বাজান

জামিলা কেঁপে কেঁপে ওঠে । এ কিসের আলামত? কিছুদিন আগেই নামাজ পড়া ধরেছে জামিলা। কিন্তু নামাজ পড়তে গেলেই এক দাঁড়িওয়ালা সুপুরুষকে নামাজ পড়তে দেখে জামিলা। জামিলার মনোযোগ নষ্ট হয়। সে নামাজের ভিতরেই ঘোমটাটা আরো বেশি করে টেনে দেয়। কিন্তু কিছুতেই মনঃসংযোগ দিতে পারে না । বেশ কিছুদিন এভাবে যাওয়ার পরে একদিন তার স্বামী রহমতকে বলে কথাটা । স্বামী প্রথমে তাকে চরিত্রহীন বলে গালি দেয়। কিন্তু দুইদিন পর নিজেই বলে, ” বৌ, এইডে জ্বীনদের কাজ হতি পারে । তুই আজ পাক পবিত্র হয়ে এশার নামাজ পড়বি। নামাজ শেষে লোকডারে জিজ্ঞেস করবি, সে কি চায় ? আমরা কেউ ঘরে থাকবান না। আমাগের দেখলি আবার কতা নাও কতি পারে। ” জামিলার মনেও এই সন্দেহ উঁকিঝুঁকি দিচ্ছিল। আহারে ! শেষ পর্যন্ত জ্বীনদের নেক নজর বুঝি পড়লো তার সংসারে !

জামিলা এশার নামাজের আগে গোছলে যায়। সুগন্ধি সাবান দিয়ে মাথার চুল ঘষে । বাক্স থেকে গত ঈদে কেনা জরি পাড়ওয়ালা শাড়িটা পরে। জামিলার স্বামী আর শাশুড়ি সন্ধ্যার সময়ই চলে গেছে পাশের গ্রামে তার চাচা শ্বশুর বাড়ি । একলা বাসায় জামিলার কেমন ভয় ভয় করে । জায়নামাজ এর পাটি পেতে প্রথমে বেশ কিছুক্ষণ জিকির করে জামিলা । তারপর নামাজ পড়তে বসে । নামাজ শেষে জামিলা চোখ বন্ধ করে মোনাজাত ধরে । তারপর চোখ বন্ধ করেই ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করে, ” আপনি কিডা ? আমার কাছে কি চান ? “কেউ কোন কথা বলে না । জামিলা এবার বেশ শব্দ করেই বলে, ” আপনি কিডা? আমার কাছে কি চান ? ” এবার পুরুষ কন্ঠে কেউ একজন বলে ওঠে, ” ভয় পাসনে মা। আমি একজন জ্বীন। আমার নাম ওসমান । তোরে আমি মেয়ে বানাইছি। তোর কিছু উপকার করার নিয়ত করিছি আমি । তোরে একটা ক্ষমতা দিলাম আজ। তোর কাছে যে যেই নিয়ত কইরে আসবে, তাই পূরণ হয়ে যাবে । কাল সকালে উঠে পুরো বাড়ি ঘর দোর লেপবি। সন্ধ্যের থেকে এই ঘরে আগরবাতি জ্বালাবি। এশার নামাজ পড়ে জায়নামাজে বসে থাকবি। যারা ব্যবস্থা নিতি চাই, তাদের কবি, এক গ্লাস পানি নিয়ে বইসে থাকতি। সবার সমস্যা মনোযোগ দিয়ে শুনবি। তারপর পানিতে ফু দিয়ে দিবি। সেই পানি খালি সবার রোগ পনেরো দিনের ভিতর ভালো হয়ে যাবে । সবার সকল প্রকার মুশকিল পনেরো দিনের ভিতর আসান হয়ে যাবে । ”

পরের দিন সকালে জামিলার স্বামী আর শাশুড়ি বাড়ি ফিরলে জামিলা সব খুলে বলে তাদেরকে । সারা বাড়ি সুন্দর করে লেপে জামিলা । রহমত বাজার থেকে কিছু রঙিন কাগজ কিনে এনে বিয়ে বাড়ির মত করে ঘর সাজায়। এতদিনে বুঝি জ্বীনের সুনজর পড়েছে তাদের সংসারে । আশেপাশের বাড়ির বৌ ঝিরা জিজ্ঞাসা করে, ” তোগের বাড়ি এইরাম সাজাইছিস ক্যান? ম্যাজবান খাওয়াবি নাকি ?” জামিলা চুপ করে থাকে। রহমত বলে, ” আজ কিছু কওয়া যাবে না । যা হতি যাচ্ছে, তা যদি সত্যি সত্যি হয়, তালি তুমাদের সবার কপাল খুইলে গেলো মনে করো। আর তুমাদের শহরে দোড়োতি হবে না। বরং শহরের সবাই চইলে আসবে এখেনে। ” রাতের বেলা নামাজ পড়ে জামিলা বসে আছে জায়নামাজে । সামনে একটা নতুন পাটি বিছানো। রহমত একটা গ্লাসে পানি নিয়ে বসে আছে পাটিতে। রহমত বললো, ” খেজুর গাছ থেকে পইড়ে যায়ে আমার পায় বিশাল ব্যথা। আমার ব্যথা ভালো কইরে দেন হুজুর । ” জামিলা ফু দিয়ে দিলো পানিতে। রহমত পানি নিয়ে চলে গেলো বাইরে। দশ মিনিট পরে জামিলা ডাকলো, ” বাজান, ও বাজান? ” ওসমান জ্বীন কথা বলে না । প্রায় আধা ঘন্টা পরে সাড়া দিলো ওসমান জ্বীন। জামিলা বলে,

বাজান ও বাজান ?

-বল মা, কি সমস্যা?

-বাজান , আমার স্বামীর পায়ে ব্যথা । পানিতি ফু দিয়ে দিছি। ভালো কি হবে বাজান ?

-তিনবেলা অল্প অল্প কইরে পানি খাতি বলিছিস ?

-বলিছি বাবা ।

-ভালো হয়ে যাবে ।

জামিলার মনটা খুশিতে ভরে যায়। এখন তার নিজেকে সত্যি সত্যিই হুজুর মনে হয়। সকালে স্বামীকে জিজ্ঞাসা করে,

-তুমার পার ব্যথার কি অবস্থা?

-কি কবো বউ, রাতে শুধু একবার পানি খায়ে শুইছি। সকালে উঠে মনে হচ্ছে, আমি এখনি কাবাডি খেলতি যাতি পারবানে। আমার তো মনে কচ্ছে, এখনই তোর পায়ে হাত দিয়ে সালাম করি।

জামিলা ঘোমটাটা আরো টেনে দিয়ে বলে, “এসব কি কচছো তুমি ?!!! ” রহমত বাড়ির পিছনের বাগান থেকে দুটো কলা গাছ কেটে এনে গেট বানায়। রঙিন কাগজ দিয়ে বাড়ি সাজায়। জামিলা আর জামিলার শাশুড়ি মিলে ঘর লেপে। ঘরে জায়নামাজ পেতে আগরবাতি জ্বালায়। এতক্ষণে এই শুভ খবর সারা গ্রাম ছড়ায় পড়েছে। শফিকুলও সাক্ষী। পাঁচদিন আগে রস পাড়তে যেয়ে, তার সামনেই রহমত পড়ে গিয়েছিল । এত তাড়াতাড়ি হুজুরের দোয়া ছাড়া সেই ব্যথা যাওয়ার কথা নয়। গ্রামের মানুষদের আর কষ্ট করে শহরের হাসপাতালে যাওয়া লাগবে না । গ্রামবাসী নিজেদেরকে সৌভাগ্যবান মনে করছে, এত বড় একটা নিয়ামত তাদের গ্রামেই নাজিল হওয়ার জন্য । আস্তে আস্তে বাড়িতে ভীড় বাড়তে লাগলো । সারাদিন মানুষের আনাগোনা । কারোর ছেলের জ্বর, কারো বাতের ব্যথা, কারো ছাগল হারায় গেছে, কাউকে শহরের ডাক্তার বলে দিয়েছে, আর ভালো হবে না। যে মানুষ যায় ই মনোকামনা নিয়ে আসে, জামিলা মনোযোগ দিয়ে সমস্যা শোনে। তারপর গ্লাসের পানিতে ফু দিয়ে দেয়। রাতে নামাজ শেষে বাজানরে ডাকে। বাজানের কাছে সমস্যাগুলো বলার পরে বাজান বলে দেয়, ভালো হয়ে যাবে । পনেরো দিনের ভিতরেই মোটামুটি সবার সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। তবে দুই একটা সমস্যার সমাধান, বাজানের কাছে থাকে না । যেমন চেয়ারম্যানের বউ আসছিল, স্বামী অন্য নারীর প্রতি আসক্ত হয়েছে, সেই সমস্যা নিয়ে । বাজানরে বলার পরে বাজান বললো, এর চিকিৎসা আমি করবো না । এবং আজব ব্যপার হচ্ছে, পরের দিন চেয়ারম্যানের বউ আবার এসেছিল। বললো, ” হুজুর আমারে আবার একটু ব্যবস্থা দেন। গতকাল যে পানি নিছিলাম, তা আমার স্বামী খায়নি। রাইগে যাইয়ে ফেইলে দেছে।” জামিলা স্বর্গীয় হাসি হাসে। বলে, ” আমারে মাফ কইরে দাও চিয়ারম্যানের বউ। বাজান কয়েছে, চিয়ারম্যানের কোন ব্যবস্থা উনি দেবেন না । “

একদিন এক মেয়ে আসলো অন্য কোন গ্রাম থেকে। বললো, ” দুই বছর হলো রাইতে রাইতে জ্বর হয়। ভালো কইরে দেন হুজুর বাবা ।” জামিলা ফু দিয়ে দিলো । মেয়েটা বললো, ” ফু ভালো কইরে লাগিনি হুজুর বাবা । আর ইট্টু ফু দিয়ে দেন।” জামিলা বেশ অবাক হলো। এত দিনে এমন কথা কেউ বলেনি । জামিলা মেয়েটাকে ভালো করে খেয়াল করলো। জামিলার থেকে দুই এক বছরের ছোটই হবে । বয়স বড় জোর উনিশ বিশ । কিন্তু শরীরের গড়ন অসম্ভব সুন্দর । চেহারাটাও মাশাআল্লাহ । জামিলা বললো, ” কাছে আসো। ” এরপর যেই জামিলা গ্লাসে ফু দিলো, কাচের গ্লাসটা গেলো ভেঙে । উপস্থিত সবাই বলে উঠলো, ” সুবহান আল্লাহ । সুবহান আল্লাহ । ” সেদিনের পর থেকে গ্রাম থেকে গ্রামে, এমনকি শহরেও ছড়িয়ে পড়লো, এক মেয়ে, হুজুর বাবার ফুতে অবিশ্বাস করেছিল বলে, হুজুর বাবা রাগ করে ফু দেওয়াতে গ্লাসটা ই ভেঙে গেছে । গ্রাম এবং শহর থেকে বহু বহু লোক আসতে শুরু করলো। হার্টের সমস্যা, টিউমার, পাইলস, ডায়েবেটিস, ক্যান্সার, অবাধ্য স্বামী, পরীক্ষায় পাশ হয় না, বিয়ে হচ্ছে না এসব সব সমস্যার সমাধান নিতে মানুষ আসে জামিলার কাছে । জামিলা কারো কাছ থেকে টাকা চেয়ে নেয় না । যে যার খুশি মত টাকা দিয়ে যায়। মাঝে মাঝেই দুই একজন প্রচুর টাকা দিয়ে যায়। ছয়মাসের ভিতরেই রহমত গন্জে নতুন দোকান নিলো। তার দোকানেই সবচেয়ে ভালো ব্যবসা হয়। হবেই তো, স্বয়ং বাবার আশীর্বাদ রয়েছে তার সংসারে ।

দুই রুমের একটা পাকা দালান উঠেছে জামিলার বাড়িতে। সপ্তাহ খানেকের ভিতরেই মিলাদ দিয়ে উঠে যাবে পাকা দালানে। এর ভিতরেই একদিন রাতে বাবা বললো,

-মারে, আগামী তিন দিন তুই কারো চিকিৎসা দিবি না ।

-ক্যান বাবা ?

-কারণ আছে । আগামীকাল তুই রহমতরে কবি, পাশের গ্রামের শেখের বেটি সখিনারে বিয়ে কইরে আনতি।

জামিলা ভয়ে কেঁপে ওঠে । বলে,

-কি কও বাজান ?!!!

-ঠিকই কইরে মা। তুই এখন দ্বীনের পথে আছিস। এত এত মানুষের উপকার করিস। সংসার ধর্ম তোর জন্য না। এই সংসার টিকায় রাখার জন্নি, সখিনার খুব দরকার ।

-বাজান, এ কেমন বিচার? আমি কেমনে আমার স্বামীরে নিজ হাতে বিয়ে দেবো ? ( জামিলা কাঁদতে কাঁদতেই বললো )

আমার বিচারের উপর অবিশ্বাস করলি, আমি তোরে ছাইড়ে চইলে যাবো । সাথে কইরে নিয়ে যাবো, তোর সংসারের উপর আমার যে আশীর্বাদ ছিল, তাও। এইডেই কর। এতেই মঙ্গল । বিয়েতে তোর যাওয়া লাগবে না । তোর স্বামী গেলেই, তারা তাদের মেয়েরে তোর স্বামীর সাথে বিয়ে দিয়ে দেবে। বাড়ি আসলি তুই বরণ করে নিবি।

জামিলা কাঁদতে কাঁদতে বললো, আচ্ছা । পরের দিন সকালে জামিলা কাঁদতে কাঁদতেই স্বামীরে বাবার কথা জানালো। রহমত আকাশ থেকে পড়লো। বললো,

-কও কি বউ ! তুমি ছাড়া আমার দুনিয়া অচল। আমি এ কাজ পারবো না ।

জামিলা কাঁদতে কাঁদতেই বললো,

-আমি তো তোমারই থাকবো। বাবা কয়েছে, এতেই আমাদের মঙ্গল । বাবার কতায় অবিশ্বাস করলি, বাবা এ সংসার থেকে সব আশীর্বাদ নিয়ে চইলে যাবে।

সকাল থেকে যত লোক পথ্য নিতে আসলো, সবাই কে জানানো হলো, বাবা তিনদিন কোন ব্যবস্থা দেবে না । রহমত গেছে পাশের গ্রামের শেখের বেটি সখিনারে বিয়ে করতে । জামিলা সারাদিন মন খারাপ করে কাটালো। জামিলা কোনদিন সখিনারে দেখে নাই। তার মনে কু ডাক দিতে লাগলো ।বিকাল বেলা রহমত সখিনারে একটা বেনারসী শাড়ি পড়িয়ে বাড়িতে আনলো। রহমত নিজেও জরির কাজ করা পাঞ্জাবি পরেছে। মাথায় টুপি, মুখে রুমাল । জামিলা বুকে পাথর চাপা দিয়ে ঘোমটা সরিয়ে সখিনাকে দেখলো। হায় আল্লাহ! এ তো সেই মেয়েটা। যার হাতের গ্লাস ভেঙে গিয়েছিল !!! তবে কি রহমতের সাথে মেয়েটার কোন যোগসাজেশ আছে ! হয়তো কোন ভাঙা গ্লাস কোন রকমে জোড়া লাগিয়ে এনেছিল। জামিলা ফু দেওয়ার সাথে সাথে চাপ দিয়ে গ্লাসটা ভেঙেছে !
বাবার গলার স্বরটা অবিকল রহমতের মত । জামিলা ভাবতো, বাবা রহমতের কন্ঠে কথা বলে। তবে কি রহমত এতদিন ওকে বোকা বানিয়েছে !!! এসব জামিলা কিসব ভাবছে ? বাবা বলেছে, বাবার উপরে অবিশ্বাস করলে , এ সংসার থেকে বাবার আশীর্বাদ নিয়ে বাবা চলে যাবে । না, সে কিছুতেই বাবার উপরে অবিশ্বাস করবে না । কিন্তু মন মানছে না । কিছুতেই কান্না থামাতে পারছে না । এশার নামাজের পরেই জামিলা কোনরকমে নামাজ পড়ে ডাকলো, ” বাজান, ও বাজান? ” জ্বীন বাবা কোন উত্তর দেয় না । জামিলা জিকির করে আর কিছুক্ষণ পর পর কেঁদে কেঁদে ডাকে, ” বাজান, ও বাজান? আমার ভুল হয়ে গেছে । তুমার উপরে অবিশ্বাস করা আমার ঠিক হয়নি। মাফ কইরে দাও বাজান। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে বাজান। স্বামী আমার নতুন বউরে নিয়ে ঘরে দরজা দেছে। কি কইরে সহ্য করি কও ? আমার এই বিপদে তুমি রাগ কইরে চইলে যায়ে না বাজান। ” পাশের ঘর থেকে রহমত আর সখিনার খিলখিল হাসির শব্দ শুনতে পায় জামিলা ।

তিন দিন পর থেকে যখন মানুষ জন আবার ব্যবস্থা নিতে আসলো, তখন রহমত সবাইকে জানিয়ে দিলো, জামিলা নিজে বাবাকে অবিশ্বাস করেছে বলে, বাবা রাগ করে জামিলাকে ছেড়ে চলে গেছে । মানুষজনের আসা যাওয়া বন্ধ হলো । জামিলা বাবার কথা শুনেছিল বলে, সংসার থেকে বাবার আশীর্বাদ বাবা নিয়ে যায়নি। রহমতের দোকানে জমজমাট ব্যবসা চলে । শুধু জামিলা কারো সাথে কথা বলে না । অধিক শোকে ভাষাহীন হয়েছে জামিলা । সে শোক বাজান হারানোর জন্য নাকি স্বামী হারানোর জন্য, কেউ জানে না ।

-সুমনা তনু

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *