ছোট বউয়ের ঘরে সন্তান এলো। দিন দিনই সংসারটা বড় হচ্ছিলো। একসাথে ভাড়া বাসায় সবাই মিলে থাকা আর সম্ভব হচ্ছিলো না। সজল ঠিক সেই সময়টাতে একদিন এসে সবাইকে নিয়ে বসলো এবং জানালো সে নিজে দুটো ফ্লাট কিনেছে, একটাতে থাকবে রিপন তার বউ বাচ্চাদের নিয়ে আর অন্যটায় সজল উঠবে। মায়া বেগম আর রফিক সাহেবের উদ্দেশ্যে সজল বললো – আপনাদের দুটোই ছেলের বাসা, আপনারা যার সাথে ভালোলাগে তার সাথেই থাকতে পারেন। সিদ্ধান্ত আপনাদের।সব শুনে রফিক সাহেব ঘোষণা দিলেন -আমি তাহলে তোর সাথেই থাকবো। কেকার প্রতি এই সংসারে রফিক সাহেবের ভালোবাসা ছিলো বরাবরই। তিনিই সবার অলক্ষ্যে কেকার অসহায় মুহূর্তে কেকাকে সান্ত্বনা দিয়ে এসেছেন। ভালোবাসার ঋণ খুব কঠিন ঋণ। তাই কেকাও বিষয়টাতে খুশিই হলো।
সংসার আলাদা হলো।
মায়া বোগমের সাজানো সংসারটা আর নিজের রইলো না। কেকাদের সংসার গোছানোর দিন এলো। নতুন ফ্লাটে পুরাতন সব কিছু বাতিল হয়ে এলো নতুন নতুন আসবাবপত্র, এলো নতুন পর্দা সেই সাথেই সংসারে নিয়ম গুলো বদলে এলো নতুন নিয়ম। কেকার জীবনের নতুন অধ্যায় শুরু হলো এবার ।
মায়া বেগম এখন কেকার সাথে নরম সুরে কথা বলেন, মা মা বলা ছাড়া ডাক দেন না। কোথায় কী করতে হবে কেকার কথা ছাড়া কিছুই হয় না। মাঝে মাঝে মায়া বেগম উদাস গলায় নিজের অতীতের গল্প শোনায় – বুঝলা বউ, মায় মরছে সেই ছোডো বেলায়। যখন মায়ের বুকের দুধ খাওয়াও ছাড়ি নাই। মরা মায়ের চেহারাডাও মনে করতে পারি না। বাপে আর বিয়া করে নাই। বড় বড় বোন গুলার সব বিয়া হইয়া গেছিলো, আমি আছিলাম সব চাইতে ছোড। একবেলা রাইন্ধা খাওয়াইবো এমুন লোক আছিলো না বাড়িতে। বাপেও ইচ্ছা হইলে রানতো, না হইলে নাই। সয়সম্পদ তো কম আছিলো না বউ, খালি রান্ধোনের লোকের অভাব। এই বাড়ি সেই বাড়ি যাইয়া যদি খাওনের সময় বইয়া থাকতাম, তাইলে প্রথম প্রথম দুই এক বেলা খাওন দিলেও পরে লোকজন কইতো – বিলাইয়ের মতোন না কি খাওনের ওয়াক্ত হইলেই মাইষের দরজায় গিয়ে হাজির হই। কলা মুড়ি খাইয়াই দিন কাডাইছি, এইসব খাইয়া কী দিন কাডে বউ। প্যাডের খিদা প্যাডেই থাকছে। গায়ের রংডা আমার আছিলো ধবধবা ফর্সা, তাই দেইখা একটু বড় হইতে না হইতেই নানান জায়গা থিকা বিয়ার প্রস্তাব আইতে লাগলো, বাবায়ও দিশামিশা না পাইয়া বিয়া ঠিক কইরা ফেললো। তোমার শ্বশুর যখন আমারে দেখতে গেছিলো, দেখছে আমি ফ্রক পইরা কুতকুত খেলতে আছি। বারো বছর বয়সে বউ হইয়া আইছি গো মা। শাশুড়ির কাছেও আদর পাই নাই। দুইডা মুড়ি যদি নিয়া খাইছি তয়ও গালাগালি করছে। তোমার শ্বশুর তো সারাবছর থাকছে বাইরে বাইরে। আমারে কে দেখছে কও? যাও বা মাঝে মধ্যে আইছে, কোনদিন দুপুর বেলা যদি একলগে ঘুমাইয়া থাকতে দেখছে তয় চিৎকার চ্যাঁচামেচি কইরা বাড়ি মাথায় তুলছে আমার শাশুড়ি – আমি নাকি বেহায়া, বেলাজ।
বয়স আর আমার কতো কও তখন, সেই বারো বছর বয়স থিকা সংসারের ঘানি টানতাছি।
পোলাপান গুলা যখন হইছে কতকিছু খাইতে মন চাইছে কিন্তু কারে কমু সেই ইচ্ছার কতা, মাও আছিলো না যে তার কাছে গিয়া মনের সুখ দুঃখের কতা কমু, মায়ের আদর কী তাই তো বুঝি নাই গো মা , আদর ভালোবাসা শিখমু কেমনে? তোমার সাথেও এই জন্যই অনেক খারাপ আচরণ করছি, আমারে তুমি মাফ কইরা দিও মা। বলতে বলতে মায়া বেগম কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন। মায়া বেগমের কথা শুনে কেকারও মনটা আর্দ্র হয়ে ওঠে, সত্যিই তো প্রতিটি মানুষের জীবনের এক একটা গল্প থাকে, থাকে দুঃখ বেদনার না বলা কথা। প্রতিটি মায়া বেগম একদিন নতুন বউ হয়ে সংসারে আসে,নতুন সংসারে নিজের অবস্থা থাকে না সেদিন। হয়তো অনেককেই অনেক যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়। যার যার জীবনের দুঃখ সে ই বোঝে, সে ই জানে কতো কষ্ট বুকে জমা রেখে কাটিয়েছে জীবনের এক একটি প্রহর। প্রতিটি নারী জীবন যুগ যুগ ধরে যুদ্ধ করে আসছে, তাদের পরগাছার জীবনকে শিকড়ের সন্ধান দেওয়ার জন্য। মায়া বেগমের জন্য আজকাল মাঝে মাঝে মায়া হয় কেকার, মাঝে মাঝে মনে হয় – কী ক্ষতি নিজের একটা সন্তানের মতো ভেবে নিলে এই মানুষটাকে। না হয় সে ভুল করেছে, তাই বলে কী কেকাকেও একই ভুল করতে হবে? রফিক সাহেবের অবস্থা ভালো না, বেশ কিছুদিন ধরেই অসুস্থ ছিলেন তিনি। একদিন কেকাকে ডেকে নিয়ে পাশে বসিয়ে বললেন – মা,তোমার কাছে একটা কথা বলি,শোন। তোমার শাশুড়ি পাগল ধরণের মানুষ, কথাবার্তার ঠিক নাই, কী বলতে কী বলে নিজেই বোঝে না, এই পাগলটারে সেই ছোটবেলা থেকে আমি সামলিয়ে রেখেছি। তুমি মা তার কথায় রাগ করো না, তাকে তুমি দেখো রেখো। এই পাগলটাকে তুমি দেখে রেখো। তাকে আমি তোমার কাছে দিয়ে গেলাম। এটাই রফিক সাহেবের শেষ ইচ্ছে ছিলো। তিনি ভালোবাসা দিয়ে কেকাকে ঋণী করে রেখে ছিলেন। এই ঘটনার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই হঠাৎ এক সকালে তিনি মারা যান।
তার মৃত্যু মেনে নিতে অনেক সময় লেগেছিলো কেকার। মানুষটা ছিলো কেকার ভালোবাসা আর নির্ভরতার স্থান।
মেঝো ছেলে টুনিকে বিদেশে নিয়ে যায় , বহু বছর পর দেশে ফিরে এলেও মায়া বেগমের সাথে নানা কারণেই তাদের বনিবনা হয় না, ছোট ছেলে নিজের সংসার সামলাতেই হিমশিম খায় মায়া বেগমের দায়িত্ব নেওয়ার মতো অবস্থা তার নেই। শিপাও ব্যস্ত তার নিজের সংসার নিয়ে। সংসারে মায়া বেগমের একমাত্র আশ্রয় স্থান এখন কেকার সংসার। শরীরটা ক্রমশই দুর্বল হয়ে পড়ছে তার, আগের মতো আর মনেরও জোর নেই। অচল পা নিয়ে যখন বিছানায় শুয়ে শুয়ে কেকাকে ডাকেন, যখন সারাদিন বেঘোরে ঘুমান মায়া বেগম তখন কেকার মনে পড়ে এই মানুষটাই একসময় সারারাত রুদ্রকে নিয়ে জেগে থাকার পর সকালে ঘুম ভাঙ্গতে দেরি হলে কেকাকে বকেছেন কতো। অসুস্থ মায়া বেগমের এখন একটু পর পরই খিদে পায়, কেকাও সজলকে বলে এটা সেটা ফলমূল নাস্তা শুকনো খাবার আনিয়ে মায়া বেগমের শোবার খাটের পাশে রেখে দেয়, আর মনে মনে ভাবে এই মানুষটাই একসময় ছোট রুদ্রকে মাতৃদুগ্ধ দানকারী কেকার উদ্দেশ্য বলতো- রাক্ষসী রাক্ষসী। অথচ একটুও ভাবতো না, মায়েদের এসময় একটু বেশিই খিদে পায়।
কেকার কোল জুড়ে এলো তাদের দ্বিতীয় সন্তান, ফুটফুটে একটা ছোট কন্যা শিশু যখন কেকার গালে আলতো করে ঠোট ছুঁইয়ে তার নিষ্পাপ ভালোবাসার কথা জানান দেয় তখন কেকার পৃথিবীটা আনন্দে ভরে ওঠে, রুদ্রও বড় হয়ে উঠছে । কেকা নিজেকে এখন পৃথিবীর সবচেয়ে সুখি মানুষ ভাবতে শুরু করেছে , অথচ বিবাহিত জীবনের এই দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে দিতে কতবার তার মনে হয়েছে জীবনটাকে শেষ করে দিলেই ভালো হয়। কতবার বলতে না পারা অপমান আর যন্ত্রণার ভার সইতে না পেরে আত্মহত্যা করার কথা ভেবেছে সে, কিন্তু শুধু রুদ্রের মুখের দিকে তাকিয়ে শেষ পর্যন্ত নিজেকে সংযত করেছে কেকা। সে চলে গেলে রুদ্রের কী হবে? কেকা যদি চলে যায় তাহলে এই পৃথিবীতে ছোট এই অবুঝ শিশুটা ছাড়া অন্য কারও কী খুব বেশি কিছু ক্ষতি হবে? আজ বাদে কাল সবাই হয়তো তাকে ভুলে যেতো। অথচ জীবনের ঠিক এই মুহূর্তে সেই সব ঘটনার কথা ভেবে কেকার কত তুচ্ছই না মনে হয় যেসব ঘটনাগুলোর কারণে কেকা নিজেকে মৃত্যুর পথে ঠেলে দিতে চেয়েছিলো। কেকা এখন বোঝে জীবনের প্রতিকূল মুহূর্ত গুলোতে ধৈর্য্য ধারণ করতে হয়। কোন ঘটনাই জীবন চলার গতিকে থামিয়ে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়। আজ যে ঘটনা গুলো তোমাকে খুব কষ্ট দিবে, সময় চলে গেলে সেসব ঘটনাই হয়তো তোমার কাছে মূল্যহীন হয়ে পড়বে। তাই কেকাদের বলছি ধৈর্য্য ধারণ করে নিজেকে যোগ্য হিসেবে গড়ে তোলো – সময় সব কিছু ঠিক করে দিবে।
হয়তো কেকা এখন পারে তার অতীতের সব কষ্ট সব অপমানের প্রতিশোধ নিতে, কিন্তু তাতেই কী জিতে যাবে কেকা? হয়তো কেকার উচিত হয়নি মায়া বেগমের এত অত্যাচার সহ্য করা। কিন্তু সজলের মুখের দিকে তাকিয়েই সে সব সহ্য করে এসেছিলো শুধু ভালোবাসার জন্য। হয়তো কখনও সে সজলকে পাশে পেয়েছে, কখনও পায়নি। সজলের অপারগতা হয়তো তার ভালোবাসা, প্রতিটি সন্তান তার জন্মদাত্রী মাকে ভালোবাসে, যেমন রুদ্র ছোট শিশু হয়েও নিজের মায়ের কষ্ট সহ্য করতে পারেনি, তেমনি হয়তো সজলও। মাকে ভালোবাসাটা তাই অপরাধ না, তবে অন্যায় সহ্য করা অপরাধ। যে মেয়েটা তোমার জন্য সব কিছু ছেড়ে তোমার সংসারে একা অসহায় অবস্থায় অসহ্য মানসিক যন্ত্রণা ভোগ করে তাকে রক্ষা করা সজলদের দায়িত্ব। সজলদেরও বোঝা উচিত কেকারা নিজের বাবা মা ভাই বোন সব ফেলে রেখে একটা নতুন সংসারে আসে সজলদের জন্যই , তাদের জীবনটা কেন পরগাছার জীবন হবে? সবাই তো কেকা হয় না, কেউ কেউ টুনি, কেউ কেউ দোলা, কেউ কেউ শিপা হয়। সবার ভাগ্যও সমান হয় না।
কিন্তু কেকাদের মতো যারা, তাদের পাশে দাঁড়ানো উচিত সজলদের নয়তো সব কেকা দিনশেষে কেকা থাকে না, কেকা হয়ে যেতে পারে টুনি।
তবে কেকাদের বলছি সারাজীবন সব কিছু মুখ বুজে সহ্য করার কোন অর্থ নেই, তোমার অবস্থাই তোমাকে বুঝিয়ে দিবে কখন নিজের যৌক্তিক দাবির পক্ষে তোমাকে কথা বলতে হবে, সেজন্য সময়ের প্রয়োজন। নিজেকে এবং পরিবারকে সময় দিতে হবে।
একজন কেকার জীবনের গল্প একদিনের গল্প না, তিলে তিলে গড়ে ওঠা একটা জীবনের গল্প । মায়া বেগমরাও একদিন কেকাদের চেয়েও হয়তো কঠিন দিন অতিক্রম করে আসে, তারপর সংসারের ক্ষমতা হাতে পেয়ে পুরানো দিনের সব কথা ভুলে যান। ক্ষমতার দপটে তারা এটাও ভুলে যান একদিন তাকেও সংসারের ক্ষমতা ছেড়ে দিতে হবে কেকাদের হাতে। দিতে হবেই, এটাই প্রকৃতির নিয়ম। আজকের কেকাকেও একদিন আবার অন্য কাউকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান। তবে কেন শুরুতেই ভালোবাসা দিয়ে কেকাদের আপন করে নেওয়া যায় না? কেন অজস্র কেকারা বোকা মেয়ের গল্প পরে চোখ থেকে ঝরে পড়া অশ্রু নিরবেই মোছে? শুধু সজলকে ভালোবেসে একসাথে জীবন কাটাবে বলেই কী এতটা মানসিক যন্ত্রণা তাদের পাওনা ছিলো? এত কিছুর পরও মায়া বেগমরা কী আসলেই অন্তর থেকে বদলে যান?
সংসারে কেকাদের মতো কিছু কিছু বোকা মেয়ে আছে বলেই সংসারটা এখনও বন্ধন হীন হয়ে যায় নি। প্রতিবাদী টুনি,অথবা সব পাওয়া দোলারা যেমন সংসারে থাকে তেমন থাকে কেকারাও। যারা সব কিছু বুঝে শুনেও বোকা হয়েই থাকে সারা জীবন।আসলেই কেকারা খুব বেশি বোকা!! হয়তো কেকাদের জীবনের আরও অনেক অনেক কথাই এই গল্পে না বলাই থাকলো। থাকুক না হয় সেসব কথা না বলাই।
সব শেষে আর একটা কথা না বললে অন্যায় হবে, কোন কোন সংসারে শাশুড়িরাই উল্টো ছেলের বউকে আগলে রাখেন, শ্বশুররা বরং তখন মায়া বেগমের ভুমিকায় অবতীর্ণ হন। আমি এমন অনেক ঘটনাই দেখেছি। তাই কেকাদের যেমন সাবধান থাকতে হবে তারা যেন মায়া বেগম হয়ে না ওঠেন তেমনি কোন শ্বশুরও যেন বংশ গৌরব, আভিজাত্য, অর্থ এবং সম্পদের অহংকারে কেকাদের সাথে এমন আচরণ না করেন সেই অনুরোধ করেছি ।
-শামীমা হক ঝর্ণা