বাবুই আর দোলার গল্প

আর দোলা হাঁটছে ৷ একসাথে৷ হয়তো এটাই একসাথে তাদের শেষ হাঁটা৷ চারপাশে ঝিম মেরে থাকা শীতের প্রকৃতি৷ গাছ গুলো মৌন৷ পাতা ঝরা৷ জীবিত পাতা গুলোও ধূসরিত, ধূলায়৷ হঠাৎ উত্তরের বাতাস পড়ে থাকা শুকনো পাতা গুলোকে উড়িয়ে সরসর শব্দ তুলছে৷ অদ্ভুত শব্দ৷ পাশ দিয়ে শব্দশকট গুলো চলে গেলেও পাতা গুলো শব্দ তুলছে৷ চৈত্রের বাওকুড়ানীর মতো পাক খাচ্ছে একটা দুটো বড়জোর তিনটে৷ রিক্সার টুংটাং বেলও আছে থেকে থেকে৷

বাবুই আকাশের দিকে তাকালো৷ একটু থমকে দাঁড়ালো৷ এই সময় আকাশে মেঘ থাকার কথা নয়৷ কেন জানি বাবুই চায় অসময়ে একটু বৃষ্টি হোক৷
দোলা তাকিয়ে আছে তার আর বাবুই এর লম্বা ছায়ার দিকে৷ পড়ন্ত বিকেলের রোদ-ছায়া৷ কেমন লম্বা আর শুকনো দেখাচ্ছে৷ দোলা ভাবছে এমন করে এই ছায়া দুটোকে কি আর একসাথে দেখতে পারবে সে!

বাবুই দোলার ভালবাসা একেবারেই গতানুগতিক৷ একসাথে পড়তে গিয়ে ক্রমান্বয়ে কাছে আসা, দুবছরের বড় বাবুই এর সাথে প্রথম প্রথম কথা বলার সময় সৌজন্যমূলক দূরত্বে থাকা, আপনি থেকে তুমি তে, তুমি থেকে একদিন হঠাৎ দোলার হাত ধরা৷ সেই হাত ছিল ঠান্ডা আর একটু ভেজা ভেজা৷ ধরেই বাবুই হাতটা ছেড়ে দিয়েছিল৷ দোলা চমকে উঠেছিল৷ বাবুই এর মনে হয়েছিল ইশ হাতটা ধরা একেবারেই ঠিক হয়নি৷ দোলা ভেবেছিল ইশ ধরলেই যদি তবে ছেড়ে দিলে কেন?
প্রেমে পড়ার সময় ওরা কখনই পরিনতি নিয়ে চিন্তা করেনি৷ সকল প্রেমিকদের মতোই তাদের আকুতি ছিল ভালবাসা কেন্দ্রিক ৷ পাশে থাকা নিয়ে উদ্বিগ্নতা৷ যতটা সময় পারা যায় দু’জন বসে গুটুর গুটুর করা৷ খুবই গতানুগতিক৷
দু’কামরার ছোট্ট সংসারে নীল পর্দা, জানালা ভরা আকাশ আর অসময়ের বৃষ্টি- সব প্রেমিকের মতোই গতানুগতিক ভাবনা৷ অথচ বাবুই আর দোলার কাছে প্রতিটি চিন্তাই মনে হতো নতুন৷
তারা স্বপ্ন দেখেছিল একটা ছোট্ট খুকি অথবা খোকার৷

বাবুই বলেছিল খুকির নাম হবে বাদো! ওর নামের প্রথম বর্ণ আর দোলার প্রথম বর্ণ মিলিয়ে৷

দোলা বলেছিলো ইশ খোকার নাম হবে দোবা! হাহাহা ডাক নামই হবে৷

কেমন হবে বলতো? তারা খানিক হেসেছিলো৷ তখন প্রেমে পড়ার সময়৷ জীবনের জটিল যৌগিক হিসেবে নাক গলানোর সময় নয়৷

কে জানে হিসেব একসময় পাল্টে যাবে৷ সুন্দর দিন আর ভাবনা গুলো ভার্সিটির সেমিস্টারের মতো একে একে তাদের কে নিয়ে আসবে সম্পর্কের শেষ প্রান্তে৷

