হীরার দমবন্ধ লাগছে। দমবন্ধ লাগার কারন হলো লোকটা তাকে জাপটে ধরে শুয়ে আছে। ছাড়িয়ে নেয়ার উপায় নাই, তাহলে ক্ষেপে যাবে। শুধু দমবন্ধ লাগলে একটা কথা ছিল, একটা পঁচা গন্ধও লাগছে নাকে। ইদানিং লোকটার গায়ের কাছে গেলেই সে গন্ধটা পায়। অথচ রওশন’ সার্কাসের মালিক ফয়েজ চৌধুরী তার শরীরে নানান জাতীয় দামী কসমেটিক্স ব্যবহার করেন। এ বিষয়ে লোকটা শৌখিন। নানান দেশের সেন্ট সংগ্রহ করা তার শখ।
কটু গন্ধ নাকে নিয়ে হীরা মনে মনে ভাবছে, আজকের রাতটা কিছুতেই মিস করবে না। পরিকল্পনা করাই আছে সব। শুধু প্ল্যান মত এগিয়ে যাওয়া। সে মনে মনে পরিকল্পনা মতো অনেকবার রিহার্সাল করেছে। রিহার্সাল সাকসেসফুল হচ্ছেনা। প্রতিবারের রিহার্সালে একটা না একটা প্রবলেম হচ্ছে। প্রথমবার রিহার্সাল করার সময় যেই সে লোহার রডটা লোকটার মাথা বরাবর উঠিয়েছে, দেখাগেল লোকটা তখনি চোখ মেলে ধরমরিয়ে উঠে বিস্মিত চোখে তার দিকে চেয়ে রইল।
দ্বিতীয় রিহার্সালে ও সমস্যা। বালিশ তুলে তার মুখে চেঁপে ধরার জন্য যেই না সে বিছানায় বসে বালিশ তুলে ধরেছে, তখনি লোকটা চোখ খুলে বলল,’হীরা এক গ্লাস পানি দাও’
মনে মনে রিহার্সালে সে সাকসেসফুল হচ্ছেনা বলে সে বিচলিত নয়। বাস্তবে তাকে সাকসেসফুল হতেই হবে। মেইন সমস্যা হল দুইটা। প্রথম সমস্যা হল, রাতভর সার্কাস চলছে। চারদিক হৈ চৈ শোরগোল। বিশেষ প্রয়োজনে যখন তখন যে কেউ সার্কাসের মালিককে ডাকতে আসতে পারে। দ্বিতীয় সমস্যা হল, তার ডান হাত ভয়াবহ যখম হয়েছে। পুরো হাত ব্যান্ডেজে ঢাকা। আজ সন্ধ্যারাতে তাকে ফলকাটা চাকু দিয়ে ঘা দিয়েছে লোকটা। ছয়টা সেলাই পড়েছে কাটা জায়গায়। ব্যাথায় শরীরে জ্বর প্রচন্ড। এত কষ্টে তার মন যেমন পরিকল্পনা করছে কি ভাবে কি করবে, তেমনি মাথায় আবার পরিকল্পনাটা বেড়াছেড়া লাগছে।
সুশান্ত ছেলেটাকে কাজে লাগানো যেতে পারে। এমন পিটুনি ছেলেটাকে দেয়া হয়েছে যে, সহ্য করা যায় না। তারপর আবার হাত পা বেঁধে বাহিরের ঘরে বন্ধ করে রেখেছে এই জালিম লোকটা। সুশান্তকে হাত পা খুলে দিলে এই কাজটা সেই করতে পারবে। ছেলেটার মনে প্রচন্ড ক্ষোভ, জেদ নিশ্চই হয়েছে এমন ঘটনা ঘটার পর। শুধু সেই ক্ষোভের আগুনে ম্যাচ ঠুকে দেওয়া। তবে সেখানে সমস্যা হলো, খালেক আর কাশেম ঐ বন্ধ ঘরের সামনে পাহারায় আছে নিয়শ্চই!
হীরা ফয়েজ চৌধুরীর মুখের দিকে তাকাল। কি নিশ্চিন্তে গভীর ঘুমে তলিয়ে আছে পিশাচটা। হঠাৎ হীরার মনে হল লোকটার বুকের মধ্যে শুয়ে এমন পরিকল্পনা যে সে করছে, বুঝে ফেলছে না তো লোকটা?
সে আস্তে করে নিজেকে লোকটার বন্ধন থেকে ছাড়িয়ে নিল। এখনি সময়। যা করার এখনি করতে হবে ভেবে হীরা উঠে বসল। ঘটনাটা তখনি ঘটল।
প্রথমে হালকা পরের বার বেশ ভালভাবেই শোনা গেল শব্দটা। খাটের নিচে কেউ বুড়ো মানুষের মত অদ্ভুত শব্দে হাসল। হাসিটা কেমন কান দিয়ে মাথায় ঢুকে ভয় লাগিয়ে দেয়। গায়ের সব লোম দাড়িয়ে যাচ্ছে। হীরা শোয়া থেকে উঠে বসল। তারপর পরই হেচঁকি দেয়ার মত আবার একটা শব্দ হলো। শব্দটা হওয়ার সাথেই বিছানার পাশে টেবিলের আড়ালে রাখা লোহার রডটা ঝঁনঝনিয়ে পরে গেল। হীরা চমকে উঠে পাশের মানুষটার দিকে তাকাল। এ রকম শব্দেও লোকটার ঘুম ভাঙ্গল না।
কিছুক্ষণ সব নীরব। হীরা মনে মনে ভাবল, তার ভুল শোনা। ঘরের বাইরে থেকে কোন পোকা মাকরের শব্দ হতে পারে। সার্কাস মঞ্চের তাবুর বাইরে অনেকটা দূরে বাশঁঝাড় আর জঙ্গলের পাশেই তার ঘরটা। বাহিরে কত রকম পোকা মাকড় তো থাকবে, শব্দ করবে! আবার আদি কালের এই খাট থেকেও হতে পারে। অন্য বিছানায় শুয়ে ফয়েজ চৌধুরী ঘুমাতে পারেন না বলে পার্টির মালামালের সাথে খাটটাও সব জায়গায় নেয়া হয়।
হীরা আস্তে করে খাট থেকে নামল। তাকে আর দেরি করা যাবেনা। কাজ শেষ করে অন্ধকার থাকতে থাকেই সে পালিয়ে যাবে। যাবার আগে সুশান্তকে ছাড়িয়ে দিয়ে যেতে হবে। বেচারা শুধু শুধু অপরাধী হয়েছে। সে অন্যায় কিছু করেনি। সারাক্ষণ আম্মা’ আম্মা করে তাকে। হীরার প্রয়োজনেই তাকে রাখা হয়েছে। যখন তখন যে কোন কাজে ডাকলেই ছুটে আসে,’কিছু কইবেন আম্মা?’
বিকাল বেলা হীরা সুশান্তকে ডেকে বলল,
‘সুশান্ত, বাজারে গিয়া দেখ তো, আমড়া পাওয়া যায় কিনা?’
সুশান্ত বলল,’এখুনি যাইতেছি আম্মা’
সে চলেই যাচ্ছিল, হীরা তাকে আবার ডাকল।
‘টাকা ছাড়া কিনবা কেমনে? টাকা নিয়া যাও, দাড়াও দিচ্ছি’।
হীরার বসা থেকে উঠে দাঁড়াতেই মাথা ঘুরে উঠল। আলমারির কাছে যাবার আগেই জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে গেল। জ্ঞান যখন ফিরল, চোখ মেলে তাকিয়ে সে ডাক্তারকে দেখতে পেল। ফয়েজ চৌধুরীর সামনে ডাক্তার বলল, সে সন্তান সম্ভবা। এমন খবরে হীরা মনে মনে আহত হলেও কিন্তুু ফয়েজ চৌধুরীর কোন প্রতিক্রিয়া বোঝা গেল না।
ডাক্তার চলে যাবার পর দরজা আচমকা বন্ধ করে ফলকাটা চাকুটা দিয়ে তাকে যখন ঘা দিল লোকটা, তখন সে জানল ঘটনা কি?
লোকটা অকথ্য ভাষায় গালগাল করতে করতে যা বলল তা হলো, ‘সুশান্ত কে? তোর মায়ের নাগর? সে তোরে কোলে কইরা শোয়ায়, মাথায় পানি দেয়!ব্যাপারটা কি?’
দ্বিতীয় ঘা টা দেয়ার সময় বলল,
‘নাকি ঐ…. পুত তোর বাচ্চার বাপ?’
এই পর্যন্ত শুনে হীরা আবার জ্ঞান হারাল। সন্ধ্যা রাতে জ্ঞান ফিরে সে সুশান্তর শাস্তির ব্যাপারটা শুনেছে। তখনি সে ঠিক করে ফেলেছে, আজ রাতেই সে কাজটা করবে।
হীরা খাট থেকে নেমে আলতো পায়ে টেবিলের কাছে গেল। উবু হয়ে রডটা হাতে তুলতে গিয়ে তার চোখ পড়ল অন্ধকারে খাটের নিচে। সাথে সাথে তার গা দিয়ে শীতল স্রোত নেমে গেল।
বিড়ালের চোখের মত উজ্জ্বল, কিন্তুু বড় বড় একজোড়া চোখ তার দিকে তাকিয়ে আছে পিছন ফিরে। কুঁজো হয়ে বসে হাঁটুর চিপায় রাখা তার সরু দুটো হাত। চোয়াল ঝুলানো কদাকার চেহারায় টাক মাথার এক বৃদ্ধ তাকে দেখে হাসছে।
তারপরের ঘটনা হীরা আর কিছু জানেনা।
চলবে…
-বেলা প্রধান
ছবি কৃতজ্ঞতা – সাখাওয়াত তমাল