একটি অমিমাংসিত রহস্য ( ৯ম পর্ব )

সালে ঘুম ভাঙ্গলে এককাপ চা নিয়ে পুরো বিষয়টা শুরু থেকে ভাবতে শুরু করলো রাজিব। এক, এই এলাকায় গত আট মাসে চারটে খুন, দুটো গুম আর এখন রানার হত্যাকান্ড সব মিলিয়ে কিসের ইংগিত। দুই, তার পুলিশ অফিসার বলেছিল চেয়ারম্যানের নাম মাহবুবুর রহমান কিন্তু গতকাল রাতে তিনি বললেন রাইয়ান মাহমুদ, কেনো? তিন, গত তিন টার্মের চেয়ারম্যান তিনি অথচ পুলিশ অফিসার বললেন তিন বছর ধরে আছেন, কেনো? আরেকটা ব্যাপার সে খবর নিয়ে জেনেছে প্রথমবার যখন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন তখন তার বাড়ী সংস্কার করা হয়নি। ২য় বার নির্বাচিত হওয়ার পরই তিনি ইউ এস এ যান এবং ফিরে এসে বাড়ী সংস্কার করা শুরু করেন। গত দশ বছরে তিনি কয়েকবারই আমেরিকায় যাওয়া আসা করেছেন।

যে চারজন লোক খুন হয়েছে তার মধ্যে শেষের দুজন মাটি কাটা বা গাছ গাছালি কাটার কাজ করতো। এদের লাশও পাওয়া যায় একই ভাবে উপুড় হয়ে পড়া অবস্হায়।
তার জুনিয়র পুলিশ অফিসার ও লোকাল সাংবাদিক স্রেফ গায়েব হয়ে গিয়েছে। এদের কোনো হদিস এখনও কেউ বলতে পারেনি।

আজ বাগানের যে অংশটা ইন্ডিয়ার বর্ডারে গিয়ে লেগেছে সে অংশটা ঘুরে আসতে হবে ভাবলো রাজিব। তবে একা যাওয়া ঠিক হবে না। মারুফকে বলে সাথে করে কাউকে নিয়ে যেতে হবে।

চা শেষ করে উঠলো রাজিব, সুরেন্দ্রকে গোসলের পানি দিতে বল্ল। গোসল সেরে, নাস্তা খেয়ে থানার দিকে রওয়ানা দিল। বাগানের এরিয়া ছাড়তেই লাল মাটির রাস্তা ওটা পেরুলেই পাকা রাস্তা শুরু। ঠিক করলো আজ কিছুসময় উদ্দেশ্য বিহীন ভাবেই ঘোরাফেরা করবে। বলা যায় না কোনো ক্লু হয়তো সামনে চলে আসতে পারে। এই এলাকাটা এমনি খুব সুন্দর ও নিরিবিলি। বরাবর ঢাকায় বসবাস করা রাজিবের কাছে আরও বেশীই নির্জন মনে হয়। কোনো গাড়ীঘোড়ার আওয়াজ নেই, নেই মানুষজনের কোলাহল। মাঝে মাঝে দু চারটে সাইকেল, রিক্সার টুংটাং শব্দ ছাড়া তেমন কোনো যানবাহনও চোখে পড়ে না। হাঁটতে হাঁটতে কি মনে করে একটি গাছের নিচে দাড়ালো রাজিব। কি গাছ এটা ? গাছপালা খুব একটা চেনেনা রাজিব। হঠাৎ একটা ডালে তার চোখ আটকে গেলো লাল একটা গোল চিহ্ন দেখে। পাশে খুবই ছোট করে খোদাই করে একটা তীর চিহ্ন দেয়া। কি কৌতুহলে তীর চিহ্ন নির্দেশিত পথে হাঁটতে লাগলো রাজিব। বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর আরেকটা গাছ পাওয়া গেলো একই চিহ্ন দেয়া তবে এটাতে দুটো লাল গোল চিহ্ন। এবারের নির্দেশিত পথ কিছু দূর যাওয়ার পর খালি একটা জায়গা। দেখলে বোঝা যায় এখানে কোনো এক সময় কেউ বসবাস করতো। তার মানে কি, মদন ও তার ছেলে জায়গাটা এই জায়গাটায় বসবাস করতো। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলো রাজিব। লাল মাটি ফুড়ে নতুন ঘাস গজাচ্ছে। ভিটার জায়গাটা এখনও ফাঁকা। প্রায় বুজে আসা একটি মাটির চুলা। আরেকটু সামনে এগুলো রাজিব, আবারও ঘনবনের শুরু। তবে আশ্চর্যের বিষয় বন টা খুব বেশীমাত্রায় নীরব। একটা পাখির আওয়াজও কোথাও নেই। আর এগুতে মন সায় দিল না। ফিরতি পথ ধরলো রাজিব। এবার পথ কিছুটা গুলিয়ে ফেললো। ঠিক যত সময়ে সে খালি জায়গায় পৌঁছেছিল তার চেয়ে দিগুন সময় চলে গেলেও সে রাস্তায় পৌঁছতে পারলো না। আরেকটু হেঁটে সে যখন বড় রাস্তায় উঠলো সেটা তার আগের জায়গা না। সেখান থেকে সে বেশ খানিকটা এগিয়ে এসেছে। প্রায় বাজারের কাছাকাছি। ভালোই হলো, বাজারটা ঘুরে দেখা হয়নি। আজ একটু ঘুরে দেখা যাবে।
বাজারটা খুবই ছোট। আট দশটার মতো স্হায়ী দোকান আছে। একটি চায়ের স্টল, একটি কাপড়ের দোকান, একটি মোটামুটি বড় মুদির দোকান, একটি সাইকেল রিক্সা সারাইয়ের দোকান, একটি দর্জিঘর, হোটেল একটা আছে খুব চলে বলে মনে হয় না। আজ হাটবার, তাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আরও কিছু দোকান বসেছে। একটা জুতা স্যান্ডেলের দোকানও আছে, তবে দোকানটাতে রাবার আর প্লাস্টিকের স্যান্ডেলের সংখ্যাই বেশি। জুতার দোকানের পাশেই একজন মুচি বসেছে। অনেকেই তার কাছে স্যান্ডেল সেলাই করাচ্ছে। জঙ্গলে হাঁটতে গিয়ে গাছের মরা ডালে লেগে রাজিবের স্যান্ডেলের বকলেসটা খুলে চলে এসেছে। মনে মনে একটা মুচি খুঁজছিল যাকে দিয়ে স্যান্ডেলটা ঠিক করাবে। লোকটাকে দেখে তার দিকেই এগিয়ে গেলো।।
মুচির বাক্সটির ডালা খোলা। ভেতর নানা জিনিস উঁকি দিচ্ছে। হঠাৎ একটা জুতার সোলে চোখ আটকে গেলো রাজিবের। এ গন্জ গায়ে এই জুতার সোলটি কোথায় পেলো এই মুচি। সরাসরি কিছু বললো না লোকটিকে। তার স্যান্ডেলটা দিয়ে বকলেসটা ঠিক করে দিতে বললো। লোকটি স্যান্ডেলটা ঠিক করতে করতে নিজের কাজের খুব প্রসংশা করতে লাগলো। এতো ভালো কাজ করে দিবে , যে জীবন চলে যাবে তবু স্যান্ডেলের কিছু হবে না। আবার আফসোস করে বলছিল, সে একখানা জুতা পেয়েছিল এমন মজবুত কিন্তু আফসোসের বিষয় দ্বিতীয় পাটিটি পায়নি।
কেনো? প্রশ্ন করলো রাজীব।
কারন জঙ্গলে একটিই জুতা পাওয়া গিয়েছিল। আরেকটা ছিল না। পরে মুচি ওটাকে কেটে শুধু সোলটা রেখে দিয়েছে।।
সোলটা একেবারে নতুন, দেখেই বোঝা যায় জুতোটা কেউ নতুন কিনেছিল। দশ নম্বর লিখাটার দিকে তাকিয়ে রইলো রাজিব। এটা তার সেই হারিয়ে যাওয়া পুলিশ অফিসারের জুতার সোল।
এখানে আসার আগের দিন সে যখন রাজিবের সাথে দেখা করতে যায় তখন তার হাতে এপেক্স এর জুতার বাক্সটি ছিল, বলেছিল ডিসকাউন্ট দিয়েছে তাই কিনে এনেছে। কথায় কথায় তখনই জানিয়েছিল তার জুতার নাম্বার দশ।
-কোথায় পেলেন জুতাটি?
– ঐ উত্তরের বনে, নদীর পারে।
– আপনি কি সোলটি আমার কাছে বিক্রি করবেন? কারন আমার এমন একটি জুতার সোল দরকার ছিল।
একটুক্ষন ভাবলো লোকটি, ঠিক আছে নিয়ে যান, কিন্তু দু শো টাকা দিতে হবে।
– একটু বেশী হয়ে যায় না। কারন আপনিতো এই সোল কারো কাছে বিক্রি করতে পারবেন না।
– ঠিক আছে দেড় শো- ই দেন।
আর দামাদামিতে গেলোনা রাজিব। সোলটি কিনে নিল।।
একটি কাগজে মুড়িয়ে সোলটি তার হাতে তুলে দিল লোকটি।
চায়ের স্টলটিতে খুব একটা লোকজন নেই, দুজন গাঁয়ের লোক বসে চা খাচ্ছে আর গল্প করছে।
তাদের চা খেতে দেখে নিজের চায়ের তেষ্টা পেয়ে গেলো। এগিয়ে গেলো দোকানটির দিকে। তাকে দেখে লোক দুজন উঠে গেলো বেন্ঞ্চ থেকে।
রাজিব তাদের উঠতে মানা করলো। নিজে গিয়ে তাদের পাশেই বসলো। জানতে পারলো এরা দুজনই স্হানীয় অধিবাসী। তিন পুরুষ ধরে তাদের বসবাস। পিতৃপুরুষরা হয়তো একসময় আসামের অধিবাসী ছিল। রাজিব জানালো সে এখানে কিছুদিনের জন্য বেড়াতে এসেছে।
– খানিকটা কথার ছলে জানতে চাইলো বাজার থেকে নদীটা কতদূর?
– খুব বেশী দূর নয়, তবে একটু ঘুরপথে যেতে হয়। তবে বনের দিকে নদীর যে অংশটা লেগেছে ওদিকে না যাওয়াই ভালো। ওপাশটা বর্ডার এলাকা। বিডিআর বি এস এফ এর গুলিতে শেষে বেঘোরে না প্রানটা যায়।
রোদ চড়ে গিয়েছে। আজ তাপমাত্রাও
একটু বেশি। সিদ্ধান্ত নিল বাংলোয় ফিরে যাবে। ফিরতি পথ ধরলো রাজিব, বাংলোর কাছাকাছি হতেই দেখলো দু টো লোক তার বাংলোর রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করছে। তাকে দেখে এগিয়ে এসে সালাম দিল। বললো, স্যার গাড়ী পাঠিয়েছে, বলেছেন আমাদের সাথে যেতে। দুপুরে উনার সাথে লান্ঞ্চ করতে। একটু ক্ষন ভাবলো রাজিব, বললো, কাপড়টা বদল করে আসি, একেবারে ঘেমে গিয়েছি।
চলবে….

-জাহেদা মিমি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *