বইমেলায় এলো বেলার ‘আঁধারে আয়না’

“…… চেনা মুখগুলো রাতের আঁধারে আয়নার সামনে কত অপার্থিব, কত ঐশ্বরিক!
আঁধারের আয়নায় দাঁড়িয়ে প্রতেকটি জীবনের প্রতিচ্ছবি ভয়ংকর। আয়নায় নিজের ছবির মতো যদি জীবনের সমস্ত অতীতের সামনাসামনি হতে হয় তবে তা আয়নার প্রতিচ্ছবির মতোই ভয়ংকর। বারবার একটা প্রশ্নই নিজেকে গ্রাস করবে, ‘এই কি আমার জীবন?’……. “

এই কথাগুলো “অমর একুশে বইমেলা ২০২০ একটি উপন্যাসের।

বই : আঁধারে আয়না
লেখকঃ বেলা প্রধান
(সাবিনা ইয়াছমিন বেলা )
ধরণ: উপন্যাস
প্রকাশকঃ প্রিয় বাংলা প্রকাশনী
প্রচ্ছদ : মোঃ জাকির হোসেন।

” আঁধারে আয়না ” উপন্যাসের কিছু অংশ।

“………ঘন অন্ধকারে মীরা হাঁটছে। রাস্তার দু’পাশে ঘন জঙ্গল। প্রচন্ড ভয় আর আতঙ্ক তাকে গ্রাস করে আছে। সমস্ত প্রাণশক্তি দিয়েও সে দৌঁড়াতে পারছে না। হঠাৎ সে লক্ষ্য করলো তার গায়ে কোন কাপড় নাই। আতঙ্ক অস্থিরতায় এতক্ষণ তা বুঝতে পারেনি।

সে থমকে দাঁড়ালো। ডান পাশে ঝোপের আড়ালে মুখ চেপে ধরা কোন মেয়ে চাপা স্বরে আর্তনাদ করছে। ভয়ঙ্কর সে আর্তনাদ শুনে মীরার কলিজা শুকিয়ে আসছে। সে এখন কি করবে?
তখনি পিছন থেকে কেউ মীরার পিঠে হাত রাখলো। আতঙ্কে চিৎকার দিয়ে সে পাশ ফিরলো। পাশে গভীরভাবে ঘুমিয়ে থাকা কবিরের হাত আচমকা তার পিঠে পড়েছে বলে মীরার ঘুম ভেঙ্গেছে । মীরা বুঝতে পারলো সে ভয়ঙ্কর একটা স্বপ্ন দেখছিল।
প্রচন্ড পানি তেষ্টা নিয়ে সে বিছানা ছেড়ে নামতে গিয়ে লক্ষ করলো হুবহু স্বপ্নের মতো করে কাছেই কোথাও কষ্টকর সেই চাপা আর্তনাদ করছে।

মীরা যেখানে শুয়ে আছে বিছানার সে অংশ দেয়ালের সাথে আটানো। পায়ের কাছেই ভারী পর্দা ঝুলানো বড় জানালা।সে পর্দা সরিয়ে পাশের বিল্ডিং এর আবছা অন্ধকার জানালার দিকে তাকালো। ঠিক তখনোই শব্দটা থেমে গেলো। পাতলা পর্দায় উলঙ্গ একটা পুরুষ মুর্তির ছবি দেখা গেলো। মীরা খানিকটা অবাক হলো,শব্দটা এতক্ষণ এই রুম থেকেই আসছিলো। তার জানামতে সে ফ্লাটে বিশ-বাইশ বছরের এক রুপবতী তরুণী একা থাকে। তার তিনতলা ফ্লাটের এক চিলতে বারান্দা বরাবর মেয়েটির বারান্দায় কাপড় শুকাতে সে দেখেছে। কখনও কোনো পুরুষ চোখে পড়েনি।

মীরা চিন্তিত মুখে সাবধানে বিছানা থেকে নামলো। ডাইনিং রুমে এসে গ্লাসে পানি ঢালতে গিয়ে তার মনে হলো ফ্রিজের ঠান্ডা পানি খেতে পারলে ভালো হতো। কিন্তুু তার সংসারে এখনও ফ্রিজ আসেনি। তবে একদিন আসবে। ডাইনিং এর পশ্চিমের দেয়ালে নিচের দিকে ফ্রিজের একটা প্লাগ পয়েন্ট করা আছে। কবির তাতে ভালোকরে স্কচষ্টেপ দিয়ে আটকিয়ে দিয়েছে, যাতে অপু ওটাতে হাত দিতে না পারে।

তাদের দেড় বছরের অপু এখনো হাঁটতে শিখেনি। অনেক বাচ্চা ন’মাসেই হাঁটে বলে সে শুনেছে। কিন্তুু তাদের অপুর বেলায় কেন যে এত দেরি হচ্ছে! সেদিন অপু খাট ধরে দাঁড়িয়েছিল। খুশি হয়ে মীরা হাত বাড়িয়ে দিলো। অপু তার চার দাঁতের হাসি দেখিয়ে খাট ছেড়ে হামাগুড়ি দিয়ে এসে মায়ের হাত ধরলো। মীরার মনটা খারাপ হয়ে গেলো। ইদানিং মীরার ছোট ছোট কারনে মন খারাপ হওয়ার অসুখ হয়েছে। এই যেমন গতকাল কবির অফিস যাবে রেডি হচ্ছে তখনি অপু পাশের ঘরে বা বা বলে উঠলো। মীরা বাবুকে কোলে করে কবিরের সামনে গিয়ে বলল,
‘বল মা বাবু আরেকবার ‘বাবা’। অপু আর কিছুতেই বলল না। যতবার বলতে বলা হয় ততবারই দাঁত বের করে হাত তালি দিতে থাকে। কবির খানিকটা বিরক্তি নিয়ে বলল,
‘বিরক্ত করছ কেন? যাও মোজা জোড়া একটু খোজ কর’
সঙ্গে সঙ্গে মীরার মনটা খারাপ হয়ে গেলো। লোকটার এত ব্যস্ততা যে বাবুকেও ঠিকভাবে একটু কোলে নিয়ে আদর করার সময়ও পায়না। এন, জি, ওর এসব চাকুরী মানুষ করে!

‘কে বউ? এত রাইতে কি কর?’
মীরা চমকে উঠলো। ডাইনিং এর অপর পাশের রুমে তার শ্বাশুড়ি রাত জেগে তাহাজ্জুদ নামাজ পড়েন।মীরা শ্বাশুড়ির ঘরে উঁকি দিল।
‘কিছু বলবেন আম্মা?’
‘এত রাইতে খাওনের ঘরে কর কি?’
‘পানি পিপাশা হয়েছিল’
‘ঘরে পানি নিয়া রাখবা। যেমন তেমন শরীরে খাওনের ঘরে যাইতে নাই। আর শোনো শরীর ভাল থাকলে আমারেও একগ্লাস দিয়া যাও। নাপাক গায়ে দিবানা। নামাজ- কালাম চলতাছে,বুইঝা শুইনা আমার ঘরে ঢুকবা।’
মীরা শ্বাশুড়িকে পানি দিয়ে রান্না ঘরে গেলো। ঘুম কেটে গেছে। এক কাপ চা খেতে ইচ্ছা করছে। কবির জেগে থাকলে ভালো হতো। চা খেতে খেতে গল্প করা যেত। কিন্তুু তা কখনো হয়না। সে যতটা ঘুম বিবাগী কবির ততটাই ঘুমকাতুরে।

চা হাতে নিজের ঘরে ঢুকে মীরা অবাক হয়ে চেয়ে রইল। পর্দা সরানো জানালা দিয়ে শেষ রাতের জোসনা পরেছে কবিরের মুখে। কি অদ্ভুত সুন্দরই না তাকে লাগছে! অথচ কবির যেদিন তাকে দেখতে গেল,মীরার সেদিন তাকে মোটেই পছন্দ হয়নি। শুধু কি একা তার, মাহী’ও পছন্দ হল না। মাহী মীরার আড়াই বছরের ছোট। বাড়ির একমাত্র মাথাভাঙ্গা ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাড়িয়ে সে যখন সাজগোজ করছে,মাহী ঘড়ে ঢুকে বিছানায় পা ঝুলাতে ঝুলাতে বলল,
‘আপা, এই ছেলে নম্বর পেয়েছে দশে দুই’
মীরা হেসে ফেললো। যখনই কোন ছেলে তাকে দেখতে আসে,মাহী চুপি চুপি আড়াল থেকে দেখে এসে তাকে মার্কিং করবে। তার নিজের দেয়া একটা স্কেল আছে,’দশ’। ছেলেকে দেখে সে মার্ক দেয়। মার্ক সবসময়ই হাস্যকর হয়।
মাহী আবার বলল,
‘ছেলের সাথে তার চাচা এসেছে, তার মার্ক ‘চার’।’
মীরা হাসি চাপিয়ে বলল,
‘তাহলে চাচাকেই বিয়ে করে ফেলি কি বলিস?’
মাহী গম্ভির মুখে বলল,
‘চাচা স্মার্টের দিক থেকে দু’নম্বর বেশি পেয়েছে। দুলাভাই হিসাবে নয়।’
মাহী পিছন থেকে এসে মীরার মাথায় কাপড় তুলে দিতে দিতে বলল,
‘আপা, এই সামান্য কলাপাতা রঙ্গের সুতি শাড়িতে তোকে তো অপ্সরীর মতো লাগছে। তোর জন্য লাগবে দশে দশ পাওয়া ছেলে।’

মীরা, মাহী বসে আছে ছেলের সামনের দুই চেয়ারে। ছেলে আর তার চাচা বসে আছে তাদের সামনের সোফায়। অতি পুরানো সোফার কোণের কাপড় খানিকটা ছেড়া। ছেলে গভীর মনোযোগে সোফার ছেড়া অংশের দিকে তাকিয়ে আছে। ছেলের চাচা ধবধবে সাদা পাজ্ঞাবি পরেছেন। মাথার সাদা চুলে মেহেদী দিয়ে টকটকে লাল করা হয়েছে। মুখে পান নিয়ে তিনি অর্নগল কথা বলে যাচ্ছেন মীরার মামা মবীনউদ্দিনের সাথে। কথা বলার সময় তার মুখ থেকে পানের রস ছিটকে পড়ছে তার সাদা পাজ্ঞবিতে। মামার পাশে মা জাহানারা বেগম উদ্বিগ্ন মুখে চুপচাপ বসে আছেন। দু’একটা কথার উত্তর মাঝে মাঝে মামাই দিচ্ছেন। হঠাৎ ছেলের দিকে তাকিয়ে ছেলের চাচা বললেন,
‘কি রে তুই কথাবার্তা বলছিস না কেন? মেয়ে দেখতে এসেছিস, সিনেমা দেখতে তো আাসিস্ নাই যে কথা বলা যাবেনা, পাশের দর্শকের অসুবিধা হবে।’
ছেলের মনোযোগ বিচ্ছিন্ন হল। আরও কিছুটা সময় নিয়ে মীরার দিকে না তাকিয়েই ছেলে বলল,
‘আপনার নাম কি?’
মীরা কথার উত্তর দেবার আগে মাহী তার কানে কানে বলল,
‘আপা, ছেলে তো এক সপ্তাহ দাঁত মাজে নাই। হলদে দাঁত দেখেই বোঝা যায়। একে বিয়ে করলে রোজ সকালে ব্রাস হাতে হা করিয়ে তোকেই দাঁত মেজে দিতে হবে। ‘
ঠিক তখনই মামা ধমক দিলেন,
‘মাহী কি করছিস?’

মীরা তার নাম বলল। এই একটা প্রশ্নের উত্তরেই মীরা পাশ করল। ছেলের চাচা গল্পের এক ফাঁকে ছেলের সাথে গুটুর গুটুর করে কথা বললেন। তারপর একটু আড়ালে গিয়ে ছেলের মা’কে ফোন করলেন। সন্ধ্যারদিকে ছেলের মা আংটি নিয়ে হাজির হলেন। রাত আটটার মধ্যে পানচিনি পর্ব হয়ে গেল। জাহানারা বেগমের উদ্বিগ্ন মুখে অস্থিরতা চলে এলো।….. “
।।।।।।

আসুন বইটি সম্পর্কে লেখকের নিজের কিছু কথা শুনি :

“……..আমার মা প্রায়সই বলেন, ‘অনেকগুলো ছেলেমেয়ের মধ্যে কোন একটা সন্তান বাবা-মায়ের জীবনের দুর্ভাগ্যগুলো বহন করে।’ বিষয়টা আমি জানিনা। আমি জানি জিনগত কারণে সন্তান তার পিতা-মাতার কিছু বৈশিষ্ট্য, গুণাগুণ নিজের ভিতরে বহন করে।
আসলে বৈশিষ্ট্য, গুণাবলি আর দুঃভাগ্য তো এক বিষয় নয়, তাইনা? ‘আঁধারের আয়না’য় আমার মায়ের কথাটার প্রকাশ ঘটেছে। রহস্যময় প্রকৃতির আমি কিছুই জানিনা। জানার দুঃসাহসও আমি করতে পারিনা। অনেক জ্ঞানী গুণী, মহামানুষ এ জগতে আছেন যারা এই সৌভাগ্য নিয়ে এসেছেন। আমি বিশেষ করে তাদের কাছে ক্ষমা চাইছি, লেখায় আমার ভুল আর অজ্ঞতার জন্য।

বাইশ বছর আগে লেখা শুরু করেছিলাম। পূর্নাঙ্গ বই এসেছে এবারের বই মেলায়। এতদিনের সাধনা যখন বাস্তবে সফলতার রূপ নেয় তখন মনের মাঝে কি হয়, শব্দে প্রকাশ করা যায় না।
সকলের কাছে আমি দোয়া প্রার্থনা করছি।
।।।।
বইটির মুদ্রিত মূল্য: ১৬০ টাকা।
প্রি অর্ডার মূল্য: ১২০ টাকা।

৪০% ছাড়ে বইটি পেতে লেখিকাকে সরাসরি ইনবক্সে নক করতে পারেন।

লেখা-মনিরুল ইসলাম চঞ্চল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *