হৃদয়ে আগন্তুক (২য় পর্ব)

ডালাস সময় সকাল সাড়ে ১১ টায় এমিরেটস এয়ারলাইন্সের ফ্লাইট ল্যান্ড করল ডি এফ ডব্লিউ ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে। এরাইভাল লাউঞ্জে তিথি, হাসান আর তিতলি অপেক্ষা করছে রূপার জন্যে। ইমিগ্রেশনের ঝামেলা শেষ করে রূপার বের হয়ে আসতে আরো প্রায় এক ঘন্টা লেগে গেল। তিথি দূর থেকে রূপাকে দেখেই একটা বাচ্চা মেয়ের মত হাত নেড়ে ডাকল। রূপা বড় বড় পা ফেলে এগিয়ে এলো। কাছে আসতেই তিথি ওকে জড়িয়ে ধরল। তিতলি এগিয়ে এসে রূপার হাতে একটা ফুলের তোড়া দিয়ে বলল, ‘ওয়েলকাম টু ডালাস!’

রূপা তিতলিকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘থ্যাঙ্ক ইয়্যু!’ তারপর তিথির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোর মেয়ে এত বড় হয়ে গেছে? কত হলো বয়স?’

‘নয় বছর!’

‘নাইন এন্ড এ হাফ ইয়ার্স!’ তিতলি তার মা-কে শুধরে দিয়ে বলল।

রূপা হেসে ফেলল।

‘কেমন আছো রূপা? তোমার জার্নি কেমন হলো?’

রূপা তাকিয়ে দেখল হাসানকে। মিষ্টি করে হেসে বলল, ‘ভালো আছি হাসান ভাই। জার্নি বেশ ভালোই হয়েছে।’

‘কোনো সমস্যা হয়নি তো?’

‘না কোনো সমস্যা হয়নি।’

‘বেশ তাহলে চলো যাওয়া যাক।’

রূপার হাত থেকে বড় লাগেজটা নিয়ে নিল হাসান। তারপর সবাই মিলে পার্কিং লটের দিকে এগিয়ে গেল।

গাড়িতে লাগেজ ঢুকিয়ে হাসান যখন ড্রাইভিং সীটে বসতে যাবে, তিথি তখন হাসানকে বলল, ‘চাবিটা দাও, আমি চালাচ্ছি। তুমি তিতলিকে নিয়ে পেছনে বসো। রূপা তুই সামনে বস।’

হাসান হেসে দিয়ে তিতলিকে নিয়ে পেছনের সীটে বসল। রূপা একটু অবাক হয়ে সামনে গিয়ে বসল। তিথি গাড়ি স্টার্ট দিল। কিছুক্ষনের মধ্যেই এয়ারপোর্ট থেকে বের হয়ে হাইওয়েতে পড়ল।

ডালাসের আকাশে তখন ঝকঝকে রোদ। সূর্য  মাথার উপরে। মেঘও তেমন নেই। টেক্সাসের তাপ সহজেই অনুমেয়। যদিও গরম এখনো সেভাবে জেকে বসেনি। সবার মধ্যেই খুশি খুশি ভাব।

ইন্টারস্টেট হাইওয়ে-৬৩৫ ধরে দ্রুত গতিতে এগিয়ে চলেছে তিথির মিনি-ভ্যান। রূপা অবাক হয়ে দেখছে চারিদিকটা। বিশেষ করে ৬ লেনের হাইওয়ে, উঁচু উঁচু ফ্লাইওভার, একটি থেকে আরেকটি রাস্তার সংযোগ, বিকল্প রাস্তা, হাইওয়ের সংগে সার্ভিস রোড–এসব দেখে সে মোটামুটি ভাবে নিশ্চিত হলো যে যুক্তরাষ্ট্রের মহাসড়কগুলা সর্বাধুনিক, নিরাপদ ও যাত্রীসেবায় এগিয়ে রয়েছে অনেক তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

যোগাযোগ ব্যবস্থা একটি দেশের অর্থনীতির প্রতিচ্ছবি। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য উন্নত সড়ক-মহাসড়কের বিকল্প নেই। যাত্রী পরিসেবা তো বটেই, ব্যবসায়িক প্রয়োজনে অবিরাম ও নিরাপদ হাইওয়ে নির্মাণে বিশ্বের প্রতিটি দেশই মনোযোগী। দেশে দেশে হাইওয়ে বা মহাসড়কের দিকে তাকালে দেখা যাবে সেগুলো মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী, সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ও নির্মাণকৌশলে নির্মিত হচ্ছে। বিশ্বের কোনো দেশেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে স্থবির থাকে না প্রধান মহাসড়কগুলো—একমাত্র ব্যতিক্রম সম্ভবত বাংলাদেশ।

দেশের কথা মনে হতেই রূপার মনে হলে ঢাকায় একটা ফোন করে বলে দিতে হবে যে সে ঠিকমত পৌঁছেছে। রূপা তিথির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘দেশে একটা কল করা দরকার।’

‘এখনই করবি না বাসায় যেয়ে করবি?’

‘বাসায় যেতে আর কতক্ষন লাগবে?’

‘দশ মিনিট-এইতো প্রায় এসে গেছি।’

‘ঠিক আছে তাহলে বাসায় যেয়েই করব।’

ডালাস ডাউন-টাউন পার হয়ে তিথির মিনি-ভ্যান সোজা ছুটে চলল গন্তব্যে।

রূপার আসার উপলক্ষ্যে গতকাল রাতেই তিথি অনেক গুলো আইটেম রান্না করে রেখেছিল। যদিও রূপা অনেক ক্লান্ত ছিল তবুও সে বেশ মজা করেই খেল সবকিছু। দুপুরে খাওয়ার পর বিশ্রামে চলে গেল রূপা।

বিকেল গড়াতেই শুরু হলো চা-য়ের আড্ডা ব্যাকইয়ার্ডে বসে। তিথি আর রূপাই বেশী কথা বলছে। হাসান চায়ের কাপে চুমুকের ফাঁকে ফাঁকে দুই বান্ধবীর কথা শুনছে। তিতলি তার হুলা-হুপ নিয়ে একা একা খেলছে পাশেই।

তিথিদের বাসার পেছনেই বড় একটা লেক। লেকের ওপারে রোদ সরে যাচ্ছে–তাপও অনেকটা কমে এসেছে। ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে–স্বস্তির ছোঁয়া নিয়ে।

কোন কোন বিকেল খুব সুন্দর হয়। সূর্যের হলদে আলো পিছলে পড়ে সবুজ পাতা থেকে। আজকের বিকেলটাও তেমনি মনে হচ্ছে রূপার কাছে। রূপা তিথির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তোদের সংসার দেখে খুব ভাল লাগছে রে। দেখে তো মনে হচ্ছে বেশ সুখেই আছিস।’

‘তাই? দূর থেকে কাঁশবন ঘনই দেখা যায় বন্ধু।’

হাসান দুষ্টমি করে বলল, ‘এ কথার মানে কি তিথি? তারমানে কি, তুমি সুখে নেই?’

তিথি হাসানের কথার অবশ্য কোনো উত্তর দিল না। রূপা হেসে দিয়ে বলল, ‘কিরে, কিছু বল?’

‘সুখে আছি কিনা জানি না, তবে নিজের মত করে স্বাধীন ভাবে চলতে পারছি। এই তো কত!’

‘এখানে থেকে অন্তত এইটুকু বলতে পারছিস যে তুই স্বাধীন ভাবে চলতে পারছিস। এই স্বাধীনতা টুকুই বা ক’টা মেয়ের আছে আমাদের দেশে বল?’

‘সেভাবে দেখলে মনে হয়, এদেশে এসে ভালই করেছি। আমি যে একটা মানুষ, তার স্বাদটুকু অন্তত পরিপূর্ণভাবে উপভোগ করছি। মানুষের জীবন যে কত বড় আর সুন্দর তা এদেশে না এলে বুঝতেই পারতাম না।’

হাসান হাসি হাসি মুখ করে তিথির কথা বেশ আগ্রহ নিয়েই শুনছে। রূপাও তাকিয়ে থাকল ওর মুখের দিকে।

তিথি রূপার দিকে তাকিয়ে আবারো বলল, ‘তুই দ্যাখ, এখানে কেউ কাউকে নিয়ে মাথা ঘামায় না। ব্যক্তিগত বিশেষ কিছুর ওপর ওদের নজর আটকায় না। কেউ কাউকে আঘাত দিয়ে কথা বলে না। অযাচিত সন্দেহ করে না। স্বাধীনতা মানে যে কি, তা বাংলাদেশের মেয়েরা হয়তো কোনোদিনই বুঝতে পারবে না।’

তিথির সঙ্গে রূপাও যোগ করল। এ যেন তার মনের কথাই সব। সে বলল, ‘আমাদের দেশের মানুষগুলোর মন-মানসিকতা এতো ছোট যে কি বলবো! ক্রমশ তাদের বিবেক-বিবেচনা, চিন্তা-চেতনা দিনদিন সংকুচিত হয়ে পড়েছে। একটা ছেলে আর একটা মেয়ে মেলামেশা করলেই ধরে নেয় ওদের মধ্যে কিছু একটা হয়েছে… আচ্ছা, একটা ছেলে আর মেয়েতে কি স্রেফ বন্ধুত্বের সম্পর্ক হতে পারে না?’

এবার হাসান রূপার দিকে তাকাল। বোঝাই যাচ্ছে সে বেশ উপভোগ করছে ওদের দুজনের কথপোকথন।

রূপার ক্ষোভের পেছনে একটা কারন আছে সেটা তিথি জানে। তাই সে চুপ থেকে ওকে বলতে দিল।

রূপা আবার বলল, ‘একটা মেয়েকে একা দেখলেই রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে শিস দেবে। অরুচিকর কথা বলবে। আবার একটা ছেলের সঙ্গে দেখলেও…’ বলতে গিয়ে রূপার গলা কেমন ভারী হয়ে গেল। সে থেমে গিয়ে মাথা ঘুরিয়ে অন্যদিকে তাকাল। একটা চাপা ক্ষোভ স্পষ্ট হয়ে উঠল। কিছুক্ষন চুপ করে থেকে সে বলল, ‘একজন স্বাভাবিক চিন্তার মানুষ অন্যের সম্পর্ক নিয়ে কেন এত মাথা ঘামাতে হবে? তাদের কি আর কোনো কাজ নেই?’

তিথি রূপার কথায় সায় দিয়ে বলল, ‘ঠিকই বলেছিস, অন্যের ব্যাপারে মাথা ঘামানোর মত এমন বিরল প্রজাতির দেশ বোধ হয় পৃথিবীতে একটাই আছে। আমি ভেবে পাই না, গোটা একটা জাতি এমন ভাবে গড়ে উঠেছে কিভাবে? অদ্ভুত–ভীষণ অদ্ভুত, এদের ফিলোসফিও অদ্ভুত। এরা অন্যের সুখ সইতে পারে না–ঈর্ষাকাতর হয়ে পড়ে। নিজের স্বার্থে সামান্য আঘাত লাগলে এদের ভিতরে লুকানো কুৎসিত কদাকার রূপ বেরিয়ে আসে।’

এবার হাসান তিথির দিকে তাকিয়ে বলল, ‘দেখো, আমার মনে হয় ব্যাপারটাকে এভাবে জেনারালাইজড করাটা ঠিক হচ্ছে না। এটা ঠিক আমাদের দেশের কিছু মানুষের মধ্যে এই সহজাত স্বভাবটা আছে। পৃথিবীর সব দেশেই কিন্তু এই একই চিত্র তুমি দেখতে পাবে। এটা যে শুধু বাংলাদেশের সমস্যা তা কিন্তু না–ইট’স এ প্রব্লেম ফর হোল ইউনিভার্স!’

তিথি আর রূপা দুজনের কেউ আর কিছু বলল না। পরিবেশটা একটু ভারী হয়ে যাচ্ছে দেখে এবার হাসান মজা করে বলল, ‘আচ্ছা, তোমরা দেখছি প্রথম অধিবেশনেই দেশ ও জাতির বিরুদ্ধে লেগে পড়লে! এমন সুন্দর একটা বিকেল নষ্ট করছো সব ভারী ভারী কথা বলে। তারচেয়ে বরং চলো, রূপাকে নিয়ে কোথাও থেকে ঘুরে আসি।’

‘তোমার কাছে এসব ভারী কথা মনে হচ্ছে?’ তিথি একটু রেগেই বলল হাসানকে।

‘আরে বাবা এসব কথা তো বাইরে গিয়েও বলা যাবে।’

‘আচ্ছা চলো।’

ওরা সবাই মিলে বের হয়ে গেল।

তিথিদের বাসার থেকে মাত্র দশ-পনের মিনিটের দুরত্বে ছোট্ট শহর রকওয়াল। রকওয়ালের বিখ্যাত লেক রে-হাবার্ডের উপরে তৈরী হয়েছে একটি হারবার পয়েন্ট। ইদানিং পর্যটকদের অনেক আনাগোনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। লেকের পাড় ঘেঁষে অনেক হোটেল-রেস্টুরেন্ট আর দোকানপাট গড়ে উঠেছে। সিনেমা হল, কফি-শপ, বার কি নেই এখানে। খোলা আকাশের নীচে লাইভ কনসার্ট হয়। বিস্তৃত মাঠের সবুজ ঘাসে বসে সবাই গান শোনে। এই জায়গাটি তিথি আর হাসানের অনেক প্রিয়। ওদের বাসায় কোনো অতিথি এলে, তাকে প্রথম সুযোগেই নিয়ে আসা হয় এই লেকের ধারে।

হাসান সবাইকে নিয়ে এলো হারবার পয়েন্ট-এ। লেকের পাড় দিয়ে অনেকক্ষন ধরেই হাটছে তিথি, রূপা, হাসান আর তিতলি। তিতলি অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে যায়। বাচ্চা মানুষ। সে হাটা থামিয়ে একটা বেঞ্চে বসে পড়ল। কিছুদূর এগিয়ে গিয়ে তিথি দেখল তিতলি বসে রয়েছে। সে ফিরে এসে বসল মেয়ের পাশে।

হাসান আর রূপা কথা বলছিল। কথা বলতে বলতেই ওরা এগিয়ে গেল।

তিথি হঠাৎ করে লক্ষ্য করল, হাসান আর রূপা হাটতে হাঁটতে বেশ অনেকটা দুরে চলে গেছে। তারা নিজেদের মধ্যে কথা বলায় এতটাই মগ্ন যে ওদের দুজনের কেউ একবারের জন্যেও পেছনে ফিরে তাকালো না। হাটতে হাঁটতে একসময় হারবার পয়েন্ট সংলগ্ন লাইট হাউসের নীচে গিয়ে দাঁড়াল হাসান আর রূপা।

শেষ বিকেলের পশ্চিমাকাশে ডিমের কুসুমের মতো সূর্যটা তখন হেলে পড়েছে। ধীরে ধীরে হলুদ থেকে লাল হয়ে যাওয়া নির্জীব ও নির্মল সূর্যটার দিকে তাকিয়ে আছে ওরা দুজন।

সূর্য পশ্চিমাকাশে আজকের মতো বিদায় নেবার পূর্বে শেষ বারের মতো মেঘের মধ্য থেকে মাথা বের করে তার কুসুম বর্ণ রূপ দেখাবার জন্য আরেকবার উকি দিলো। তারপর আচমকাই যেন দিগন্তে ডুবে গেল।

প্রতিদিনকার মতই খুব সকালে উঠে তিথি তিতলিকে নিয়ে বের হয়ে গেছে। তিতলিকে স্কুলে নামিয়ে দিয়ে সে চলে গেছে কর্মস্থলে। হাসানের একটা কনফারেন্স কল ছিল সকাল সাড়ে সাতটায়–সেও উঠে পড়েছে। হাসান এক কাপ কফি বানিয়ে নিয়ে এসে তার অফিস রুমে ঢুকার আগে লিভিং রুমে গেল কিন্তু কর্ডলেস ফোনটা কোথাও খুঁজে পেল না। সে কপাল কুঁচকে নিজেকে জিজ্ঞেস করল, ‘ফোনটা গেল কোথায়?’ তখনি তার মনে পড়ল রাতে ঘুমানোর আগে রূপা ফোনটা নিয়েছিল দেশে কথা বলবে বলে। রূপা যেই রুমটাতে আছে সেদিকে একবার তাকিয়ে ধীর পায়ে তার রুমের দিকে এগিয়ে গেল হাসান।

দরজার কাছে গিয়ে সে আস্তে করে ডাকল—রূপা! কিন্তু রূপা কোনো সাড়া দিল না। সে দরজায় দু’বার টোকা দিল, তাতেও কোনো সাড়া পেল না। একটু ইতস্তত করে আস্তে দরজা সরিয়ে ভিতরে ঢুকে পড়ল হাসান এবং দেখল ফোনটা খাটের পাশের নাইটস্ট্যান্ডে পড়ে আছে।

রূপা গভীর ঘুমে–ওর ঘুম যেন ভেঙ্গে না যায় তাই খুব সন্তর্পণে বিড়ালের মত পা ফেলে কোন রকম শব্দ না করে ফোনটা নিয়ে ফিরে আসার সময় হাসানের চোখ পড়ল রূপার ঘুমন্ত মুখের উপর। জানালার পর্দার ফাঁক গলে এক চিলতে রোদ রূপার শরীরের উপর দিয়ে চলে গেছে। এবার তার দৃষ্টি গিয়ে পড়ল বাকা হয়ে শুয়ে থাকা রূপার শরীরের উপর। পায়ের উপর থেকে তার নাইটির কিছু অংশ সরে গিয়ে ফর্সা পা বেরিয়ে আছে। হাসানের পায়ে যেন কেউ পেরেক ঠুকে দিল। অনেক চেষ্টা করেও সে নিজের পা দুটোকে নাড়াতে পারছে না।

হাসান মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইল।

(চলবে…)

  • ফরহাদ হোসেন
    লেখক-নির্মাতা
    ডালাস, টেক্সাস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *