জরু হেটে যাচ্ছে নিজ গ্রামের ধান ক্ষেতের আইল দিয়ে। তার পিছে পিছে চলছে মদখোর মইদুল। সর্বক্ষণ মদের নেশায় চুড় হয়ে থাকতে চায় বলে সবাই তাকে আড়ালে মদু বলে ডাকে। জরু এক বোতল মদের বিনিময়ে একটি স্কুল দখল করে নিতে পারবে এটা স্বপ্নেও কল্পনা করে নি। রাতে মদুর কর্মদক্ষতায় সে খুব মুগ্ধ। এখন চলছে আবার মদের আড্ডায়। আজ সে মদুকে ভরপেট মদ খাওয়াবে। সকালে মাস্টার এসে আরো সুখের খবরটা দিয়ে গিয়েছে। জরুর ধারণা ছিল সুজয় সহজে হাল ছাড়বে না। কিন্তু বাস্তবে হলো সম্পূর্ণ ভিন্ন। সুজয় সকাল বেলা কারো সাথে দেখা না করে গ্রাম ছেড়েছে। সবার ধারণা সে আর স্কুলের ধারে কাছেও আসবে না। জরু অবশ্য তাই কামনা করে।
মদুকে নিয়ে জরু ছলুর বাড়ি হাজির হয়। ছলু এ এলাকায় একমাত্র অবৈধ মদ বিক্রেতা। সে বাড়ির বাইরে থেকে ছলুকে ডাকতে থাকে।
– ছলু বাড়ি আছত?
– কে?
– — মারানির পোলা বাইরে আইয়া দেখ। কে আইছে? কুত্তার বাচ্চা ঘরেত্তে চিল্লায়। সাহস দেখছস?
মদু জরুর উৎসাহ পেয়ে দ্বিগুণ স্বরে গালি দেয়া শুরু করে। তার স্টক প্রায় খালি হয়ে আসে। ছলু ঘর থেকে বের হয়ে আসে। বের হয়েই কষে চড় খাওয়ার মতো মাথাটা পেছন দিকে ফিরিয়ে নিতে চায়। এটা তার কপালে আরো দুর্গতি ডেকে আনে। জরু মদুকে বলে,
– ছলুরে ধইরা নিয়া আয় আমার কাছে।
মদু সত্যি সত্যি ছলুর ঘাড় ধরে তাকে নিয়ে আসে জরুর কাছে। তার সামনে ছলুর মাথা আসার সাথে সাথে কষে এক থাপ্পর মারে জরু। ছলুর ঠোট কেঁটে রক্ত বেরিয়ে আসে।
– কুত্তার বাচ্চা তরে এতক্ষণ ডাকতে অইল কেন?
– ভাই, খাইতাছিলাম।
– তুই মদ বিক্রি করছ?
উত্তর দিতে পারে না ছলু। চুপ করে থাকে সে। সে জানে জরুর যা বলার বলবে।
– শোন, মদুরে আউজগা পেট ভইরা খাওয়াবি। কিন্তুক টাকা পয়সা চাইতে পারবি না।
নিরবে মাথা নাড়ে ছলু।
জরু ছলুর বাড়ি থেকে বের হয়ে বাজারের দিকে রওয়ানা হয়। বাজারে গিয়ে চায়ের দোকানে জম্পেস আড্ডা দেয় সে। দু’হাত উজার করে খরচ করে সে। সবাইকে ডেকে চা খাওয়াতে থাকে। তার আজ খুব শান্তি শান্তি অনুভব হচ্ছে। অনেক দিনের আশা পূরণ হয়েছে তার। আজ সে স্কুলের মালিক। এক সময় বাড়ির পথ ধরে। বাড়ি গিয়ে স্কুলের মাস্টারকে ডেকে পাঠায়।
– কি খবর মাষ্টর? স্কুলের আয় উন্নতি কিরম?
– ভাই ভালোই হয়।
– ভালো টালো বুঝি না। আমার লগে টালটি বাজি অইব না কইলাম। টেহা নিয়া মামদোবাজি অইলে কিন্তুক আপনের খবর কইরা ছাড়ুম।
– ঠিক আছে ভাই। আপনি যেভাবে বলবেন তাই হবে।
– স্কুলের হিসাব কহন দিবেন?
– ভাই, স্কুলের হিসাবতো পরীক্ষার পর হয়।
– আইচ্ছা কন তো ইস্কুলে কয়জন লেহাপড়া করে?
– দুইশ জনের বেশি।
– ঠিক কইরা কন। এক টেহা পর্যন্ত আমারে হিসাব দিবেন। এতোদিন যেই রহম বুঝাইছেন অহনও হেইরহম বুঝাইবেন, মুনো থাকব?
– জ্বী ভাই
অহন যানগা।ইস্কুল ভালা মোতন চালাইয়েন।
নুরা অনেকদিন পর স্কুলের হিসাব নিয়ে বসেছে। মাস্টার সাহেব তাকে হিসেব করে টাকা বুঝিয়ে দেয়। টাকা নিয়ে বেরিয়ে যাবার সময় পেছন থেকে মাস্টার সাহেব বলেন,
– ভাই, একটা কথা বলতে চাই, কিছু মনে করবেন নাতো?
– আইচ্ছা কন, কিছু মুনে করুম না।
– স্কুলটা কি আপনার বাবা দিয়ে ছিলেন?
– কি কইতে চান?
– লোকজন এখন অনেক কিছু বলছে আজকাল।
– এইগুলান হুননের কোন কাম নাই আপনের। আপনের কাম অইল ছাত্র পড়ানো। হেইডাই করেন মাষ্টর।
– তারপরও একটু সমজে চলবেন।
– যান মাষ্টর, বেশি গেন দিয়েন না।
স্কুল থেকে বের হয়ে বাড়িতে ঢুকে সে। তার ছেলেমেয়েদের সাথে স্বাভাবিক কোনো সম্পর্ক নেই। সে চেষ্টা করে নি কখনো তার কোন সন্তান ভালোভাবে লেখাপড়া করুক। সে জানে পড়ালেখা মানে তার বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত স্কুলে পড়া। সে সারাক্ষণ টাকা কামানোর নেশায় ব্যস্ত থেকেছে। নিজে লেখাপড়া করে নি। তার বাপের খেলাফতি সে গ্রহণ করেছে মনেপ্রাণে। সে এতোদিন বিশ্বাস করে এসেছে পেশিশক্তির বাইরে কোন শক্তি নেই। কিন্তু শাহরিয়ার সাহেবের সামনে গেলেই তার হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসতে থাকে। এবার সাহেবের সামনে দাড়িয়ে মনে হয়েছে, সে সাহেবের তুলনায় নস্যি।
রহিমউল্লার বাড়ি সুজয়ের বাড়ির ঠিক পাশেই। বাড়ি থেকে বের হলেই তার চোখ আটকে থাকে বাড়িটিতে। তার দৃষ্টিতে বাড়িটি সারাক্ষণ জ্বলজ্বল করে জ্বলছে। যে অপার্থিব আলো অন্য কারো চোখে ধরা দেয় না। ছিমছাম একটি দোতলা বাড়ি। চারদিকে তিনফুট উচু ইটের দেয়াল। দেয়ালের উপর গ্রিল দেয়া তিনফুট। গ্রিল নানা প্রকার লতায় আচ্ছাদিত। দূর থেকে দেখলে মনে হয় একটি সবুজের দেয়াল। রহিমউল্লার চোখের সামনে তৈরি হয়েছে বাড়িটি। সুজয় চাচা অক্লান্ত পরিশ্রম করে একটু একটু করে শেষ করেছেন বাড়িটি। সারা জীবন সততার কথা বলেছেন। সেই চাচার সাথে তার ভাই বেঈমানী করেছে চরমভাবে। কিন্ত আল্লাহ চাচাকে দিয়েছেন উদার হস্তে। এখন তার একমাত্র ছেলে অঢেল টাকার মালিক। ঢাকায় সে নাকি বিশাল এক বাড়ি করেছে। রহিমউল্লা বাড়ির পাশে দাড়িয়ে স্মৃতি হাতড়ে বেড়াচ্ছিল। চাচার সাথে তার সম্পর্কটা খারাপ ছিল না। এখন তার কথায় অনেক মূল্য। তাকে কিছু করতে হবে। সে তার মেয়ের বাড়ির দিকে হাঁটতে থাকে আনমনে।
নুরার বাড়িতে ঢুকে রহিমউল্লা। নুরা ঘরেই ছিল। রহিমউল্লা সরাসরি কাজের কথায় চলে আসে।
– নুরা, তুই আবার ঢাহা গেছিল?
– হ কাহা।
– কি খবর? তুই আমারে কিছু জানাইলি না কেন?
– খুব খারাপ খবর আছে।
– তুই অহনো আমারে জানাস নাই কেন? তুই কি মুনে করছ সব কিছু সামাল দেয়ার ক্ষেমতা তর আছে?
– কেন, পারুম না কেন? আসুক না সে, আমি দেইখ্খা লমু তারে।
– তর বাপ আছিল একটা অমানুষ, তুই অইছস অমানুষের বাচ্চা ডবল অমানুষ।
নুরা মাথা নিচু করে থাকে। তার শ্বশুরের কথার উপর কথা বলার সাহস কিংবা হিম্মত কোনটাই তার নেই।
– অহন ক, কি কি করতে কইছে তরে?
– মাহফুজ বড় বাবার জমি কার কার দখলে আছে তাগো নামের লিস্ট চাইছে।
– আরে বলদা, এটা তর কাছে চাওন লাগে নাহি? কয়দিন আগে আমগো জেলার ডিসি কে আছিল জানছ?
– কে আছিল?
– তুই না হের লগে দেহা করছিলি?
– আপনে জানলেন কেমনে?
– আরে তুইত একটা কাউয়া। মাইয়া বিয়া দিয়া ঠেকছি। তর সব খবর আমার রাহন লাগে। তুই যার লগে দেহা করনের লাইগ্গা। দুইন্না ধইরা ঘুরছস হেয় আমগো মাস্টার চাচার মেয়ের জামাই।
নুরা বসা থেকে লাফ দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ে। তার চোয়াল ঝুলে পড়ে। সে হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে তার শ্বশুরের দিকে।
– তয় আমারে কন নাই কেন?
– তুই কি আমারে জিগাইছস? তরা কি কোন বালা কাজ করছ।
– অহন আমার কি অইব?
– কিছু অইব না, আমার কতা মোতন কাম করতে পারবি?
– হ কন, আমি সব করমু। তয় কাহা, হেগো ফেমিলিতে পুলিশ আছে মুনে হয়।
– তুইত খালি থাহস ধান্ধাবাজিতে, মুনে করছ গ্রামের ক্ষেমতা পাইলেই সব অইয়া গেলগা। তর মোতন জাউরা পোলা দুইন্নায় আছে কিনা সন্দেহ আছে। মাস্টার চাচার পোলার বউ পুলিশের অনক বড় অবিসার।
– ও কাহা কন কি? আপনের কাছে মাপ চাই, আমারে মাপ কইরা দেন।
– আরে আমারতে মাপ চাইলে অইব না। চাচীর পায়ে ধইরা মাপ চাইলে কিছু অইবার পারে।
– তয় আপনে আমারে লইয়া যান। কাহা আমারে বাচান। হেগো বদ নজর পড়ছে আমার ইফরে।
– বদ নজর কছ কেমনে? বদ নজর ত তগো। তর বাপ চাচার স্কুলডা জোর কইরা দখল কইরা নিল। তুইও হেইডা হাত পাও ধইরা ফিরত দিলি না।
– কাহা, আমার সব নেন, আমারে বাচান। আমারে পুলিশে ধইরা নিয়া যাইব।
– তরে ধরব কেন?
– হ, বদুরে ধইরা নিয়া গেছিল।
– কই ধইরা নিছিল?
– ঢাহা, পুলিশ হেড কোয়ার্টারে।
– কি কছ? আমারে কইলি না কেন?
– আপনেরে কইতে ভুইল্লা গেছি।
– আমি চাচীর লগে আগে কতা কইয়া লই। হেরপর দেহুমনে।
শ্বশুরের কথায় নুরার মনে কিছুটা স্বস্তি এলেও তার শান্তি বিদায় নেয় মন থেকে। সে জীবনের প্রথম বার আল্লাকে স্মরণ করে।
চলবে——–
-বাউল সাজু