লাশের গাড়ি

ঘটনাটা প্রায় বছর দশেক আগের। আমাদের গ্রামের এক লোক আঞ্জুমানে মফিদুলের গাড়ি চালাতো। নাম বললে অনেকেই হয়তো চিনবেন। আমাদের হরিপদ কাকা।

মৃত লাশ নিয়ে মাঝে মাঝেই বিভিন্ন জেলায় তার যাওয়া লাগতো তার। একদিন বিকালে অফিসের নিচে চা খাচ্ছিলেন তিনি, তখন পিয়ন জালাল মিয়া গিয়ে খবর দেয় একটা মৃত লাশ নিয়ে তাকে ঠাকুরগাঁও যেতে হবে।

কাকা দেখল লাশটাকে। লাশটা একটা মেয়ের, খুব সুন্দরী, মনে হয় কলেজ কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তো। খুব বাজে ভাবে অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। মাথার এক পাশ থেঁতলানো, চুল গুলা এলোমেলো, দেহের বিভিন্ন স্থান থেকে রক্ত ঝড়ছে।

তাকে প্রায়ই এমন লাশ নিয়ে অনেক জেলাতে যেতে হয়। তাই দেরি না করে দ্রুত একজনকে সাথে নিয়ে রওনা দিলেন।

উনি যখন রওনা দিচ্ছিলেন, তখন সন্ধ্যা হয় হয় অবস্থা। রাস্তা ঘাটের অবস্থাও এখনকার মতো ভালো ছিলো না। একটানা চার-পাঁচ ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে একটা স্থানে এসে কিছু খাওয়ার জন্য গাড়ি থামালেন।

খেয়ে দেয়ে আবার যখন রওনা দিলেন তখন রাত প্রায় এগারোটা। ঐ অঞ্চলের জন্য গভীর রাত। রাস্তার এদিকটায় খুব একটা গাড়ির চলাচল নেই।

কয়েক কিলোমিটার এগোনোর পর হঠাৎ একটা চাকা বিকট শব্দে বসে যায়। গাড়ি থেকে নেমে দেখলেন পেছনের চাকা বসে গেছে। এক্সট্রা চাকার জন্য গাড়িতে খোঁজ করে দেখেন, তাড়াহুড়োতে তার অ্যাসিসটেন্ট এক্সট্রা চাকা নিতেই ভুলে গিয়েছে।

অ্যাসিস্টেন্টের নাম সুবল। সুবল বলল দাদা, চাকা যেহেতু নাই আমরা যেখানে খাওয়া-দাওয়া করছিলাম, ওইখানে যাই দেখি চাকা সারাইতে পারি কিনা?

হরিপদ কাকার কাছে এ কথা মানা ছাড়া আর কিছু করার মতও ছিলো না। তাই সুবলকে কিছু টাকা আর নষ্ট চাকাটা দিয়ে ঐ দোকানের দিকে পাঠিয়ে দিলেন।

গাড়িটা রাস্তার এক পাশে সাইড করা ছিল। কতক্ষণ লাগতে পারে এই কথা চিন্তা করতে করতে তিনি গাড়িতে গিয়ে বসলেন।

এমনিতেই জায়গাটা নীরব। একটু পরপর, একটা দুইটা বাস পাশ দিয়ে চলে যাওয়া ছাড়া, আসেপাশে আর কোনো মানুষজনের কিংবা বসতির চিহ্ন নেই। আর রাত সাড়ে এগারোটায় কে আসবে হাইওয়েতে!

উনি একটা সিগারেট ধরিয়ে একটু পরপর একটা করে টান দিচ্ছেন আর চাকা আসার ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তা করে সাইড গ্লাসে চোখ রাখছিলেন। এভাবে তাকাতে তাকাতে হঠাৎ ভেতরে থাকা গ্লাসে উনার চোখ আটকে গেল।

উনি সাহসী মানুষ ছিলেন। দ্রুত চোখটা সরিয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখেন, নাহ কিছুই না, সব ঠিক আছে। আবার যখন সিগারেটে টান দিয়ে লুকিং গ্লাসের দিকে তাকালেন, তখন ভয়ে স্থির হয়ে গেলেন।

তিনি পরিষ্কার দেখলেন মেয়েটার লাশ উঠে বসে আছে। এইবার উনি ঘাড় ঘোরাতে সাহস করলেন না। শরীর কাঁপছিলো। উনার মনে হচ্ছিলো যেন দাঁতে দাঁত লেগে আসবে।

হঠাৎ পিছন থেকে মেয়েটা বলে উঠল, দাদা আমি পানি খাব, পিপাসায় গলাটা ফেটে যাচ্ছে। অনিচ্ছা সত্বেও পিছনে তাকিয়ে তিনি দেখেন সত্যি মেয়েটা শোয়া থেকে বসে আছে আর ওর শরীরিরের দাগ গুলা নাই, থেঁতলানো দিকটা বোঝা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে সে এতক্ষণ অজ্ঞান ছিল, এখন জ্ঞান ফিরেছে।

মেয়েটা আবারও বলতে লাগল, দাদা আমার খুব পানির পিপাসা পেয়েছে, আমাকে একটু পানি দিন। মেয়েটাকে দেখতে স্বাভাবিক লাগায়, ভয় একটু একটু করে কাটছিলো। পাাশে থাকা পানির বোতল মেয়েটার দিকে এগিয়ে দিলেন তিনি।

পানি পেয়ে এক নিঃশ্বাসে শেষ করে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো মেয়েটি। তারপর তাকে বলতে লাগল, জানেন দাদা, এই পানির জন্য আমার বুকটা ফেটে যাচ্ছিলো।

ইউনিভার্সিটি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বাড়ী যাওয়ার জন্য তৈরি হয়ে বাস স্ট্যান্ড আসি। আমি রিক্সা থেকে নেমে ভাড়া দিয়ে একটু সামনে এলাম, খেয়াল করিনি কখন যে একটা বাস দ্রুতগতিতে আমার সামনে চলে এসেছে।

চোখের পলকে বাসটার আঘাতে আমি সামনে পড়ে যাই, আর বাসটা ব্রেক করতে না পেরে আমার মাথার ঠিক বাম সাইড দিয়ে চলে যায়। যাওয়ার সময় আমার সমস্ত শরীরটাকে কয়েকবার রাস্তায় পিষে, টেনে কিছু দূর নিয়ে যায়। চিৎকার করে বলতে চেয়েও পারিনি, আমাকে কেউ পানি দাও। পিপাসায় আমার গলা ফেটে যাচ্ছে। আমাকে এক ফোঁটা পানি কেউ দেয়নি।

যখন একজন এসে আমাকে পানি খাওয়াতে চাইলো, ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে। পানির এক ফোটাও গলা দিয়ে নামল না, গাল বেয়ে নিচে পড়ে গেলো। আমার নিথর দেহটা অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হলো। আইডি কার্ড দেখে ইউনিভার্সিটি থেকে তথ্য নিয়ে, আপনার কাছে দিলো আমাকে বাড়ি পৌঁছে দিতে।

এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে একটু থেমে মেয়েটা আবার বললো, দাদা আমার আব্বা, আম্মা আর ভাই বোনকে বলবেন আমার জন্য যেন না কাঁদে আর আপনাকে অনেক অনেক ধন্যবাদ আমাকে পানি খাওয়ানোর জন্য। আমি এখন শান্তিতে ঘুমাতে পারবো। এই কথা বলে মেয়েটা আবার শুয়ে পড়ে।

ঠিক তখনই তিনি জানালা দিয়ে পিঠে কারো হাতের ছোঁয়া পান। সুবল চলে এসেছে। পিঠে হালকা ধাক্কাটা সে’ই দিয়েছে। চাকা ঠিক হয়ে গেছে। সম্বিত ফিরে পেয়ে খেয়াল করলেন তার পুরো শরীর ঘামে ভেজা। হরিপদ কাকা একবার পিছনে লাশের দিকে আর একবার সুবলের দিকে তাকান। সুবল কিছুই বোঝে না। সুবল চাকা লাগিয়ে আবার রওনা দিতে তাড়া দেয়।

হরিপদ কাকা ভাবলেন, হয়তো তার তন্দ্রা এসেছিলো, তাই ভুল-ভাল চিন্তা করেছেন। গাড়ি চালু করতে যাবেন এমন সময় সুবল বললো, দাদা এত ঘামছেন একটু পানি খেয়ে, চোখে মুখে পানির ছিটে দিয়ে নিন। ভালো লাগবে।

এই বলে সে পানির বোতলটা তুলে নিয়ে বললো, দাদা! পানি তো শেষ। যতদূর মনে পড়ে পানি ভরেই দোকান থেকে বের হয়েছিলাম। আপনি খেয়েছেন নাকি?

হরিপদ কাকা কী বলবেন বুঝে পান না। তিনি নিজে সরে গিয়ে সুবলকে সেই যে স্টিয়ারিং-এ বসালেন, এর পর থেকে তিনি আর কোনোদিন অ্যাম্বুলেন্স চালাননি।

তৌফিক মিথুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *