‘নিন, পানি খান…’
সফিক সাহেবের কথায় লোকটি মুখ তুলে কাচের গ্লাসের দিকে তাকালেন। তখনি আবার মুখ নামিয়ে একেবারে বুকের কাছে নিয়ে বিড়বিড় করে বললেন,
‘আমি পানি খাব না’
পানি হাতে দাঁড়িয়ে মতির মা লোকটির দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুঁচকে চোখ গোল গোল করে ফেলল। বিরক্তি নিয়ে বলল,
‘ দরত দেখাইয়া ফিরিজ থন কাল পানি লইয়া আইছেলাম, ব্যাটায় তোয়াজ কত!’ লোকটি মতির মায়ের কথায় সামান্যতম গুরুত্ব দিলেন বলে মনে হল না। যেভাবে বসে ছিলেন তেমনি বসে রইলেন। মুখে শুধু বললেন,
‘আমি এইসব পানি খাই না’
মতির মা সঙ্গে সঙ্গে চেতে গিয়ে বলল,
‘হেয়্যা, বেটায় কয় কী?’ এই পানি খাইব না, তায় খাইব কী?’
সফিক সাহেব মতির মাকে ধমক দিলেন,
‘তুমি যাও তো মতির মা। এখন এখানে আসবা না।’
সফিক সাহেব লোকটির সামনে বসলেন। পুষ্টিহীন ভাঙা শরীর। ময়লা কুঁচকানো পাঞ্জাবি পায়জামা পরিহিত চল্লিশোর্ধ্ব টাক মাথার কালো মানুষ। যে কেউ দেখে বলতে পারবে যে, কঠিন জীবন জটিলতায় কতটা ক্লান্ত,অসহায় সে । তবুও চেহারার কোথায় যেন একটা চটুলতার ছাপ আছে। মানুষটাকে তার বিশ্বাস করার কোনো কারণ নাই। এমন ধান্দাবাজ পির, ফকির, কবিরাজে দেশ ভরে গিয়েছে। এরাই যদি দুনিয়ার সব জটিল কঠিন রোগের চিকিৎসক হয় তবে ঘরে ঘরে জীবনের পাই পাই পয়সা লুটিয়ে সন্তানকে বড়ো ডাক্তার বানানোর কষ্টকর প্রক্রিয়া কেন চালু থাকবে দেশজুড়ে !সফিক সাহেব দেশের নামকরা সব ডাক্তার দেখিয়েছেন তার ছেলেকে। তার সুদর্শন ছেলের ব্রেনে ডিমেনশিয়া নামক ব্যাধি বাসা বেঁধেছে। এই রোগের জন্যে ছেলের মাথার ব্রেন ঠিকঠাক কোনো কাজ করছে না। স্থবির অচল মস্তিষ্ক নিয়ে মৃতপ্রায় জীবন বহন করছে তার একমাত্র পুত্র সন্তান। তিনি নাই এমন চেষ্টা করেননি! ডাক্তারের পাশাপাশি যেখানে যা শুনেছেন, তাই করেছেন। দান, সদকা পির, ফকির কোনো কিছুই বাদ রাখেননি। এ পর্যন্ত সবই বিফলে গিয়েছে। তবুও তিনি হাল ছাড়েননি। চিকিৎসা চেষ্টা বন্ধ করে রাখলে তার অস্থির লাগে। দ্বায়িত্ব ছেড়ে দেবার চাপা কষ্ট হয়। মুখের সামনে তার একমাত্র ছেলে এমন অথর্ব জীবন কাটাবে তা দেখে সহ্য করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই ঠিক করে ফেলেছেন, যতদিন তিনি বেচেঁ থাকবেন, চেষ্টা করেই যাবেন। বাকিটা আল্লাহর ইচ্ছা! আল্লাহ পাকের ইচ্ছা হলে শুধু দরকার উসিলার। তিনি সেই উসিলার সন্ধানে কোনো চিকিৎসাকেই ছোটো করে দেখেননি। কোনো পির, ফকির, কবিরাজকে অগ্রাহ্য করেননি।একবার এক বেদেনি তার কঠিন চাটুকারিতায় তাকে কঠিনভাবে প্রভাবিত করে ফেললেন। মানুষের ব্রেন অদ্ভুুত কোনো কারণে এমনভাবে তৈরি যে অন্যের কথায় প্রবলভাবে প্রভাবিত হয়। ঠিক যেভাবে চোখ বন্ধ করে আমরা অন্যের ওপর আস্থা রাখি। বেদেনি নিজেই ছেলেকে বারান্দায় বসিয়ে মাথার তালুর খানিকটা জায়গা গোল করে কামিয়ে ফেলল মন্ত্র পড়ে পড়ে। তারপর তাতে কাল কুচকুচে তরল পদার্থের একটা প্রলেপ লাগিয়ে দিল। সাথে সাথে পুরো বাড়ি নর্দমার দুর্গন্ধে ভরে গেল। বাড়ির সবাই নাক চেপে সয়ে গেলেও সফিক সাহেব নিজেই সইতে পারলেন না। গলগল করে বমি করে ড্রয়িং রুমের কার্পেট মাখিয়ে ফেললেন। প্রথমবার বেলা দশটায় বমি হবার পর দুপুর নাগাদ আরও তিন দফায় বমি করে চোখ মুখ উল্টিয়ে তিনি জ্ঞান হারালেন। ছেলের মা তার বোকামিতে মুখে অগ্নি বর্ষণ করতে লাগলেন। বেদেনিকে মোটা অঙ্কের সন্মানি দিয়ে কেনা ঔষধ বলে নয় একটা বেদেনির চাটুকারিতায় তিনি এতটাই প্রভাবিত হয়েছিলেন যে, দু’দিন পর তিনি তার স্ত্রীকে সেই তরল পদার্থ ছেলের মাথায় পুনরায় লাগানোর জন্য বার কয়েক বলে ফেললেন। স্ত্রী সাহানা বেগম বারবার শুনতে শুনতে চরম পর্যায়ে ক্ষেপে গিয়ে বললেন,
‘ছেলে অসুস্থ নয়। অসুস্থ তুমি নিজেই। আরেকবার ওই গু লাগানোর কথা বলেছ কি, আমি তোমার মাথা কামিয়ে পুরো মাথায় লাগিয়ে দেব।’
সফিক সাহেব স্ত্রীর কথায় হতভম্ব হয়ে বললেন,
‘এসব কী ধরনের কথা?’
সাহানা বেগম দাঁত চিবিয়ে বললেন,’ আমি শুধু শুধু কথা বলার মানুষ নই, করে দেখিয়ে দেবো হুম’,
সফিক সাহেব নিজেকে সংযত রাখতে পারলেন না, বললেন,’কার সাথে কথা বল, হুস নাই? বেয়াদব মহিলা.. চড় দিয়ে দাঁত সব ফেলে দেব।’ সাহানা বেগম তেড়ে এলেন স্বামীর কাছে,’মারো চড় দেখি’, সফিক সাহেব সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রীর গালে চড় বসিয়ে দিলেন।পরক্ষণেই মনে হলো কাজটা ভুল হয়েছে। আবার মনে হল, ঠিকই হয়েছে। যেভাবে এগিয়ে এসে চড় দিতে বলেছে, না দিলে আস্কারা পেয়ে মাথায় উঠত। ঘরের স্ত্রী জাতিকে এতটা আস্কারা দেওয়া ঠিক নয়। এই ঘটনা ঘটার আধা ঘণ্টার মধ্যে সাহানা তার স্বামী আর তার অসুস্থ ছেলেকে ফেলে বাপের বাড়ি চলে গেলেন। সফিক সাহেব অনেক চেষ্টা করেও সাহানাকে ফিরিয়ে আনতে পারলেন না। স্ত্রী ছাড়া তিনমাস অসুস্থ ছেলেকে নিয়ে কীভাবে কেটেছে তা মুখে বলা যায় না, ভয়ংকর অভিজ্ঞতা। বেদেনির মতো এই লোক আবার সেরকম চাটুকারিতায় ফেলে নতুন কোনো ঘটনার সৃষ্টি না করলেই হয় ভেবে তিনি উদাস গলায় লোকটিকে বললেন,
‘ আপনি পানি খান না?’
লোকটি আবারও মুখ তুলে সফিক সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন,’জি জনাব, খাই’
ভাঙা চোয়ালের মাঝে চোখের কোটর থেকে ভেসে ওঠা গোল গোল গহিন কালো চোখ দুটির দিকে তাকিয়ে সফিক সাহেব ধাক্কা খেলেন। যে কেউ এই চোখের দিকে তাকিয়ে আচমকা ভয় পাওয়া স্বাভাবিক। মুখ নামিয়ে রাখার জন্যে এতক্ষণ তিনি লক্ষ করেননি। তিনি এমন চোখ আর কখনো কারও দেখেননি। লোকটি সম্ভবত ব্যাপারটা জানে। তাই সবসময় চোখ নামিয়ে রেখে কথা বলায় অভ্যস্ত।’
‘তাহলে সমস্যা কী? খেলেন না কেন? বাইরে প্রচুর গরম। তাছাড়া আপনিও এসেছেন রোদে ঘেমে। সম্ভবত অনেকটা পথ হেঁটে এসেছেন’
লোকটি ক্ষীণ স্বরে বলল, ‘আমি খালি বৃষ্টির পানি খাই। আষাঢ় মাইসাা ঠান্ডা বৃষ্টির পানি।’
সফিক সাহেব লোকটির দিকে আবারও ভালো করে তাকালেন। এই কবিরাজি ব্যাবসায় রহস্য দিয়ে কথা বলে মানুষকে বিভ্রান্ত করে তার প্রতি উৎসাহিত করার ধান্দা পুরাতন। এসব নতুন কিছু নয়। এরা একেক জন একেক রকম কৌশল করতে অভ্যস্ত। তিনি এসব কৌশলের সাথে দুই যুগ ধরে কঠিনভাবে পরিচিত।
‘আপনি আষাঢ় মাসের বৃষ্টির পানি এখন কোথায় পাবেন? এখন বৈশাখ মাস। বৈশাখেও ঝড় বৃষ্টি হয়। আপনি কি বৈশাখের বৃষ্টির পানি খান ?’
‘জি না জনাব। সব বৃষ্টিই আল্লাহর রহমতের বৃষ্টি না।
আল্লাহর রহমতের বৃষ্টি আলাদা। এ বিষয়ে হাদিসে বর্ণনা আছে, মুসা নবি একবার আল্লাহ পাককে প্রশ্ন করলেন,’হে দয়াময় আপনে যখন আপনের বান্দার উপর নারাজ থাকেন, তার বোঝার উপায় কী? আল্লাহপাক কইলেন,’ ক্ষমতা, হিকমত বোকা লোকেরে দিই। টেকা পয়সা কৃপণ মানুষরে দেই। কৃপন লোক টেকা হিসাব করে আর খুশি হয় আর অসময়ে দিই বৃষ্টি। ‘মুসা নবি আবার জিগাইলেন,’তাইলে বান্দার উপর রাজি খুশি থাকলে বুঝব কেমনে? আল্লায় তখন কইলেন,’হিকমত নেক মানুষরে দিই। টেকা পয়সা দানোবান মানুষরে দেই আর সময়ের বৃষ্টি সময় মতো দিই। তাই সব বৃষ্টিই আল্লার রহমতের বৃষ্টি না। আমি আল্লাহর রহমতের বৃষ্টির পানি খাই।’
সফিক সাহেব লোকটির কথায় তেমন গুরুত্ব দিলেন না। গুরুত্ব দোবার মানসিক অবস্থা তার আর নেই। এইরকম দু’একটা উদ্ভট কথা এরা বলবেই। তিনি হেলাফেলায় বললেন,
‘খাদ্য খানা খান তো, নাকি তাও খান না?’
লোকটি মনে হয় সামান্য হাসল,’ জি খাই। খাদ্য খানা আল্লাহপাক যা হালাল করেছেন, তার সবই খাই। তবে নিজে রাইন্ধা কিছু খাইনা। অন্যের রান্ধন খাবার সম্ভব হইলে খাই। ‘
সফিক সাহেব মনে মনে ভাবলেন,কবিরাজি করবা চালবাজি থাকবেনা, তাই কি হয়? তবে চালবাজি করতে জানা কঠিন দক্ষতার মধ্যে পড়ে বলে তিনি মনে করেন। চালবাজির চাল জায়গামত বসিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার দক্ষতা সবার নিখুঁত হয় না। এই লোকটির চাল জায়গামত বসছে না বলেই সফিক সাহেবের একের পর এক প্রশ্ন তার চালের খেলা আগিয়ে নিতে সাহায্য করছে।
‘সম্ভব হলে মানে কী ? অসম্ভব হওয়ার কী আছে? নিশ্চয়ই স্ত্রী ঘরে রান্না করে’।
লোকটি আবারও হাসল মনে হল। এবারের হাসিটা আগেরটার চেয়ে স্পষ্ট। হাসিটা অনেকটা কোনো ছোটো বাচ্চার খেলার রহস্য বড়োরা যখন ধরে ফেলে হাসে তেমন। তাহলে লোকটি কি তার মনের কথা ধরে ফেলেছে ? এই কথা মনে করেও তিনি উড়িয়ে দিলেন। এই কবিরাজের থ্রট রিডিং জানার কথা না । এর চেহারায় ধান্দাবাজি স্পষ্ট। ধান্দাবাজি করেই এরা পেট চালায়।লোকটি মুখ তুলে তাকাল। তার মুখে রহস্যময় হাসি। তার চোখের দিকে চোখ পড়ে সফিক সাহেব আবারও চমকে উঠলেন মনে মনে।
‘জনাব, প্রথম কথা হইল, আমি ধান্দাবাজ মানুষ না। ধান্দাবাজি করে তারা যারা সংসার-ধর্মে জড়িত। আমি সংসার ধর্মে বান্ধা না। তাছাড়া আমি সবার চিকিৎসা করতে পারি না। সবাই আমার চিকিৎসায় ভালোও হয় না। যার চিকিৎসা আমি করতে পারি নিজ ইচ্ছায় সেখানে হাজির হই। যেমন আপনের এইখানে আসছি। আবার আরেকজনের প্রয়োজনে আরেকখানে চলে যাব। এ কারণে আমার কোনো ঠিক- ঠিকানাও নাই। সারাদ্যাশ ঘুইড়া বেড়াই। এখন আপনের প্রশ্নের উত্তর দেই,নুনের একটা দানাও ঋণ। আমি কোনোখানে ঋণ করি না। তবে যেখানে ঋণ শোধ করণ যায় সেখানে খানা গ্রহণ করি। আপনে কইলে আপনের খানা খাব। আপনের ঋণ শোধ করতে পারব বলেই খাব।’
সফিক সাহেব হকচকিয়ে যাবার কথা কিন্তু গেলেন না। লোকটি থ্রড রিডিং করে তার মনের কথা ধরেনি । সে যেটা করেছে, এটা একটা ধারণা থেকে করেছে।
‘নিজে রান্না করে না খেলে আপনি খান কী?’
”আল্লাহপাকের নেয়ামতের অভাব নাই জনাব। সারাবছর গাছ-গাছালিতে নানা পদের সবজি, ফল ফলে। কাছে টাকা থাকলে সেইগুলা কিনা খাই। আমার পিতাজি বলতেন, একেক সিজেনের ফলমূলে একেক রকমের গুণাগুণ দিয়াছেন আল্লাহপাক। সেই গুনাগুণ শরীরের একেক রোগের জন্য মহৌষধ। অতি টক সামান্য যে তেঁতুল তাতেও আছে উপকারী অ্যান্টি অক্সিডেন্ট। যেইটা হইল মানুষের হার্ট ফেল করা, ক্যান্সারের মতো রোগের যম। মানুষ বড়ো নাদান। তার নেয়ামতের রহস্য বুঝে না।’
এতক্ষণ কথা বলার পর এখন সফিক সাহেব উৎসাহ হারিয়ে ফেললেন। অযথা বাক্যব্যয়! লোকটি অধিক কথা বলে নিজেকে মহাজ্ঞানী প্রমান করার একটা ঠুনকো চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। মানুষ মাত্রই নিজেকে স্পেশাল করে জাহির করার একটা চেষ্টা করে। এই ধরনের লোকজনের মাঝে সেটা আরও প্রবলভাবেই থাকে। তিনি উদাস গলায় বললেন,
‘আপনি বসেন। আপনার ভিজিট চার্জ কত বলেন। খানাপিনা শেষে টাকা নিয়ে যাবেন।’
লোকটি বিনয়ে গলে গিয়ে বললেন,’আপনার মেহেরবানি ”
লোকটি পাশে পড়ে থাকা কাপড়ের ব্যাগ থেকে একটা সাদা শিশি বের করে সফিক সাহেবের দিকে বাড়িয়ে বললেন,
‘আপনে আগে আমার চিকিৎসা নেন, তারপর আমি আপনের খাদ্য-খানা গ্রহণ করব।’
সাদা পরিষ্কার শিশিটি তিনি অনিচ্ছায় হাতে নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বললেন,
‘এর ভিতর কি আল্লাহ পাকের রাজি খুশি থাকা রহমতের পানি?’
”জি। আপনে আমার সাথে আর দেখা করবেন না বলে মনে হয়। ভিতরে গিয়া আমার ভিজিট পাঁচশ টাকা পাঠিয়ে দেবেন। আর জনাব, আপনার সন্তানের মাতাকে বলবেন রোজ রাতে বোতল থেকে সামান্য পানি হাতে নিয়া ত্যালের মতো অসুস্থ সন্তানের মাথায় দিয়া দেবে। আর মনে মনে সাতবার বলবে হে করুণাময়, আপনে আমার সন্তানের প্রতি করুণা করেন। তাকে সুস্থ করে দেন। পৃথিবীতে মায়ের সমান দরদী আর কেউ হয় না। মায়ের দোয়া অবশ্যই আল্লহর আরসে পৌঁছাবে, এতে কোনো ভুল নাই। সন্তানের জন্য মায়ের দোয়া বিফলে যায় না, হাদিসে তারও বর্ণনা আছে।”
সফিক সাহেব আর কোনো বর্ণনায় সময় দিলেন না, শোবার ঘরে চলে গেলেন সরাসরি। ড্রয়ার খুলে টাকা বের করে মতির মায়ের হাতে দিতেই সে চোখ কপালে তুলে বলল,
‘ আচুউক্যা এক খয়রাতি আইসা এক বোতল পানি দিয়া পাচঁশ টেহা চাইল আর আপনে দিয়া দিবেন চাচাজি, এইডা কোনো কতা হইলে?
‘সফিক সাহেব মতির মাকে আবার একটা ঝাড়ি দিয়া পাঠিয়ে নিজের ব্যস্ততায় কবিরাজের কথা ভুলে গেলেন। সত্যিই আর তিনি দেখা করলেন না লোকটির সাথে।
দু’মাস পর এক দিবাগত রাতে সফিক সাহেব ভয়াবহ একটা স্বপ্ন দেখলেন। কবিরাজ লোকটি হাতের তালুতে বৃষ্টির পানি নিয়ে তার ছেলের সামনে ধরে ডাকছেন, ঠিক যেমন করে আমরা কুকুরের সামনে খাবার দিয়ে ডাকি। তার ছেলে ককুরের মতো চার হাত পায়ে লোকটির দিকে এগিয়ে গিয়ে চেটে চেটে সেই পানি খাচ্ছে। ছেলের চোখ থেকে টপ টপ করে পানি পড়ছে মাটিতে। ঘুম ভেঙে গিয়ে সফিক সাহেবের খুব মন খারাপ হলো। তিনি উঠে ছেলের ঘরে গিয়ে ছেলের বিছানার পাশে বসলেন। ঘুমন্ত ছেলের মুখের দিকে চেয়ে তার চোখ বেয়ে দু’ফোটা পানি নেমে এল। মনে মনে অনুনয় করে বললেন,
‘হে করুণাময় তুমি আমার সন্তানকে সুস্থ করে দাও, তার প্রতি রহম করো, করুণা করো। তিনি আলতো করে ছেলের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন।
তখনই বিস্ময়কর ঘটনাটা ঘটল। তার অসুস্থ ছেলে সঙ্গে সঙ্গে চোখ মেলে তাকিয়ে বলল,
‘বাবা, বাইরে কি বৃষ্টি হচ্ছে?’
সফিক সাহেবের আশপাশের জগত সামান্য সময়ের জন্য দুলে উঠল। তিনি কী শুনলেন! একি সত্যি? নাকি তিনি আবার কোনো স্বপ্ন দেখছেন? তিনি বুকে সুখের ব্যথা অনুভব করলেন। ঝাঁপসা চোখে বন্ধ জানালার দিকে তাকিয়ে কাদঁতে কাদঁতে বললেন,
‘হ্যাঁ বাবা বৃষ্টি হচ্ছে। আমি এতক্ষণ একদম বুঝতে পারিনি।’
সাথে সাথে তার মনে হলো, ‘এটা আষাঢ়ের বৃষ্টি ,এ হলো আল্লাহপাকের সময়ের বৃষ্টি। তার রহমতের বৃষ্টি। সফিক সাহেব বিছানা ছেড়ে ছেলেকে ডেকে নিয়ে ছাদে চলে গেলেন। কি ঠান্ডা শীতল সে পানি! প্রত্যেকটা পানির ফোঁটা সফিক সাহেবের ভিতরটাকে কাঁপিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। তিনি ছেলেকে বললেন,
‘আকাশের দিকে তাকিয়ে মুখ খুলে হা করে পানি খাও বেটা। এ পানি আল্লাহ পাকের রহমতের পানি,আষাঢ়ের পানি।’
-বেলা প্রধান