অনুধাবন ( ৭ ম পর্ব )

পরবর্তী কয়েকদিনে তালুকদার বাড়ির ভেতরে আরো কিছু উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটলো।

(নাজমা)

মদ্যপ হয়ে ফেরা সে রাতের পর রাসেল মোটামুটি নিজেকে গৃহবন্দীই রাখলো পরবর্তী চব্বিশ ঘন্টা। কিন্তু তারপরের দিন গভীর রাতে মৃদু গোঙানির শব্দে ঘুম ভাঙে নাজমার। এ ধরনের শব্দ নাজমার চেনা। নেশাখোররা রক্তে নেশার দ্রব্য কমে গেলে সাধারণত এ ধরনের শব্দ করে। তাদের বাড়ির পেছন দিক থেকে সেই মুদি দোকানে যাওয়ার রাস্তায় থেকে থেকে এরকম শব্দ প্রায়ই আসতো। সাধারণত কিছুক্ষনের মধ্যেই এই শব্দ থেমে যেত কারণ ততক্ষণে নেশার দ্রব্য শরীরে চালান করা হয়ে যেত নেশাখোরদের। কিন্তু সেই রাতে রাত বাড়ার সাথে সাথে নাজমার পাশের রুমের শব্দও বাড়তে থাকে। রাসেলই যে শব্দ করছে এটা বুঝতে নাজমার সময় লাগেনা মোটেই। কিন্তু একাকী রাসেলের মুখোমুখি হওয়ার সাহস করতে পারছিল না নাজমা। আর এতো রাতে ঘর থেকে বের হলে বাড়ির লোকে কে কি ভাবে সেটা ভেবেই দরজা খুলে বের হয়নি আর। কিন্তু কান খাড়া ছিল পুরোপুরি।

অল্পক্ষণ পরেই নিস্তব্ধ রাত চিরে ঝনঝন শব্দে ভেঙে পরা কাঁচের জগের শব্দে পুরো বাড়ির সবাই প্রায় কে কে বলে জেগে উঠলে দরজা খুলে বেরিয়ে আসে নাজমা। টকটকে লাল চোখ আর ক্রমাগত লালা গড়িয়ে পরা রাসেলের মুখের দিকে তাকিয়ে ভয়ে কেউ এগোতে সাহস না করলেও নাজমা বাড়ির দুজন শক্ত সামর্থ্য লোক দিয়ে রাসেলকে বেঁধে ফেলার ব্যবস্থা করে। রাসেলের মা আপত্তি জানালেও তালুকদার সাহেবের হাতের ইশারায় থেমে যান। নাজমা এই প্রথম অন্তঃপুরের বাইরে এসে তার শ্বশুরের মুখোমুখি হয়। এতোদিন শাশুড়ীর সাথে টুকটাক কথা হলেও গাম্ভীর্যের চাদরে মোড়া শ্বশুর থেকে নিরাপদ দূরত্বেই সে ছিল। বেঁচে থাকাটাই যাদের জন্য নিত্যদিনের চ্যালেঞ্জ তারা প্রতিকূল আবহাওয়ার গন্ধ সবার আগে পায়। রাসেলের কিছু হলে প্রথম গলাধাক্কা সে খাবে সেটা তো সহজেই অনুমেয়। যদিও রাসেলের সাথে কাগজে কলমে সই করা নিকাহনামা ছাড়া তার আর কোন সম্পর্ক নেই। তবু এই লোকের বেঁচে থাকার ওপর এই মুহূর্তে  তার মাথার ওপরের নিরাপদ ছাদটুকু নির্ভর করছে। রাসেলকে বাঁধা শেষ হলে তাই নাজমা এগিয়ে যায় শ্বশুরের ঘরের দরজার কাছে।

– আব্বা, ওনাকে হাসপাতালে নেয়ার ব্যবস্থা করেন নয়তো ওনার খিচুনী শুরু হলে আমরা তখন কিছুই করতে পারবোনা। ওনাকে এখুনি আবার উনি যা নেয় সেরকম কোন ড্রাগস না দিলে একটা বড় ধরনের অঘটন হয়ে যাবে। বিশ্বাস করেন আমার কথা। আমি জানি আমি ডাক্তার না। কিন্তু আমি দেখেছি এ ধরনের অনেক কে।

নাজমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে, সবাই যে যার ঘরে যাও, আমি দেখছি বলে তালুকদার সাহেব নিজের ঘরে ঢুকে যান।

সেই রাতেই ওয়াদুদ আর ম্যানেজারের নেতৃত্বে রাসেলকে শহরে নিয়ে যেয়ে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।

( লিমা)

তিতলী যখন পেটে ছিল আমার শুধু ঘুম আসতো। সারারাত ঘুমিয়েও ঘুম শেষ হতোনা যেন। আর এই বাচ্চাটা পেটে আসার পর থেকে আমার রাতের ঘুম উধাও। দিনে সারাদিন ঝিমাই আর রাত হলেই চোখ মেলে তাকিয়ে থাকা। একা একা রাত জেগে থাকার মতো কষ্ট বুঝি আর কিছুতেই নেই। কত কি ভাবি বসে একা একা, তাও আর রাত ফুরায়না। মানুষ দুঃখ পেতে পেতে এক সময় বোধহয় স্থবির হয়ে যায়। কোন অনুভূতিই বুঝি তখন আর মনে দোলা দেয়না। না সুখের না দুঃখের। অন্তহীন জীবনের অন্ধকার পথের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে নিজেকে মনে হয় বুঝি কোন জড় পদার্থ। কি আছে আমার বা আমার বাচ্চাদের ভবিষ্যতে? বাংলা সিনেমার শাবানার মতো নাজমাকে বোন মেনে নিয়ে দুই সতীনের সুখের সংসার করে যাওয়া? নাকি নিজের মতো করে নিজের বাঁচবার পথটুকু খুঁজে নেয়া? খুঁজে নিতে তো চেয়েছিলামই; কিন্তু কিছু নিষ্ঠুর নিয়ম, কিছু সংস্কারের বেড়াজালে আটকে আবার ফিরে আসতে হয়েছে এই অন্ধকূপে। কিন্তু নিজের মনের এই নিত্য দোটানা নিয়ে কতদিন জীবনের এই দুঃসহ ভার বয়ে নিতে পারবো কিছুতেই ভেবে পাইনা।

প্রায় রাতেই আমার মনে হয়, আচ্ছা রাসেল যদি নেশা করা ছেড়ে দিয়ে সুস্থ হয়ে যায়; তাহলে ও কাকে নিয়ে ঘর করবে? নাকি দুঘরে ভাগাভাগি করে রাত কাটাবে? আমি রাসেলকে এখনো কি কোন কারণে সামান্যতম ভালবাসি? নয়তো কেন আরো একটু শক্ত হয়ে থেকে গেলাম না সেই এক কামরার খুপরি ঘরে? আমিও কি তাহলে আর দশটা সাধারণ মানুষের মতোই লোভী। নিত্যদিনের আয়েশী খাওয়া পরার নিশ্চিত জীবন কাটানোর লোভেই ফিরে এসেছি? বাচ্চাদের একটা পরিচয় একটা নিরাপদ আশ্রয় দিতে আমি কি এতোটাই অপারগ? নিজের মেয়েমানুষ পরিচয়টাকে বড় ধিক্কারের মনে হয় আজকাল।

কত রকম জীবনের প্ল্যান যে করি রাত জেগে জেগে। কোন কিছুতেই কেন যেন কোন আলোর দিশা পাইনা। নাজমা সেই বিকেলের পরে আর আমার ঘরের আশেপাশে আসেনি। যাক মেয়েটার কিছুটা আত্মসম্মানবোধ আছে তাহলে। আমি যে ইচ্ছে করেই ওর সাথে কথা বলিনি সেটা যে বুঝতে পেরেছে আমি তাতেই খুশি। কাউকে কোন কর্কশ কথা মুখ ফুঁটে বলতে ভালো লাগেনা। অথচ মনে মনে কতো শত গালি যে দেই রাসেল আর ওকে তা বোধহয় আমি নিজেও জানিনা। বাড়ির ঠিকে ঝিয়ের কাছে শুনলাম গত দুদিন ধরে রাসেল নাকি বাড়ি থেকে বেরোয়নি। ভালো হয়েছে, খুব ভালো হয়েছে। পৃথিবীর সব মানুষ আমার মতো ঘরে আটকা পরুক, বুঝুক কষ্ট কাকে বলে?

আমার এসব পাগল পাগল ভাবনার মাঝেই বিকট ঝনঝন শব্দে তাড়াতাড়ি খাটের পাশের জানালা খুলে দেই। সব ঘর থেকেই সবাই হন্তদন্ত মুখে বেরিয়ে এসেছে। দেখলাম নাজমা কি যেন বললো আমার শ্বশুরকে, উনি পাঞ্জাবি গায়ে বেরিয়ে এলেন। ঘরের কাজের দুজন যোগালী দেখলাম রাসেলকে বেঁধে ফেললো। কিছুক্ষনের মধ্যেই ওয়াদুদ কাকা আর আড়তের ম্যানেজার একটা ভটভটি নিয়ে এসে রাসেলকে উঠিয়ে নিয়ে গেল। কোথায় গেলো তারা? রাসেল কে তো আমি এখন কোনভাবেই আর ভালবাসি না; তাহলে বুকের মধ্যে এমন ধ্বক করে উঠলো কেন? নিজের অজানা ভবিষ্যতের শংকা নাকি নিত্য অভ্যাসে মনের মধ্যে জমে ওঠা মায়া? আনমনেই পেটে হাত দিয়ে ফেললাম, সাথে সাথেই আমার পেটের জনও একটু নড়ে উঠলো। বুঝিবা বলতে চাইলো, ভয় পেয়োনা মা, আমি আছিতো।

…………….

(রেহানা)

বাড়ির একমাত্র ছেলেকে নিয়ে বাড়ির সকলেই কম বেশী চিন্তায় থাকলেও শরীর তো আর চিন্তার সাথে সাথে পথ চলেনা। তাই মন খারাপের রাতেও চোখেরা ঠিকই ক্লান্তিতে বন্ধ হয়। মধ্যরাতের পর ঘুমানোতে বাড়ির সবাই বেশ বেলা পর্যন্তই ঘুমালো। শুধু এ জাতীয় রেহাই মেলেনা বাড়ির চাকর বাকরদের। ঘুম হোক আর না হোক ভোরের আলো না ফুঁটতেই তাদের উঠে পরতে হয় নিত্যদিনের ঘরের সব স্বাভাবিক কর্মের যোগান দিতে। বাড়ির পুরোনো ঝি কমলাই প্রথম দেখে আলুথালু বেশে রেহানা, তালুকদার সাহেবের বাড়ির বারান্দায় বসা।

রাগের চোটে দিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে প্রায় কয়েক মাইল পথ পায়ে হেঁটে চলে আসা এলোমেলো রেহানা বাড়ির সীমানায় ঢুকে ক্লান্তিতে সেসময় প্রায় ভেঙে পড়ছিল, তাই মাটিতে বসেই একটু জিরিয়ে নিচ্ছিল। ওর মা অর্থাৎ আসমা বেগম সাধারণত খুব ভোরে ওঠেন। কিন্তু আজ এতো বেলা পর্যন্ত সব ঘরের দোর দেয়া দেখে কোন দরজায় টোকা দেবে বুঝতে না পেরে বারান্দায় বসে থাকাটাই তার কাছে সমীচীন মনে হয়েছিল।

‘বড় আপা, আপনে এতো সকালে? আপনেরে এমুন দেখা যায় ক্যান? কোথা থেকে আসছেন? পোলারা কই? দুলাভাইয়ে কই? ও চাচী দেখেন কে আসছে?’

কমলার জোর গলার আওয়াজ শুনেই বুঝি আসমা বেগম দোর খুলে বেরিয়ে আসেন। এতো বেলা হয়ে গেছে অথচ তিনি টের পাননি দেখে নিজেই বুঝি খানিক লজ্জা পেলেন। পরক্ষণেই ছেলের কি অবস্থা ভেবে শংকিত মনে এসে দরজা খুলেই দেখেন দরজার মুখে রেহানা দাঁড়ানো। রেহানার দিকে এক পলক তাকিয়ে সংসারী আসমা বেগম বুঝে যান বড় কোন সমস্যা। নয়তো তার এই মেয়েকে এ অবস্থায় বাড়িতে একলা দেখার কথা না। কমলাকে ধমকে থামিয়ে রেহানাকে নিজের ভেতর ঘরে নিয়ে আসেন তিনি।
দীর্ঘদিনের চেপে রাখা কষ্টের ভারে জর্জরিত রেহানা মায়ের উষ্ণ স্পর্শে আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারেনা। মাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে সে নিজেকে একটু হাল্কা করার চেষ্টায়। শরীর আর মনের দগদগে ঘা গুলো যেন এ বেলা চোখের জলে নিজেদের ভিজিয়ে খানিক উপশমের চেষ্টায় মত্ত।

…………………

জীবন তার নিজস্ব গতিতে চলতে চলতে হঠাৎ কখনো কখনো মুখ থুবড়ে পরে কারো কারো ক্ষেত্রে। এতোদিন খানিক নিজের পরিশ্রম, বুদ্ধি আর ক্ষমতার জোরে শুধু সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া তালুকদার সাহেবের জীবন গতি যেন সেই এক রাতে অনেকটাই থমকে থেমে গেলো পরপর দুই ছেলেমেয়ের জীবনে ঘটে যাওয়া অঘটনে। তবু ঐ যে বলে সময় কারো জন্যই থেমে থাকেনা, জীবনও তেমনি। মানুষ মানিয়ে নেয় নিজেকে নয়তো মানাতে চেষ্টা করে কারণ দিনশেষে যার যার নিজের জীবন বয়ে নেয়ার দায় যে তারই। মৃত্যু ছাড়া থেমে থাকার কোন উপায় যে মানুষ কেন কোন প্রাণীরই জানা নেই।

চলবে….

-ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *