চাল, ডাল, তেল, নুনের হিসাব লিখে আমার একটা জীবন গেলো। তাও যদি আমার বুড়ো ঠিকঠাক বাজারটা করে আনতো। লিখে দিই লালশাক, নিয়ে আসে কলমি শাক। তেল লিখে দিলে আনে লবন। যত বয়স হচ্ছে ততই যেন ভুলে যাওয়ার পরিমাণ বাড়ছে। রোজ তাই সকালে বাজার আনার পরে এক দফা চিৎকার করতেই হয় আমার। আচ্ছা তেলের পরিবর্তে লবন আনলে কি দিয়ে রান্না করবো? আর বুড়ো হাসিমুখে সব সহ্য শেষে বলবে, ‘ বৌ শোন, আমার ধারনা তোমাকে যদি আমি একদিন শুধু ঘাস কেটে এনে দেই, সেটা দিয়ে তুমি ঘাসের ভর্তা, ঘাসের ভাজি এবং মাছ দিয়ে একটা ঝোল নিশ্চিত করে ফেলবে। ঘাসের সব তরকারী খেতে এতো ভালো হবে যে আমার ইচ্ছে করবে এরপর থেকে রোজ ঘাসের তরকারী খাই।’ এরপর কি আর রাগ করে থাকা যায়?
পয়ত্রিশ বছরের সংসারে রোজ সকালের এরকম কথোপকথন একটা স্বাভাবিক ব্যাপার আমাদের।
সেই যে কিশোর বেলায় আমার স্কুলের পথে গাছের নীচে দাঁড়িয়ে থাকা এক কিশোরের নজরবন্দী হয়েছি, জীবনের এতগুলো বসন্ত পেরিয়ে আজ আমরা প্রৌঢ় দম্পতি। আমার বুড়ো অবসরে গেছে আজ প্রায় চার বছর হতে চললো। আমার এ বছরই চাকুরী শেষ। আমাদের বিয়েটা হওয়ার কোন কথাই ছিল না। ও ছিল আমার বছর পাঁচেকের বড়। সেসময় মেয়েদের তত বেশী পড়ার ব্যাপার ছিল না। আর তাই কলেজ না পেরুতেই বিয়ে হয়ে যাওয়া অবধারিত ছিল প্রায় সব মেয়েরই। কিন্তু কি এক অজানা কারণে আমার বিয়েটা ঝুলে রইলো। পাত্রপক্ষ আসবে আসছি করে আর আসতো না। একজনের কাছে জানা গেলো কে যেন উড়োচিঠি দিয়ে বিয়ে ভাঙাতো। যতদিনে বাবা বুঝতে পারে ব্যাপারটা ততদিনে আমার বিয়ের জন্য পাত্র পাওয়া কঠিন হয়ে যাচ্ছিলো। শেষতক সেই গাছতলার কিশোর যে তখন সদ্য চাকুরী পাওয়া তরুন তার সাথেই বাবা গাটছড়া বাঁধার অনুমতি দিলেন।
কি যে ভালোবাসায় ভরা আমাদের দু কামরার সংসার ছিল। বছর না ঘুরতেই সবাই কানাঘুষা শুরু করে দিল, বাচ্চা নেইনা কেন? আমরাও ভাবছিলাম ঐ ব্যাপারে। কিন্তু নিয়তি বুঝি অন্য কিছু লিখে রেখেছিল। কয়েক বার কনসিভ করেও বাচ্চা টেকেনি একবারও। কি যে কষ্টের সেসব দিন। প্রতিবারের শারিরীক আর মানসিক কষ্টে মনে হতো কেন মরে যাচ্ছিনা। ডাক্তার কবিরাজ কিছুই বাদ দেইনি। শেষমেষ ওকে বললাম অন্য কোথাও বিয়ে করতে। হাত ধরে বললো, ‘ তোমাকে এক জীবনে কাছে পাওয়াই আমার জন্য যথেষ্ট, আমার আর কিছু চাইনা এই জীবনে।’ নিজেদের পরিবার পরিজন মুখ ফিরিয়ে নিলেও উনি শক্ত হাতে আমার হাত ধরে রেখেছেন। উৎসাহ দিয়ে চাকুরীতে ঢুকিয়েছেন। আমাদের কোন ছেলেমেয়ে নেই বলে দুই পরিবার থেকেই আমাদের সম্পত্তি থেকেও বঞ্চিত করা হয়েছে। মেনে নিয়েছি দুজনেই। নিজেরা পরিবারের সাথে সেভাবে যোগাযোগ করতাম না, কিন্তু কেউ কোন সাহায্য চাইলে হাত বাড়িয়ে দিয়েছি যতোটা পেরেছি। ওনার সরকারী চাকুরীর সুবাদে পুরো বাংলাদেশ আমরা দুজনে ঘুরে বেরিয়েছি।
ওনার একটা অদ্ভুত শখ হলো মাঝবয়সে এসে। লটারী কেনা। ওনার হঠাৎ মনে হলো যদি কখনো লটারী লেগে অনেক টাকা পেয়ে যান তাহলে সেটা আমার নামে রেখে দিবেন, যেন তার অনুপস্থিতিতে আমার কখনো চলতে অসুবিধা না হয়। ছেলেমানুষী চিন্তা হলেও আমি কখনো ও ব্যাপারে বাঁধ সাধিনি। কিছু টাকা বাড়তি পেলে মন্দ কি?
আজ সকালে স্কুলের চাকুরীতে যাইনি বা বলা ভালো যেতে পারিনি। স্বামী স্ত্রী দুজনেই হাতে একটা লটারীর টিকিট নিয়ে বসে আছি। প্রথম পুরষ্কারের টিকেট নাম্বারটা আমাদের হাতে। এতোদিন মনে হতো টাকা পেলে কতো কি করবো। কিন্তু এ বেলা প্রথম ভয় পেলাম নিরাপত্তাজনিত। আমরা দুজন মানুষ একা থাকি এ বাসায় এলাকার সবাই জানে। আমাদের নিজেদেরই বাসা। একটা ছোট ছেলে আছে ঘরের সব কাজ করে দেয়। কেউ যদি এসে গলায় ছুরি চালিয়ে দেয়? এমনকি বাসার ছেলেটাকেও সন্দেহ হতে লাগলো। পুরোটা দিন কেমন একটা ভয় মিশ্রিত আতংকে কাটলো। বারেবার মনে হচ্ছিলো লটারী না লাগলেই বুঝি ভালো ছিল।
ভালোয় ভালোয় সব টাকা তুলে ব্যাংকে জমা দিয়ে ফেলার পর একটু নিশ্চিন্ত হলাম। কিন্তু বিপত্তি বাঁধলো অন্যখানে। আত্মীয়স্বজন কিভাবে যেন জেনে গেলো আমাদের লটারীর পুরষ্কারের কথা। শুরু হলো পালে পালে তাদের আগমন। যারা এতো বছর কোন যোগাযোগ রাখেনি তারাও নানা ছলে এসে দেখা করে যেতে লাগলো। অবস্থা এমন নিজেরা ঘড় ছেড়ে পালিয়ে যেতে পারলে বাঁচি। কতজন যে কত রকমের ব্যবসার বুদ্ধি নিয়ে এলো। কাউকে ভদ্রভাবে কাউকে রূঢ়ভাবে যাকে যেভাবে পারি বিদায় করেছি। কিন্তু আমাদের একাকী জীবনের শান্তি পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেলো। তার জের ধরেই কি না কে জানে আমার স্বামী পুরোই শয্যাশায়ী হয়ে গেলেন। অসুখ বিসুখ ছিল কিন্তু এতোটা খারাপ অবস্থা কখনোই ছিল না। তারপর এক সকালে আমাকে কিছু বুঝতে না দিয়ে আমার পাশে শুয়েই শেষ নিঃশ্বাসটুকু ছাড়লো। শুধু যাওয়ার আগে বলে গেলো, ‘রাবেয়া, তোমাকে বড় বিপদে ফেলে গেলাম বুঝি।’
আসলেই উনি আমাকে দারুন বিপদে ফেলে গেলেন। মাথার ওপর ছাতাবিহীন এই আমি ওনার শোকের চেয়েও নিজের জীবন নিয়ে শংকিত হয়ে উঠলাম। উনি মারা গিয়ে আমার জীবনের বাকী শান্তিটুকুও ওনার সাথে করে নিয়ে গেলেন। দুই বাড়ির আত্মীয়স্বজন দুই গ্রুপে ভাগ হয়ে বাড়ি আর সম্পত্তি দখলের অন্ধ খেলায় মেতে উঠলো যেন। নিত্য ঝগড়া আমার চোখের সামনেই। অথচ তখনো ওনার মৃত্যুর চল্লিশ দিন ও পার হয়নি। আমারও কিছু বলার থাকতে পারে, আমিও একজন শিক্ষিত মহিলা যে তার নিজের সিদ্ধান্ত নিতে পারে; তা যেন সবাই বেমালুম ভুলে গেল।
মানুষের লোভের নির্লজ্জ রূপটুকু দেখতে দেখতে মনে হলো, একটা লটারীর টিকেট না জিতলে নিজের পরিবারের মানুষরূপী অমানুষদের বুঝি এক জীবনে কখনো চেনাই হতোনা। যে মানুষটা রোজ জেতার স্বপ্ন দেখে টিকেট কিনতো সে তার ফলাফলটুকুর জেরে পৃথিবী ছেড়েই চলে গেলো আর বাকীরা তাতে ভাগ বসানোর যুদ্ধেই না পৃথিবীর ময়দান ছাড়তে হয়।
হায়রে লোভী মানুষ!
-ডা. জান্নাতুল ফেরদৌস