব গুহের বাবলি বইটা তুলে নিলো। খুব ছোট বেলায় যখন ও বইটা প্রথম পড়েছিল তখন থেকেই মনে মনে ও বাবলি হতে চাইতো। খুব অদ্ভুত একটা ভাললাগা কাজ করতো বাবলির জন্য। কিন্তু সত্যি কি ও বাবলির মতো হতে পেরেছে?

ইতিমধ্যে লোকটা হাতে একটা পানির গ্লাস নিয়ে হাজির হয়েছে। বিন্দু হাত বাড়িয়ে পানির গ্লাসটা মুখে দিতেই লোকটা বললো ” আপনার পেমেন্ট কতো”?

বিন্দু এক নিশ্বাসে পানি টুকু শেষ করে জবাব দিলো দুই হাজার টাকা।

লোকটা পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করে সেখান থেকে এক হাজার টাকার দুইটা নোট বের করে বিন্দুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো ” আপনার পেমেন্ট টা রাখুন। আপনি এবার আসতে পারেন”।

বিন্দু অবাক হয়েই প্রশ্ন করলো ” আসবো মানে”?

লোকটা কিছুটা রাগ নিয়েই উত্তর দিলো ” পেমেন্ট পেয়েছেন যখন তখন যেতে অসুবিধা কি?”

বিন্দু ইতস্ততভাবে বললো “খুব বেশিদিন হবে না এই লাইনে আশা আমার। বাবা মারা যাবার পর আম্মা প্যারালাইজড হয়ে যায়। সংসার চালানোর দায়িত্ব এসে পরে আমার উপর। দুইবোন আর একভাইকে পড়াশোনা করাবার জন্য চাকরি যথেষ্ট ছিল না। তাই এই লাইনে নামি। কিন্তু এ কদিনে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তাতে আপনার কথা শুনে খানিকটা অবাক না হয়ে পারলাম না।

~লোকটা বলল” এখানে অবাক হবার কি আছে?”

বিন্দু এবার কিছুটা হেসেই বললো “সবাই যেখানে সামান্য কটা টাকার বিনিময়ে এই শরীরটা ছিঁড়ে খায় সেইখানে আপনার এমন ব্যবহার অবাক করার মতো নয় কি”?

~এবার লোকটা বললো” আপনি একটু বসুন। আপনার জন্য চা নিয়ে আসি”।

বিন্দু আবার বইটার খুব পরিচিত লাইন গুলোতে চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিল। একটার পর একটা পাতা উল্টাচ্ছে আর দেখছে। কিন্তু মনে মনে লোকটা সম্পর্কে ভেবে কিছুটা আশ্চর্য না হয়ে পারছে না। এমন অদ্ভুত লোক সে কখনো দেখেনি। লোকটা চা নিয়ে এসে বিন্দুর হাতে দিয়েই বললো ” আমার নাম আলিফ। খুব অল্প বয়সে আমি দৃষ্টির প্রেমে পড়ি। আমাদের আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকায় ওর পরিবার আমাদের মেনে নিলো না। এজন্য আমরা পালিয়ে বিয়ে করে শহরে চলে আসি।কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই এই শহরের বাস্তবতা বুঝে যাই। টাকা ছাড়া এই শহরে টিকে থাকা যখন কঠিন হয়ে উঠলো তখন ছুটে চললাম অর্থের পিছু।

প্রকৃতিতে কাউকে আপন করতে গেলে কাউকে না কাউকে দূরে সরিয়ে রাখতে হয়। আমিতো আর প্রকৃতির বাইরের নই। দিন কে দিন দৃষ্টির সাথে আমার দূরত্ব বাড়তে থাকে। আমরা একি বিছানায় থাকতাম। কিন্তু আমাদের শরীর মন থাকতো আলাদা। সময় আমাদের মাঝে দূরত্ব তৈরি করে দিলো। একদিন দৃষ্টির সাথে প্রচন্ড ঝগড়া হয়। ও মাঝরাতে আমাদের একমাত্র সন্তান সন্ধি কে নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। সেদিন ব্যবসার কোনো একটা কাজ নিয়ে আমি খুব চিন্তিত ছিলাম। তারমধ্যে দৃষ্টির সাথে ঝগড়া করে মাথা অনেক গরম হয়ে উঠলো। বাঁধা দিলাম না ওকে। মনে মনে ভাবলাম রাগ কমে গেলে হয়তো ফিরে আসবে। কিন্তু আমার ধরনা কে ও ভুল প্রমাণ করে দিয়ে একবারে না ফেরার দেশে চলে গেলো। আর ফিরে এলো না”।

বিন্দু চমকে উঠে বললো ” মানে কোথায় গেলো দৃষ্টি”?

পরদিন সকালে একটা ফোন এলো শাহবাগ থানা থাকে। ফোনের ওপাশ থেকে বললো ” রাস্তায় এক্সিডেন্ট গতরাতে দুইজন নিহত হয়েছে। আমরা ধারণা করছি নিহত দুইজন আপনার পরিচিত কেউ। আপনি একবার থানায় আসুন। একমুহূর্তে সবকিছু উল্টাপাল্টা হয়ে গেলো। ভেঙ্গে গেলো আমার সাজানো সংসার। একা হয়ে গেলাম। যার হাত ধরে এই শহরে পালিয়ে এসেছি সেই হাত দলছুট হয়ে গেলো। বলতে বলতে লোকটা কেঁদে উঠলো।

আজ আমার মেয়ে সন্ধির জন্মদিন। প্রত্যেকবার যখন ওর জন্মদিন আসে তখন আমি প্রচন্ড একাকিত্বে ভুগি। আমার ব্যস্ততা আমার স্ত্রী কন্যাকে আমার থেকে দূরে সরিয়ে দিয়েছে। এখন আমার কাছে অফুরন্ত সময় আছে। অথচ ওরা নেই। বলেই লোকটা আবারো হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।

বিন্দু লোকটাকে সান্তনা দেওয়ার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। কখন যে ওর নিজের চোখের কোণে পানি এসেছে ও নিজেও জানে না।

লোকটা নিজের চোখ মুছে বিন্দুকে বললো ” আপনি কিছু মনে করবেন না। আমার একাকিত্ব দূর করার জন্য আপনাকে ডেকেছিলাম। একা একা মানুষ তো। সময় যেতে চায় না আসলে। আপনি এবার যেতে পারেন। আমি একটু একা থাকতে চাই।

বিন্দু কোনো কথা না বাড়িয়ে ঘর থেকে বের হয়ে এলো…….।

পরদিন সকালে নিচে হইচই শুনে আলিফ সাহেবের ঘুম ভেঙ্গে গেলো। সকাল সকাল নিজ থেকে হইচই শুনে আলিফ সাহেব কিছুটা অবাক না হয়ে পারলেন না। নিজেই নিচে গিয়ে দেখলেন অনেকগুলো পথশিশু দিয়ে নিচতলা গিজগিজ করছে। দারোয়ান একা একা ওদের সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। আলিফ সাহেব দারোয়ান কে ডেকে বলল” ব্যাপার কি? এতো বাচ্চাকাচ্চা এলো কোথায় থেকে?

দারোয়ান আমতা আমতা করে বললো ” কাল রাতের ম্যাডাম সকালবেলা এসেছিল। তিনি একটা কেক এবং অনেকগুলো বিরিয়ানীর প্যাকেট আর এসব বাচ্চাগুলো নিয়ে এসে আমাকে বলেছে সাহেব উঠলে বলবে নিজ হাতে কেক কেটে বাচ্চাদের খাওয়াতে”। আর আপনার জন্য একটা চিঠি দিয়ে গেছে।কেকের উপর নামটা দেখে আলিফ সাহেবের চোখ ছলছল করে উঠলো। “হ্যাপি বার্থডে সন্ধি”। তিনি নিজ হাতে কেক কেটে একে একে বাচ্চাদের খাইয়ে দিলেন। একমুহূর্তের জন্য মনে হলো তার মেয়ে আসেপাশে কোথাও থেকে ওর উনার দিকে তাকিয়ে আছে। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে বাবা ঠিকমত সবাইকে খাওয়াচ্ছে তো!

ঘরে এসে আলিফ সাহেব চিঠিটা খুললেন। চিঠিতে লেখা……

“প্রথমে কাল রাতে ওভাবে চলা আসার জন্য মাফ চেয়ে নিচ্ছি। আপনি হয়তো বিশ্বাস করবেন না কাল রাতে আমিও ঘুমতে পারিনি। বারবার আপনার মেয়ের কথা ভাবছিলাম। সকালবেলা এক অদ্ভূত স্বপ্ন দেখলাম। স্বপ্নে দেখলাম একটা মেয়ে এসে বলছে ” আজ আমার জন্মদিন। তোমরা কি আমার জন্য কেক কাটবে না? আমার বন্ধুদের খাওয়াবে না”? স্বপ্ন দেখেই চমকে উঠলাম। তারপর এসব নিয়ে গিয়ে আপনার দারোয়ান কে দিয়ে এসেছি।আশাকরি আপনি রাগ করেননি।

মাঝেমাঝেই আমরা একা হয়ে যাই। একাকিত্বে ভুগি। চারপাশ তাকালে অন্ধকার হয়ে আসে। অথচ আমরা ভুলে যাই আমাদের থেকেও খারাপ অবস্থায় কেউ আছে। মানুষের কাছে যান। তাদের সাথে গভীরভাবে মিশুন। একাকিত্ব কেটে যাবে। সত্যি কথা বলতে আপনি একা হয়ে গিয়েছেন। আর একাকিত্ব মানুষকে তিলে তিলে শেষ করে দেয়। চারপাশে ছড়িয়ে থাকা মানুষের সাথে একাকিত্ব গুলো ভাগাভাগি করে নেন দেখবেন আস্তে আস্তে একাকিত্ব কেটে যাবে। মাঝে মাঝে আমরা জীবনের রঙ হারিয়ে ফেলি। ঠিক সেই সময়ে অন্যের রঙে নিজেকে রাঙিয়ে নেওয়ার প্রয়োজন হয়। ভালো থাকবেন।

ইতি
বিন্দু

-রিফাত আহমেদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *