হরণ

“বান্ধবীর বাসায় দাওয়াত ছিলো, আমি আর আমার মেয়ে এসেছি। আমার হাজব্যান্ড ইন্ডিয়া গেছে ব্যবসায়িক কাজে, নয়তো সেও আসতো, বান্ধবী আমাদের তিনজনকেই দাওয়াত করেছে।

আমার বান্ধবী পাপন খুব ভালো রান্না করে, বিশেষ করে পিৎজা এত ভালো বানায়! পাপন আন্টির বাসায় বেড়াতে যাওয়ার কথা শুনলে মেয়েও দারুন খুশি মনে রাজি হয়ে যায়। এমনিতে সে কারো বাসায় দাওয়াতে যেতে চায় না। দাওয়াত মানেই তো বড়দের খাওয়া দাওয়া, তারপর গসিপ আর ছোটরা সবাই যার যার ট্যাব নিয়ে ব্যস্ত। আমার মেয়ে এসব পছন্দ করে না। সে পছন্দ করে বরফ পানি খেলতে অথবা লুকোচুরি খেলতে। এখনকার বাচ্চারা এসব খেলে না। ট্যাবে গেমস খেলেই তো সময় পায় না।

আমার মেয়ে খুব করে পিৎজা খেলো, সাথে কোক। তার কোক খাওয়া মানা, কোক দিয়ে টয়লেট পরিষ্কার করা যায় -ব্যাপারটা দেখার পর থেকে ওর কোক খাওয়া বন্ধ করা হয়েছে। কিন্তু আজকে আমার সাথে এখানে আসতে রাজি হয়েছে বলে কোকটা ট্রিট হিসেবে দেয়া হয়েছে।

মেয়ের বাবা ইন্ডিয়া যাবে শুনেই ড্রাইভার ছুটি নিয়েছে। গাড়ি না থাকায় রাতের দাওয়াতে যাওয়া আমার জন্য সত্যি মুশকিল ছিলো। সূর্য ডোবার পরে একা একা এই গলির ভেতর পাপনের বাসায় আসা সাহসের ব্যাপার, অন্ধকার জায়গায় ভূতের উপদ্রপ থাকে। মানে, গাড়ি থাকলে ভয় নেই, কিন্তু আমার তো সাথে গাড়ি নেই। একবার ভেবেছিলাম আসবো না, কিন্তু মেয়েটা ফাইনাল পরীক্ষার পরে বাসায় থাকতে থাকতে বোর হচ্ছিলো। পাপনের মেয়ে ওজস্বীর সাথে ওর বেশ ভাব কারন দুজনেই লুকোচুরি খেলতে পছন্দ করে।

খাবার পরে আড্ডা দিতে দিতে বেশ রাত হয়ে গেলো। রাত ঠিক দশটায় আমার একটা ওষুধ খাবার কথা। সময়ের হেরফের হলে খুব মুশকিল। তাই ওদের বাসা থেকে বিদায় নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম।

পাপন বললো, এত রাতে একা একা যাবে? হিমু বরং এগিয়ে দিক।
হিমু পাপনের বর, আমারও বন্ধু। কিন্তু বেচারার জ্বর। সন্ধ্যা থেকেই দেখছি ওর বেড রুমে বাতি নিভিয়ে শুয়ে আছে।

আমি বললাম,না থাক, এই তো গলির মুখ থেকে সি এন জি নিয়ে নেবো।
ও বললো, কিন্তু বাইরে তো এখন ভূতরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। তোমাকে যদি বিরক্ত করে?
আরে না, এইটুকু রাস্তা যেতে ভুত আমাকে আর কি বিরক্ত করবে? এত চিন্তা করো না তো, এইটুকু আমরা মা মেয়ে হেঁটে চলে যেতে পারবো। সামান্য রাস্তা।

পাপনের ছোট বাচ্চাটা বিরক্ত করছিলো, ঘুমাবে। ও তাই আমাকে আর জোর করে আটকালো না।

ওদের বাসা থেকে বেরুতেই ঝুপ করে চারদিক অন্ধকার হয়ে গেলো, কারেন্ট চলে গেছে। আমি ওদের বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে মোবাইলের টর্চ অন করলাম। বৃষ্টির দিনে এমন হুটহাট কারেন্ট চলে যায়, সহ্য হয়ে গেছে।

ওদের বাড়ির মেন গেট পেরিয়ে বেরুতেই দেখি রাস্তার ওপাশে কাঁঠাল গাছটার নিচে এক গাদা পাতার স্তুপের ওপর একটা ভূত শুয়ে আছে! প্রথমে ঠিক বোঝা যায়নি। জমাট অন্ধকার ময়লা স্তুপের উপর কালো ভূতটা যেন মিশে আছে। ভূতের গায়ে আঁশের মত চকচকে চামড়া মোবাইলের ক্ষীন আলোয় চকমক করে উঠলো।

ভূতের ব্যাপারে আপনি জানেন তো? এরা আমাদের আসে পাশেই ঘুরে বেড়ায় তবে নির্জন জায়গা এরা বেশি পছন্দ করে। আসলে এইসব ভূতরা ছিলো , আগে এদের দেখা যেত না। প্রথম দিকে ভূতগুলো নিরীহ ছিলো , মানুষের থেকে দূরে দূরে থাকতো। কিন্তু ইদানিং ওরা বেপরোয়া। আসলে হয়েছে কি, আগের দিনে মানুষের মধ্যে মায়া, মমতা, মানবিকতা ছিলো। ধীরে ধীরে যতই মনুষত্ব লোপ পেতে থাকলো ততই যেন ভূতগুলো মানুষকে পেয়ে বসলো। মানুষের ভেতরের ঠুনকো রূপটা ওরা দেখতে পেতো।

খুব যন্ত্রনা করে এই ভূতগুলো আজকাল। সন্ধ্যা হলেই রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়, এদের সামনে নিঃশব্দে চলাফেরা করতে হয়। মানুষ এদের আশেপাশে শব্দ করলেই- ব্যস, একেবারে সামনে এসে হাজির হবে। তারপর চেষ্টা করবে নানা ভাবে ভয় দেখাতে আর বিরক্ত করতে। আমার মনে হয়, হয়তোবা ওরা কানে খুব ভালো শোনে কিন্তু চোখে ভালো দেখতে পায় না। নাহ , মানুষের তেমন কোনো বড় ধরণের ক্ষতি করে না, শুধু বিরক্ত করে। আপনি যত ভয় পাবেন কিংবা বিরক্ত হবেন ওরা ততো মজা পাবে, আপনাকে আরো জ্বালাবে। আর যদি ভয় না পান তাহলে সরে যাবে।

তবে এদের মধ্যে কিছু ভূত খারাপ ধরনের। ওরা শুধু আপনাকে ভয় দেখিয়ে আনন্দ পাবে না, আপনার খুব প্রিয় একটা জিনিস কেড়ে নেবে, যেমন, কারো খুব প্রিয় স্মৃতি, কিংবা প্রিয় গন্ধ, প্রিয় অভ্যাস বা কারো দেয়া ভালোবাসার বস্তু। আমার এক কাজিনের হাতের আংটি নিয়ে গিয়েছিলো একটা খারাপ ভূত। এমন কোনো দামি আংটি ছিল না সেটা তবে তার বাবা, মানে আমার খালু মারা যাওয়ার ঠিক আগে কোন এক মেলা থেকে মেয়েকে আংটিটা কিনে দিয়েছিলেন। আংটি হারিয়ে আমার কাজিন খুব কেঁদেছিলো। আমি অবশ্য বলেছি, তোর আংটি নিয়েছে, খালুর স্মৃতিতো কেড়ে নেয়নি। মন খারাপ করিস না।

আমার সামনে যে ভূত শুয়ে আছে তার দেহ কুচকুচে কালো, শুকনো পাট কাঠির মতো হাত পা। গায়ের চামড়া অনেকটা মাছের আঁশের মতো চকচকে, নড়লে মনে হয় নড়ছে। শরীরের তুলনায় মাথা বেশ বড়, বিকট চেহারা, পলকহীন চকচকে চোখ। মানুষের মুখের যে অংশটায় ঠোঁট থাকে সেখানে ভুতটার ঠোঁট নেই, শুধু এবড়োথেবড়ো করে গাল জোড়া কাটা, সেই গাল কাটা মুখের ভেতরে দেখা যাচ্ছে সরু কিন্তু ধারালো ধূসর রংয়ের দাঁত। মাথার ঠিক মাঝখানটা কেমন তোবড়ানো গর্তের মতো, কোনো চুল নেই সেখানে কিন্তু বিশ্রী ধরণের খোলসের মতো চামড়া গুলো খুলে আছে। আমি জানিনা কিভাবে এত কিছু খেয়াল করলাম, এর আগে আমি কোনো ভূতকে এতটা খেয়াল করে । আমার উচিত ঝটপট সেখান থেকে চলে যাওয়া, অজানা কারণে আমি স্থবির হয়ে ভূতটাকে দেখছি। তবে ভুত এই মুহূর্তে অন্যমনস্ক। আমরা কানে ফোন নিয়ে যেভাবে কথা বলি, সে ঠিক সেভাবে কার সাথে যেন খুব নিচু স্বরে কথা বলছে।

আমার একটু ভয় করলো। ভয় করা তো স্বাভাবিক, তাই না? একটা ভূত এমন নির্জন অন্ধকার গলিতে আপনার সামনে শুয়ে থাকলে আপনি ভয় পাবেন না? আমি এর আগেও ভূত দেখেছি। দেখে ভূতের সামনে কোনো শব্দ না করে এড়িয়ে গেছি। এরা আমাকে কখনো বিরক্ত করেনি।

আমি মেয়েকে ফিসফিস করে বললাম, মামনি, আমরা খুব তাড়াতাড়ি হেঁটে গলির মুখে যাবো, তারপর রিক্সা, সিএনজি যা পাই নিয়ে নেবো। কিন্তু কোনো শব্দ না, ভূতটা যেন কোনো শব্দ শুনতে না পায়। শব্দ পেলেই কিন্তু আমাদের কাছে চলে আসবে, ভয় দেখাবে।

মেয়ে আগেই ভূতকে লক্ষ্য করেছে। ও খুব ভয় পেয়েছে। মেয়েটার শরীর হালকা কাঁপছে। একবার মনে হলো পাপনের বাসায় ফেরত যাই। কিন্তু দশটার সময় ওষুধটা না খেলে যে খুব মুশকিল হবে। এমন গাধামি করেছি, ওষুধটা সাথে আনতে ভুলে গেছি।

আমি আর মেয়ে ভুতকে এড়িয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। বৃষ্টিতে রাস্তা কাদা কাদা। মোবাইলের আলোতে দেখে কোনো রকমে লাফ ঝাঁপ দিয়ে রাস্তা পার হচ্ছি । মেয়েকে এক হাতে ধরে রেখেছি। আমাদের পা যেন কাদায় তলিয়ে যাচ্ছে। নতুন জামার নিচে কাদা লেগে ঘিনঘিনে অবস্থা।

হটাৎ মেয়ের পা একটা গর্তে পরে গেলো। ও নিজেকে কন্ট্রোল করতে না পেরে চিৎকার করে উঠলো। আমি ওকে জাপটে ধরে তুললাম। কিন্তু যা হবার হয়ে গেছে। আমি স্পষ্ট বুঝতে পারলাম কিছু একটা ঠিক আমার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে। আমি টের পাচ্ছি কারো নিঃশ্বাস ঠিক আমার ঘাড়ের উপর পড়ছে, সেই সাথে হালকা কচকচ শব্দ। ভূতটা আমার মেয়ের চিৎকার শুনেই ছুটে এসেছে।

হঠাৎ কেন জানি ভয়ংকর আতংক হলো। আমার এত কাছে কোনো ভূত কখনো আসেনি। এই ভূতটা যদি খারাপ ধরণের হয়? আমি কি চিৎকার করবো? না, তাহলে আশেপাশের আরো ভূত চলে আসবে। একটু সামনেই এগুলেই মেইন রাস্তা, আলো দেখা যাচ্ছে। ওই তো, দুইটা খালি রিকশাও দাঁড়িয়ে আছে।

মা, কি হয়েছে? কি হয়েছে মা? আমার মেয়ে তীব্র আতংকে হিড়হিড় করে কাঁপছে, ওর কথা জড়িয়ে যাচ্ছে। ভূতের উপস্থিতি ও টের পেয়েছে। আমার মতো ওর এতো কাছেও কোন ভূত আসেনি কোনোদিন।

আমি ওকে সাহস দিয়ে নিচু স্বরে বললাম, এই ভূত কিচ্ছু করবে না মা, ও শুধু আমাদের ভয় দেখতে চাচ্ছে। তুমি ভয় পেও না। কষ্ট করে একটু হেঁটে যাও, সামনেই রিকশা।

আমি মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কাদায় মাখামাখি হয়ে এগিয়ে গেলাম। এই রাস্তাটার এত খারাপ দোষ আসার সময় খেয়াল করিনি। কাদার যেন হাত আছে! সেই হাত আমাদের টেনে মাটির আরো নিচে ডুবিয়ে দিচ্ছে। এক পা এগুলে যেন দু’পা পিছিয়ে যাই। অশরীরী কিছু একটা এখনো আমার পেছনেই আছে কিন্তু আমি পেছন ফিরে দেখতে সাহস পাচ্ছি না। কেন জানি মনে হচ্ছে প্রতি মুহূর্তে সেই অস্তিত্ব আরো প্রকট হয়ে উঠছে। তার উপস্থিতি জানান দিতে অনবরত কচকচ শব্দ করেই যাচ্ছে। নিশ্চয়ই কাঁটা কাঁটা দাঁতের ঘর্ষণের শব্দ। ভূতটা কি করতে চাচ্ছে? যদি ধারালো দাঁতে কামড় বসিয়ে দেয়?

হঠাৎ টের পেলাম আমার কামিজের পেছন দিকের গলার খোলা জায়গাটায় ভূতটা নখ দিয়ে হালকা ভাবে আঁচড় দিচ্ছে। আমাকে ভয় দেখানোর শুরু। আমি আতংকে হিম হয়ে গেলাম। ভূতটার স্পর্শ আমার সারা শরীরে ভয়ংকর ভয় মেশানো ঘৃণার জঘন্য অনুভূতি ছড়িয়ে দিচ্ছে। পেছন থেকে হুমহুম ধরণের একটা শব্দ আসছে, মনে হচ্ছে ভূতটা হাসি চাপানোর চেষ্টা করছে। ঠিক মানুষের মতো হাসির শব্দ না সেটা, কেমন ক্ষীণ কর্কশ একটা শব্দ , তারসাথে যেন শুকনো পাতার খসখস শব্দ যোগ হয়েছে। কেউ কি কথা বলছে? আমি প্রাণপণ চেষ্টা করছি কিছু না শুনতে।

কিন্তু আমি শুনতে পেলাম ফিসফিস করে বলছে, মেয়েকে নিলাম। কথাটা বলেই ভূত আমার ঘাড়ে আবার নখ দিয়ে আঁচড় দিলো, এবার অনেক জোরে। টের পেলাম ঘাড়ের কাছ দিয়ে তরল কিছু গড়িয়ে পড়লো, রক্ত নাকি?

সব ভুলে নিজেকে একটু সামলে নিয়ে দেখি, মেয়ে আমার পাশে নেই! চারপাশে কোথাও নেই! যেন বাতাসে মিলিয়ে গেছে! আমার মাথা কেমন চক্কর দিলো, বুকের ভেতর হৃদপিন্ড এত জোরে ধুপপুক করছে যেন এক্ষুনি বুক ফেটে যাবে। আমি চিৎকার আমার মেয়ের নাম ধরে করে ডাকলাম। আমার চোখ ফেটে কান্না আসছিলো। মাথার ভেতরটা এতটাই ফাঁকা লাগছিলো মনে হচ্ছিলো আমি এক্ষুনি জ্ঞান হারাবো।

এবার যেন আমার চারপাশে কারা যেন ফিসফিস শুরু করলো। আমি স্পষ্ট কাউকে দেখতে পাচ্ছিলাম না। ভয়ে আমার হাত থেকে মোবাইলে ফোন পরে গেছে। আমি বুঝতে পারছি আমার ঠিক পেছনে জঘন্য কুন্নী ভূতটা এখনো দাঁড়িয়ে আছে।

আমি বুঝতে পারছি আর ভয় পেলে হবে না, যেকোনো ভাবে হোক মেয়েকে উদ্ধার করতে হবে, ভূতটার মুখোমুখি হতে হবে। ঘাড় ঘুরিয়ে এবার তাকে স্পষ্ট দেখলাম, পলকহীন চোখ আর গাল জোড়া বিকট হাসিতে বেরিয়ে আছে কাঁটার মতো দাঁত। তার পিঠের উপর আমার মেয়ে, আতংকিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে কি যেন বলছে অথচ আমি কিছুই শুনতে পারছি না। খালি দেখছি ও চিৎকার করার ভঙ্গিতে মুখ নাড়ছে। মেয়ে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো।

আমি এক লাফে মেয়েকে ধরতে গেলাম আর ঠিক তখনি ভূতটা হওয়ার মিলিয়ে গেলো! মেয়েকে উদ্ধার করতে পারলাম না।

তখন আমার ঘুম ভাঙলো, আমি বুঝতে পারলাম আমি এতক্ষন স্বপ্ন দেখছি, ভয়ংকর দুঃসপ্ন। আমার হৃদপিন্ড তখনও ভয়ংকর ভাবে কাঁপছে , সারা শরীর ঘেমে গেছে। আসলে আমার মেয়েকে হারিয়ে ফেলার দুঃস্বপ্নটা আমি প্রায়ই দেখি। রাত দশটায় ওষুধ না খেলেই এমন খারাপ স্বপ্ন দেখি, মাঝে মাঝে তো কাঁদতে কাঁদতে ঘুম ভাঙে ।

একটু পর শান্ত হলাম, মেয়ের রুমে গেলাম দেখতে ও ঠিক আছে কিনা। ওর রুমে গিয়ে দেখি মেয়ে নেই! কোথাও নেই, সারা বাড়ি তন্ন তন্ন করে খুঁজেও মেয়েকে পেলাম না। কুন্নী ভুত সত্যি সত্যি আমার মেয়েকে নিয়ে গেছে। আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। আপনি খুঁজে বের করুন আমার মেয়েকে প্লিজ। প্লিজ।

আপনি আমার কথা বিশ্বাস করলেন না তো? দেখেন, আমার ঘাড়ে ভূতের আঁচড়, দেখেন।”

——————————————————————
নাম: অনামিকা আহমেদ
বয়স: ৩৫
ডায়াগনোসিস: সিজোফেনিফর্ম ডিসঅর্ডার

ডক্টর আশফাক ভিডিও ক্লিপটা দেখলেন। তারপর রোগীর ফাইল খুলে তথ্যগুলোতে চোখ বুলিয়ে নিলেন। বাইশ বছর বয়সে এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনায় ভদ্রমহিলার প্রথম সন্তানের মৃত্যুর পর এই রোগের উৎপত্তি। দ্বিতীয় সন্তানের জন্মের পরে সমস্যা আরো বাড়তে থাকে। চিকিৎসা হিসেবে কিছু এটিপিক্যাল আন্টিসাইকোটিক মেডিসিন দেয়া হয়েছিল।

রোগীর দ্বিতীয় ফাইল পুলিশ কেসের ফাইল। সেখানে দেখা গেলো অনামিকার স্বামী সামিউল স্ত্রীর অসুস্থতার দায়ভার বহন করতে অস্বীকৃতি জানালে তাদের মধ্যে ডিভোর্স হয়ে যায়। সামিউল তাদের সন্তান বিদিতাকে নিয়ে চলে যায়। ডিপ্রেশনের ফলে অনামিকার রোগ আরো ভয়াবহ আকার নেয়। অনামিকার মায়ের অবিরাম অনুনয়ের পরে সামিউল বিদিতাকে মাঝে মধ্যে অনামিকার সাথে থাকার অনুমতি দেয়।

এমনি এক রাতে যখন বিদিতা অনামিকার বাসায় ছিল, তখন বিদিতা ওই বাসা থেকে হারিয়ে যায়। সামিউল মামলা করে অনামিকার বিরুদ্ধে। সামিউলের ভাষ্যমতে ওর সাথে ডিভোর্সের প্রতিশোধ নিতেই বিদিতাকে গুম করেছে অনামিকা।

পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে অনামিকা উপরের বক্তব্য দেয় যেটা রেকর্ড করে রাখা হয়েছিল। ডক্টর আশফাক দু’বার ভিডিওটা দেখে বুঝতে পারছেন রোগী সিজোফ্রেনিক ছিলো, কথাবার্তা এবং বডি ল্যাংগুয়েজ অস্বাভাবিক। তবে কথাবলার ভঙ্গি যথেষ্ট শান্ত এবং গোছানো।

পুলিশ ফাইলের রিপোর্ট অনুযায়ী জানা গেলো পরবর্তীতে বিদিতাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। মানসিক বিকারগ্রস্ত হওয়ায় এবং অভিযোগ প্রমান না হওয়ায় অনামিকাকে মামলা থেকে অব্যাহতি দেয়া হয়।

ফাইলগুলো তিন বছর পুরোনো। ডক্টর আশফাক স্টুডেন্টদের জন্য সিজোফ্রেনিয়ার ব্যাপারে কিছু প্রেসেন্টেশন তৈরী করবেন। সেজন্য লাইব্রেরির ভিডিও আর্কাইভ থেকে এই ভিডিও কেসটা বের করে এনেছেন। কিন্তু তার খুব জানতে ইচ্ছা বিদিতার কি হলো? কোথায় হারিয়ে গেলো মেয়েটা? সত্যিই কি অসুস্থ মা তার মেয়েকে খুন করে ফেলেছিলো? সিজফ্রেনিক রোগীরা অনেকসময় হিংস্র হতেই পারে। রোগীকে সামনে সামনি দেখলে আরো অনেক কিছু বোঝা যাবে।

তিনি ইন্টারকমে লাইব্রেরির ম্যানেজার সাজ্জাদকে কল করলেন।

সাজ্জাদের কাছে এই কেসের ব্যাপারে জানতে চাইলে সে অবাক হয়ে বললো, স্যার আপনি এই কেসের ব্যাপারে জানেন না? তিন বছর আগে এই কেস নিয়ে খুব তোলপাড় হয়েছিলো। প্রত্রিকায়, টিভিতে অনেক দেখিয়েছে। মায়ের মাথা খারাপ, মেয়েকে বাপের সাথে যেতে দিবে না বলে মেয়েকে নাকি খুন করেছে, এমন অভিযোগ করেছিলো মেয়ের বাবা। এদিকে মহিলা বারবার বলে ভূত নাকি তার মেয়েকে নিয়ে গেছে, মহিলার ঘাড়ে ভূতের নখের আঁচড়ও দেখা যায়।

তাই নাকি? আমি তখন জার্মানিতে ছিলাম তাই হয়তো খবরটা চোখে পড়েনি। তারপর?

তারপর স্যার মেয়ের কেন হদিস পাওয়া যায়নি, প্রমানও করা যায়নি যে মা মেয়েকে গুম বা খুন করেছে। ফলে কেসটা আনসল্ভড। এদিকে অনামিকার দেখাশোনা করার কেউ ছিল না। ওর বাবা মার তেমন টাকা পয়সা ছিল না, চিকিৎসা করাবে কিভাবে, বলেন? তাছাড়া ওরাও ভাবতে শুরু করলো অনামিকাই খুনী। মেয়েকে হারিয়ে অনামিকার অবস্থা আরো খারাপ হলো স্যার। আমাদের হসপিটালেই তো পড়ে ছিল বেশ কিছুদিন। শেষের দিকে তো পুরো মারমুখী অবস্থা, সামনে যাকে পায় তার দিকেই তেড়ে যায়, নোংরা নোংরা কথা বলে। তারপর হঠাৎ দুম করে মরে গেলো বছরখানেক আগে। মরার আগে অবশ্য একটা অদ্ভুত ব্যাপার হলো।

কি ব্যাপার?

আমাদের এখানে একজন প্রফেসর ছিলেন, মাহাতাব স্যার। শেষের দিকে অনামিকার চিকিৎসা করছিলেন উনি। মৃত্যুর আগে অনামিকা নাকি তাকে ইন্ডিয়ার কোন এক বোর্ডিং স্কুলের ঠিকানা দিয়েছিলো। ঠিকানাটা সে স্বপ্নে পেয়েছে। বিদিতা, মানে,অনামিকার মেয়ে নাকি ওখানেই আছে। মাহাতাব স্যার প্রথমে প্রলাপ ভেবে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। পরে উনার এক পরিচিত সাংবাদিককে গল্পে গল্পে ব্যাপারটা জানান। ওই সাংবাদিক মশলাদার খবরের আশায় সেই স্কুলে খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন বিদিতা সেখানে আসলেই আছে! মজার ব্যাপার হচ্ছে বিদিতা বলতে পারে না ও কিভাবে সেই স্কুলে ভর্তি হলো। ছোট ছিলো তো, মনে নেই আর কি। ওর বাবাই নিশ্চয়ই পাগল মায়ের থেকে মেয়েকে সরিয়ে দিয়েছিলো অথচ ব্যাটা কিছুতেই সেটা স্বীকার করলো না। দেখেন অবস্থা স্যার। কোথায় রোগীর চিকিৎসা করাবে, তা না। উল্টো মানসিক যন্ত্রনা দিয়ে মেরেই ফেললো …………..স্যার, আর কিছু জানতে চান? পুরোনো পত্রিকা দেখলে আরো অনেক কিছু জানতে পারবেন।

ডক্টর আশফাক ফোন রেখে অনামিকার ফাইল গুছিয়ে নিলেন। সিজোফেনিফর্ম ডিসঅর্ডারের এই কেসটা নিয়ে ক্লাসে আলোচনা করলে ভালোই হবে। এমন চাঞ্চল্যকর কেস নিয়ে স্টাডি করতে সবার আগ্রহ হবার কথা। পুরো ফাইলটা আরো ভালো করে দেখতে হবে। অনামিকা স্বপ্নে কেমন করে বোর্ডিং স্কুলের ঠিকানা পেলো সেটার ব্যাখ্যা বের করা দরকার। ভূতের আঁচড়ের ব্যাপারটারও নিশ্চয়ই একটা যুক্তি আছে।

ফাইলের ভেতর থেকে অনামিকা আর বিদিতার একটা ছবি বেরিয়ে এলো। হাসিখুশি মিষ্টি চেহারার একটা মেয়ে তার তিন চার বছরের ফুটফুটে কন্যাকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। ছোট্ট বিদিতার চোখে চশমা আর চশমার পেছনে বুদ্ধিদীপ্ত এক জোড়া চোখ হাসছে। কিন্তু বিদিতার মুখ গম্ভীর, অনেক কষ্টে হাসি চেপে রেখেছে মেয়েটা।

দৃশ্যটা সবসময় এমন থাকলেই হতো না?

 -সালমা সিদ্দিকা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *