হুলো ( ১ম পর্ব )

সন্ধ্যা নামছে। দিনের অন্য সময় তেমন বোঝা না গেলেও সন্ধ্যার দিকে ঠিকমত ঠান্ডা লাগে। নভেম্বর মাসের এরকম এক সময় বিকালের খেলা শেষে রাজু কোথা থেকে একটা কালো কুচকুে বিড়ালের বাচ্চা নিয়ে ধীর পায়ে বাড়ির বাহিরে দরজায় দাঁড়াল। এই ঠান্ডায় রাজুর গায়ে জামা নেই দেখে রাহেলার রাগ হলো। তার ছেলে গায়ের জামা খুলে বিড়ালের বাচ্চাটাকে মুড়িয়ে নিয়েছে। জামার ফাকঁ গলে মাথা বের করে বিড়াল কুইকুই করছে আরামে। রাহেলা বেগম রাগ ফেলে তা দেখে আৎকে উঠলেন,

‘করছিস কি? এইটা পাইলি কই? যেখান থেকে আনছিস, সেখানে রেখে আয় এখনি’

রাজু মায়ের কথা তোয়াক্কা না করে ঘরে ঢুকে গেল। রাহেলা বেগম চেঁচিয়ে উঠলেন,

‘কি হল, কথা কানে যায় না তোর? ‘

রাজু বিড়ালের মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলল,

‘আমি ওরে পুষব’

রাহেলা ছেলের কথায় ক্ষেপে গেলেন। রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এসে ছেলের পিঠে চড় দিলেন। সেদিন ঘটনা এরকম ঘটার পরেও বিড়ালের বাচ্চাটাকে বহাল তবিয়তে সারাবাড়ি ঘুরতে দেখা যেতে লাগল। শাহেনশাহে্র মত ঘুড়ছে আর চিকন গলায় মিউ মিউ করছে।

পরদিন রাতে খেতে বসে রাজু ওর প্লেট থেকে মাছটা তুলে বিড়ালের সামনে দিয়ে দিল। রাহেলা বেগম হায় হায় করে উঠলেন,

‘মাছটা দিয়ে দিলি, এখন ভাত খাবি কি দিয়ে?’

‘আমি এমনিই খাব’ বলে রাজু প্লেটের ভাত তরকারিতে মেখে বড় বড় লোকমা করে মুখে দিতে লাগল। রাহেলার মন খারাপ হয়ে গেল ছেলের দিকে তাকিয়ে। তরকারিতে এক্সট্রা মাছ নেই ছেলেকে দেবার মত। গুনে গুনে ছ’পিচ মাছ রান্না হয়েছে পরিবারের ছয় সদস্যের জন্য। তার নিজের ভাগেরটা স্বামীর বাটিতে দিয়ে দিয়েছেন। লোকটা ঝাল একদম খেতে পারেনা। মাছের দু ‘টুকরো ভেঙ্গে অনেকটা ভাত খেতে পারবে ভেবে তিনি শান্তস্বরে ছেলেকে বললেন,

‘বাচ্চাটার মা বাচ্চাটাকে খোঁজাখুঁজি করে কাদঁবে না? তুই বাচ্চাটাকে নিয়ে এলি!’

রাজু রুক্ষস্বরে বলল, ‘না। ওর মা নেই’

রাহেলা বেগম হাল ছেড়ে দিলেন। ছেলের সাথে এ বিষয়ে কথা চালাচালি আর ভাল লাগছে না। তাছাড়া বার তের বয়সের এ রকম সময়ে বাচ্চাদের কুকুর বিড়াল পোষ মানানোর একটা ঝোঁক থাকে মনে করে তিনি শান্ত হলেন। সমস্যা হল, সালাহউদ্দীন সাহেব বিড়ালের বাচ্চাটাকে দেখলে চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলবেন। মানুষটা কুকুর বিড়াল মুরগি এসব পছন্দ করেন না।

রাজু খাওয়া শেষ করে হাত ধুয়ে বিড়াল কোলে তুলে আদর করে মাথায় হাত বুলিয়ে ‘আমার হুলো, আমার হুলো’ বলতে বলতে চলে গেল।

রাহেলা ভাবতে লাগলেন, থাক না, বাচ্চারা বিড়ালের বাচ্চাটা পেয়ে কত খুশি কাল থেকে ! তার অভাবের সংসার, সালাউদ্দীন সাহেব গার্মেন্টসের টাইম কিপারের চাকুরী করে যে সামান্য রোজগার করেন, তাতে সংসার টেনে টুনে চলে। ছেলে মেয়েদের শখ আহ্লাদ মিটানো যায়না। একটা দুইটা হলে কথা ছিল। চারটা ছেলেমেয়ের শখ আহ্লাদ মিটানো সম্ভবও তো না। রাজু বড় বলে তবুও বুঝানো যায় ছোট তিনটারে বুঝানো যায়না মাঝে মাঝে। এই তো সেদিন তার দ্বিতীয় ছেলে রাহী স্কুল থেকে ফিরে তাকে জড়িয়ে ধরে বলল,

‘মা, আমার ক্লাশের বন্ধুরা সবাই কেডস্ পরে আসে স্কুলে। ওরা বলে শীতের সময় কেডস্ পরতে হয়। আমাকে একটা কিনে দাওনা মা!’

ছেলের দিকে তাকিয়ে রাহেলার চোখে পানি চলে এলো। তিনি কি বলবেন, বুঝতে পারলেন না। কেডস্ কিনে দেওয়ার কথা সালাউদ্দীন সাহেবকে বলাই যাবেনা। শুনলে যা তা গালাগালি করবেন। তিনি ছেলেকে কোলে তুলে আদর করে পাচঁ টাকায় একটা আইসক্রিম কিনে দিয়ে সে যাত্রা সামলালেন।

সালাউদ্দীনের আজ ছুটির দিন। তিনি দুপুরের খাওয়া দাওয়ার পর ঘন্টা দু’য়েক ঘুমালেন আরাম করে। বিকালে ঘুম থেকে উঠে হাত মুখ ধুয়ে ঘরে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে মাথায় চিরুনি করতে করতে স্ত্রী কে ডাকলেন,

‘কই, বাজারের ব্যাগটা দাও। দেখি যাই, টাটকা শাক পাই কিনা।’

রাহেলা বেগম রান্নাঘরে ঢুকে বাজারের ব্যাগটা হাতে তুলতেই ‘ভটাম’ জাতীয় শব্দ পেলেন। শব্দ শুনে ওঘরে দৌঁড়ে গিয়ে যা দেখলেন, তাতে মনটা খারাপ হয়ে গেল। সালাউদ্দীন সাহেব বিড়ালের বাচ্চাটাকে এক লাত্থি দিয়েছেন। বিড়ালের বাচ্চা উড়ে গিয়ে আঙ্গিনায় পরে এরকম শব্দ হয়েছে। স্ত্রীর আহত চোখ উপেক্ষা করে আঙ্গিনায় গিয়ে তিনি দ্বিতীয় লাত্থিটা দিলেন। বাচ্চাটা উড়ে গিয়ে বাড়ির বাহিরের দরজা পেরিয়ে পরে গোটা তিনেক উল্টানি খেয়ে উঠে বসে করুণ চোখে সালাউদ্দীনের দিকে তাকিয়ে মিউ মিউ করতে লাগল দেখে মনে হল, বিড়াল তার পায়ের কাছে ঘুরঘুর করার অপরাধে বড় লজ্জিত। অনুশোচনা থেকে সে বলছে,

‘আমি আমার কৃত অপরাধের জন্য বড়ই শরমিন্দা। আমাকে দয়াকরে মাফ করেন’

রাজু কোথা থেকে দৌঁড়ে এসে বিড়ালের বাচ্চাটাকে নিয়ে পালাল। সালাউদ্দীন বিস্ময়ে চটে গিয়ে বললেন,

‘ঘটনা কি? তোমার ছেলে এইটারে নিয়া পালাইলো কেন?’

রাহেলা মিন মিন করে বলল,’ও ঐটা কুড়িয়ে আনছে’

‘কুড়িয়ে আনছে মানে কি? কুড়ানের মত জিনিস এইটা? কুড়ানের অভ্যাস করিয়েছ, ভাল কিছু তো কুড়ায় না। এহ্, বিড়ালের বাচ্চা কুড়িয়ে আনছে! কত টাকা পয়সাও তো কুড়িয়ে পাওয়া যায়। কোনদিন তো দেখলাম না, দুইটা টাকা কুড়িয়ে আনছে! ‘

কিছুটা থেমে গিয়ে আবার বললেন,’বিড়ালের বাচ্চা কি জিনিস তুমি জান? খাবারের সময় প্লেটের পাশে ঘুড়ঘুড় করবে। তারপর কালভেদে বিড়ালের একটা লোম গিয়েছে কি পেটে- ব্যাস, কেল্লা ফতে।’

চলবে….

-বেলা প্রধান

ছবি কৃতজ্ঞতা  -রাত্রি চৌধুরী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *