মা টাকা দিয়েছে, নতুন জামা কেনার জন্য। খুব বেশি না তিন হাজার। কিন্তু বেকার জীবনে এই অনেক। ভাবছি খুব বেশি কিছু না, আড়ং থেকে একটা পাঞ্জাবী কিনব। গত দুই বছর নিজের চাকরি থাকার পর ও বান্ধবীর বদৌলতে আড়ং এর পাঞ্জাবী উপহার পেয়েছি। ব্যস, ধরে গেল গরীবের ঘোড়া রোগ। এবছর নিজের ও চাকরি নেই, বান্ধবীরও নতুন চাকরি। আগেই বলে দিয়েছে, ‘ কিছু দিতে পারব না। একটু ঠিকঠাক হয়ে নি ’। বেচারির নতুন চাকরি। কোন হৃদয় ঘটিত লেনদেন না থাকার পর ও একটা মানুষ বন্ধুর জন্য এত কিছু করে, মাঝে মাঝে সত্যি অবাক হই।
পরবর্তী দিন ছুটি হওয়ার কারনে রাস্তা ঘাট অনেকটা ফাঁকা। ঈদের আগের ছুটির দিন গুলি হয়ে উঠে কেনাকাটার মোক্ষম সময়। কলাবাগান থেকে রিক্সা করে সাইন্সল্যাব আড়ং। ভাবলাম শান্তিতে এসির মধ্যে বেশ ভালই লাগবে। কিসের কি, সিঁড়ি দিয়ে উঠতেই ঘাম ছুটে গেল। বাপরে ! এত মানুষ। মনে হল, বিটিভি তে যে সারাক্ষণ দেখায় বাংলাদেশ উন্নত দেশে পরিনত হবার পথে, কথা সত্য! কোন মতে চার তলায় পৌঁছে, পাঞ্জাবীর কর্নারে গিয়ে খুব তারাতারি মধ্যবিত্ত সারির দামের কিছু পাঞ্জাবী দেখতেই জুতসুই একটা পেয়ে গেলাম। দাম, মাত্র চার হাজার তিনশ। আমি চোখ বড় বড় করে একবার দাম দেখছি একবার পাঞ্জাবী দেখছি। হঠাৎ এক ছেলে পাশে এসে বলে, ’ আড়ং এর মান আর আগের মত নেই হয়ত তাই দাম ও কম ‘। শালা, চার হাজার তিনশ দামের পাঞ্জাবী এই ছেলের কাছে কম মনে হয়। মনে মনে যাই গালি দেই মুখে বললাম, ভাই আপনি মধ্যবিত্তের কর্নারে চলে এসেছেন, দয়া করে উচ্চ বিত্তদের সারির দিকে চলে যান। কোম্পানি গুলো ও সমঝদার, বুঝে। দাম অনুযায়ী কর্নার। পাছে বেশি দামি পাঞ্জাবী দেখে না কিনতে পারার কষ্ট সইতে না হয়। বিকাশের পেমেন্টে ২৫% ছাড় থাকায় পাঞ্জাবীর দাম এক হাজার কমে তিন হাজার একশ পঞ্চাশ। একটাই তো ঈদ, কিনেই ফেলি। কাউন্টারের সামনে যেতেই সে আশায় গুড়ে বালি। বিকাশে পেমেন্টে ১২% ছাড়। মিলছে না হিসেবে। আড়ং থেকে মন খারাপ করে বেড় হয়ে সরাসরি নিউ মার্কেট,মধ্যবিত্তের বসুন্ধরা।
ভালই হল একটা পাঞ্জাবীর জায়গায়, দুইটা সার্ট,একটা জিন্স প্যান্ট, একটা টি শার্ট সাথে একটা বক্সার। বাহ, তিনাহাজার টাকা দিয়ে একশত টাকা বেঁচেছে। একবারে ঈদের সব কেনাকাটা শেষ করে মার্কেটের সামনের রাস্তায় এসে দাড়াতেই আবার ও মন খারাপ হয়ে গেল। পাঞ্জাবীটা কেনা হল না। ধুর…মানুষের জাতটাই এমন, যা পায় তা নিয়ে সন্তুষ্ট না হয়ে যা পায়নি তা নিয়ে দুঃখ প্রকাশ করে। আমি ও ‘ আজ গরীব বলে ‘ মার্কা স্ট্যাটাস দিতে পকেট থেকে মোবাইল বের করবো। দেখি রাস্তার পাশে এক জন বাবা, তার ছোট মেয়েটার জন্য একটা জামা দরদাম করছে। ছোট মেয়েটি নতুন জামাটা বুকে জড়িয়ে ধরে আছে। মেয়েটির চোখে মুখে প্রাপ্তির আনন্দ। আর দোকানদারও বুঝে শুনে দাম হাঁকিয়ে বসে আছে। একদাম তিনশত পঞ্চাশ ।একটাকাও কম হবে না। বাবা তার পকেটের টাকা গুনে দেখলেন একেবারে তিনশত টাকাই আছে। কিন্তু দোকানদার নাছোরবান্ধা। সারা বছরে সিজন তো এটাই, একটু ভাল দাম পাবার। ছাড়বে কেন। এলাকার মাস্তান, দলীয় ক্যাডার, পুলিশ কেউ তো ছাড়ে না। কিন্তু এত ছোট মেয়েটি তা বুঝবে কেন ? সে জামাটি তার বুকে আগলে রেখেছে। এত সুন্দর নতুন জামাটি তার চাই ই চাই। যদিও আমি এখনও বাবা হইনি কিন্তু ওই অসহায় বাবার মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু না ভেবেই দোকানের কাছে বললাম, দিন তিনশো টাকা দিন, তার পর মানিব্যাগ থেকে একশত টাকার একটা নোট একসাথে করে দোকানদার কে দিলাম। দোকানদার আমাকে পঞ্চাশ টাকা ফেরত দিলেন। আমি দোকানদারের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলাম। দোকানদার লজ্জিত চোখে বলল, ভাইজান বোঝেনই তো যা দিন কাল। আমি আবারও হাসি দিলাম। পঞ্চাশ টাকা ওই বাবার হাতে দিয়ে বললাম, ‘আপনার মেয়েটা অনেক মিষ্টি, ওকে খাবার কিছু কিনে দিয়েন’ ।
লোকটার চোখে জল, মুখে আনন্দের হাসি। আমায় জড়িয়ে ধরল লোকটা। আমি আবারও হাসি দিয়ে বাসার পথে হাঁটা শুরু করলাম। ঢাকা কলেজ থেকে কলাবাগান খুব বেশি পথ নয়। রাস্তা প্রায় খালি। দু পাশের মার্কেট গুলো বেশ জমজমাট। প্রাপ্তি যেমনই থাকুক না কেন, সবার মুখে কেমন একটা আনন্দ। আসন্ন ঈদের আনন্দ। পাঞ্জাবীর কষ্ট অনেক আগেই ভুলে গেছি। কেমন যেন একটা ভাল লাগা কাজ করছে মনের মধ্যে…।।