অঞ্জন দত্ত তখন জনপ্রিয়তার শীর্ষে৷ এটাকি 244 113 9 বলে  তিনি খালাস৷ বাবুইয়ের মতো সদ্য পাশ করা ছেলেরা বেলা বোসকে ফোনে পায়না নাম্বার জিজ্ঞেস করা তো দূরের ব্যাপার৷
দোলার সম্বন্ধ আসছে পড়া শেষ করার জন্য দোলা গাঁইগুঁই করছে, বাবুই চাকুরী খুঁজছে … এ গল্পের চর্বিত চর্বণ! বহুবার বহু ভাবে গতানুগতিক এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সব প্রেমিক প্রেমিকার হাইপার টেনশান৷ কমন এই প্রেম প্রক্রিয়ায় কারও ভাগ্যে শিকে ছিঁড়ে তো কারও নয়৷

দোলা আর বাবুইয়ের সম্পর্ক এখন এই শিকে না ছেঁড়ার দোষে দুষ্ট৷ ওরা বহু ভাবে চেষ্টা করেছে৷ অংক মেলে না৷ শেষপর্যন্ত সিদ্ধান্ত হলো আমরা আলাদা হয়ে যাবো৷ আলাদা হবার পূর্বে সম্পর্কের শেষ ওয়াক টু রিমেম্বার৷

দোলা মাথা নিচু করে ছায়া দেখছে ৷ বাবুই দেখছে আকাশ হঠাৎ বাবুই বলল নাজমুন নাহারের সেই কবিতাটা খেয়াল আছে তোমার? দোলা বাবুই এর দিকে চোখ তুলে তাকিয়ে বলল কোন টা?
বাবুই বলল ঐ যে…

ঠিক করেছি তোমায় রোজ একটি করে চিঠি দেব
রোজ মানে রোজ, তিনশ পঁয়ষট্টি দিন একদম গুনে গুনে।
জানি পুরনো  ডাকবাক্সটি বন্ধ করে রেখেছ
আমায় অস্বীকার করার ছলে
কিন্তু তুমি জানো না, ডাকহরকরার সাথে গোপন আঁতাতে
চিঠিগুলো ঠিক পৌঁছে যাবে তোমার দুয়ারে
অনামিকা নামে।।

“ষড়যন্ত্র” নাজমুন নাহার।

দোলা বলল ,বাবুই সত্যিই আমায় চিঠি লিখবে? আমি চলে গেলে চিঠি লিখে কি হবে৷

বাবুই কোন উত্তর দিল না৷ সে মনে মনে বলছে আমার এভাবে আসাটাই কি উচিৎ হয়েছে? স্বপ্নদেখা মানুষটাই যদি না থাকে তাহলে শেষ এই সামনাসামনি আসার আর হাঁটার মানে কি৷ বাবুই জানেনা৷ কষ্টে তার বুকটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে৷

দোলারও কষ্ট হচ্ছে৷ ও আসতে চায়নি৷ বাবুই বলেছে দোলা শেষ বারের মতো একবার যদি…

দু’জন নিশ্চুপ হয়ে একটা গাছের নিচে বসে আছে৷ দোলা কবিতা পছন্দ করে৷ সেই হিসেবে বাবুই করে না৷ তবুও দোলার জন্য কবিতা মুখস্ত করে সে৷ মানে করতো৷ আজকের পর আর হয়তো কবিতা মুখস্ত করতে হবে না৷

বাবুই বলল একটা কবিতা শুনবে দোলা?
বল শুনি,বাবুই বলতে লাগলো..

হেঁটে যেতে যেতে অন্ধকারে
কতবার চোখ রেখেছি তে তলায়
মনে মনে ভেবেছি তুমি হাসছো
চুল বাঁধছো৷

শীতের সকালের উষ্ণতা রোদের কাছ থেকে তোমায় দিয়ে যায়
বিবশ অন্ধকার থেকে আলোর বার্তা,
যে কুয়াশা এসেছিল কাল রাতে
ঝিনুকের মুক্তোর মতো মনে হয়েছিল পথ বাতিদের,
তারাও তোমার কাছে যেচেছিল আবেগ,
তুমি ঘুমঘোরে খুঁজেছিলে
শুধুই সূর্যকে
কুয়াশার রহস্যময়তা ছেড়ে৷
অথচ ঝাপসা কাঁচের জানালা ভেদ করে যদি দেখতে
ওখানেই দাঁড়িয়েছিলাম পথ বাতিদের মুক্তো দানার নিচে…

এটা কার কবিতা বাবুই?

আমার৷

তুমি কবিতা লিখ? জানতাম না তো!

শুধু তোমার জন্য লিখেছিলাম ! প্রতিদিন একটি করে৷

আমাকে তো পড়তে দাওনি কখনও!

না দিইনি৷ মনে করেছিলাম একটা ঘর হবে আমাদের৷ নীল পর্দা দেয়া ঘর৷ সেই ঘরের চার দেয়ালে সব জায়গা জুড়ে আটকে দিবো প্রতিটা পাতা৷ চোখ বাঁধা তোমায় নিয়ে যাবো সেই ঘরে৷ তারপর কবিতার মেঘপুঞ্জ বৃষ্টি হয়ে ঝরবে তোমার মনে৷

তুমি আমাকে কেন কবিতা গুলা দাওনি বাবুই? কেন?

আমি সব জমিয়ে রেখেছিলাম দোলা৷ তোমার জন্য৷ আমাদের জন্য।

আবার নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকলো দু’জন৷ আজ তাদের শেষ সাক্ষাৎ৷ অন্যদিন কথা শেষ হতো না৷ আজ কথা খুঁজে পাচ্ছেনা কপোত কপোতী৷

এভাবে বলে কয়ে কি বিদেয় নেওয়া যায়! কষ্টটা বাড়ে কেবল৷ বাবুই ভাবে৷ ভাবে দোলাও৷

প্রথম যখন আমাকে কবিতা বলতে বলেছিলে মনে পড়ে আমি কি কবিতা বলেছিলাম৷ মনে পড়ে দোলা…

আছে মনে? বাবুই বলতে শুরু করলো

আগডুম বাগডুম
ঘোড়া ডুম সাজে
ঢাক ঢোল ঝাঁঝর বাজে…

সেদিন তো খুব হেসেছিলে৷ আজ চোখে জল কেন তোমার!

বাবুই আমাদের সত্যিই কি কোন উপায় নেই৷ আসলেই কি নেই? যদি না থাকে তাহলে তুমি আমাকে স্বপ্ন দেখালে কেন? প্রেম বিরহে গতানুগতিক প্রশ্ন৷

বাবুই বলল ,তখন তো চিন্তা করিনি ওভাবে৷ আমার কেউ নেই কিছু নেই শুধু তুমি আছো এটাই মনে হয়েছিলো৷ এখন মনে হচ্ছে আমার পরিচয়ই নেই! নাম নেই আছে শুধু অন্ধকার৷

বাবুই আমি রাজী৷ তুমি আমাকে নিয়ে চলো৷ যেখানে যেতে বলবে সেখানে যাবো, দোলা বলল।

বাবুই বলল, আমি তোমাকে ইমপ্রেস করার জন্য কথা গুলো বলিনি৷ পিতৃপরিচয়হীন এক মায়ের সন্তান এর আসলে ইমপ্রেস করার মতো থাকে না কিছু!

তুমি তো কখনও আমাকে এসব বলনি! আজ বললে কেন? এজন্যই কি আমাকে তুমি কখনও তোমার বাসায় নিয়ে যাওনি৷ এসব কেন শুনাচ্ছো এখন?

যাতে তুমি আমাকে ঘৃণা করো৷ বলিনি কারণ তখন আমি তোমাতেই অন্ধ ছিলাম৷ বলিনি কারণ আমি একটা প্রতিষ্ঠা চাইছিলাম৷ বলিনি কারণ তখন মনে হয়েছিল তোমার ভালবাসায় আমি আমার আমিত্ব কে জয় করতে পারবো…

দোলা উঠে দাঁড়ালো৷ বলল বাবুই আমি যাই৷ অনর্থক এসব কথা আমি শুনতে চাইছি না৷ তুমি আমাকে আসলে ভালবাসনি৷ বাসলে….

দোলা একটু বসো৷ আরেকটা কবিতা শুনে যাও৷ দোলা বসলো না৷
সন্ধ্যে হয়ে আসছে৷ বাবুই এর আবোলতাবোল শুনতে ভাল লাগছে না আর! সম্পর্কের মাঝে সম্পর্কের টানাপোড়েন তার ভাল লাগেনা৷
উত্তাল ভালবাসার ক্ষণ গুলোই স্মৃতি হয়ে থাক! প্রথম হাত ধরা প্রথম চুম্বন বৃষ্টির শীতল ফোঁটা আঁধারের চা , এসবই থাক৷ পিতাহীন অন্ধ আবেগের শেষটা সে চায় না৷

হাঁটা হলো না বাবুই আর দোলার ৷ শেষ হাঁটাটা অসম্পূর্ন  রেখে দোলা আঁধারে হারালো৷

বাবুই বলল
আমি বর দিনু দেবী
তুমি সুখী হবে
ভুলে যাবে সর্ব গ্লানি
বিপুল গৌরবে…..

 

দোলার বিয়ে কাল৷ দোলার বাবা অফিস থেকে ছুটি নিয়েছেন৷ সকালের কড়কড়া পেপারটা পড়ার অনেক দিনের অভ্যেস তার৷

পেপার হাতে নিয়ে চায়ে চুমুক দিলেন৷ একটা খবর দেখে নিজেই বলে উঠলেন এসবও এখন খবর হয় তাহলে পত্রিকায়!

দোলা তখন বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে৷ তাদের তে তলার বারান্দায়৷ আজ প্রকৃতি কুয়াশাময়৷

দোলা বাবাকে জিজ্ঞেস করলো কি খবর বাবা?

তিনি বললেন মা’রে দেশে কত পাগল যে আছে৷

কেন বাবা কি হলো ? খবর টা কি বলো তো৷ একটু শুনি৷

আরে প্রেমে ব্যর্থ এক পাগল দু’দিন ধরে চারুকলার শুকনা পুকুরের চারপাশে ঘুরছে আর বলছে … সে আসবে৷ আমি তার জন্যে… এসব হাবিজাবি আরকি!

দোলা বলল পাগলের নাম কি বাবা? পত্রিকাওয়ালারা নিশ্চয়ই দিয়েছে৷
অদ্ভুত নাম রে মা! অদ্ভুত নাম৷ পুরুষ মানুষের এমন নাম হয় জানতাম না৷

দোলা অস্থির হয়ে বলল কি নাম বাবা বল না৷

বাবুই৷ বাবুই নাম ছেলেটার!

কথা নেই বার্তা নেই দোলা ঠাস করে মেঝেতে পড়ে গেল৷ দোলার বাবা এত দ্রুত উঠে দাঁড়ালেন যে তার চায়ের কাপ উল্টে পড়ে ভেঙে গেলো ৷ ছড়িয়ে পড়লো চা৷

 

মহিউদ্দীন থানায় গেলেন৷ অপ্রকৃতস্থের মতো আচরণ করা ছেলেটাকে ছাড়িয়ে আনতে৷ পুলিশের সাথে কথা বলে সব ব্যবস্থা করলেন৷

কর্মরত অফিসার বললেন হুদাকামে এসব ভেগাবন্ডদের ছাড়িয়ে নিচ্ছেন৷ হালারপো হুকনা পুকুরের চাইরপাশে আজাইরা দুইদিন ধইরা ঘুরতেছিল৷ পাবলিক প্রথমে মজা পাইছে মজা শেষ হইলে পুলিশরে খবর দিছে৷

হালার পো হালা৷ ডলা দিলে সব বুজরুকি বাইর হয়া যাইতো৷ মাগার উথাল পাথাল জ্বর৷ আপনে আইছেন ভালো হইছে৷ নাইলে আমাগোই আবার হাসপাতালে নিতে হইতো!

 

বাবুই এলোমেলো পা ফেলে ফুটপাতে হাঁটছে৷ ওর পা খালি৷ স্যান্ডেল কোথায় জানেনা সে৷ মধ্যবয়স্ক মোটা কাঁচের চশমা পড়া এক লোক এলোমেলো পা ফেলে চলা বাবুই কে ধরলেন পেছন থেকে৷ বললেন বাবা তুমি এমন করছো কেন? আমি তোমার জামিনের ব্যবস্থা করেছি৷ আমি দোলার বাবা!

রক্ত বর্ণ চোখে মহিউদ্দীনের দিকে তাকালো বাবুই বলল আব্বা আপনে আসছেন৷ এত বছর পর আসছেন৷ আমারে আর মায়েরে থুইয়া আপনে ক্যান গেছিলেন গা৷ মা বলছে আমারে ! দোষ তো ছিল না তার৷ হারামী গুলা মায়েরে…. জ্ঞান হারালো বাবুই৷

 

মিডফোর্ড হাসপাতালের চারশ তিন নম্বর কেবিন৷ বাবুই অচেতন হয়ে পড়ে আছে৷ অবস্থা ভাল না৷ মহিউদ্দীন বাবুই এর হাত ধরে বসে আছেন৷ মনে মনে বলছেন আল্লাহ ছেলেটারে তুমি সুস্থ করে তোল…

আজ মহিউদ্দীনের মেয়ে দোলার বিয়ে৷ কিন্তু কোন এক বীরাঙ্গনার পুত্রকে একা ফেলে চলে যেতে কিছুতেই তার মনটানছে না৷

(সমাপ্ত)

-পলাশ পুরকায়স্থ 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *