“কতটা পথ পেরোলে তবে পথিক বলা যায়?
কতটা পথ পেরোলে পাখি জিরোবে তার ডানা?
কতটা অপচয়ের পর মানুষ চেনা যায়
প্রশ্নগুলো সহজ, আর উত্তরও জানা।”
গাড়িতে বসে গুনগুন করল অনিমেষ।
ওর অসম্ভব ভালো লাগার এক গায়ক।
গায়ে স্নেহের হাত রাখলেন মা।
দীর্ঘ কুড়ি-বছর পর,আবার শান্তিনিকেতনের দোল উৎসব দেখতে যাচ্ছে অনিমেষ।
গতরাতেই ফিরেছে মুম্বাই থেকে।
কতবার মা বলেছেন, কেঁদেছেন..
“অনেক দিন তো হল।
ফিরে আয় বাবা.. মায়ের কাছে।”
জবাব না দিয়ে ফোন নামিয়ে রেখেছে।
মায়ের জন্য প্লেনের টিকিট পাঠিয়ে দিয়েছে। বাধ্য হয়ে মা নিজে এসে ওর কাছে দিন-কয়েক কাটিয়ে গেছেন।
শুধু..
অনিমেষ রয়ে গেছে মুম্বাইতেই।
কিন্তু.. এবার যে কী হলো! কেনও যে মন মানল না!
“আকাশে বহিছে প্রেম, নয়নে লাগিল নেশা
কারা যে ডাকিল পিছে! বসন্ত এসে গেছে…”
যার গলায় শুনেছিল প্রথমবার.. সেই ডাকল কি বহু যুগের ওপার থেকে?
মামার বাড়ী মানেই একটা আদরের জায়গা।
মা জোর করলো।
“চল খোকা.. দাদা বারবার করে বলেছে তোকে নিয়ে যেতে”
সেন্টিমেন্টাল সুড়সুড়ি আর কী!
..অগত্যা!
কী জানি!! কী ছিল বিধাতার মনে?
বসন্ত বাতাসে পলাশের নেশা… লাল হয়ে আছে রাস্তার দু’পাশ। লাল পলাশের পাপড়ি ছড়িয়েছে যতদূর চোখ যায়।
ঘোর লাগে চোখে।
আর একটু পরেই সূর্য বিদায় নেবে। লাল কমলা মিশিয়ে এক অবর্ণনীয় রঙ লেগেছে দিগন্তেও।
অনেকদিন পর ফুরফুরে লাগছিল মনটা।
গাড়ি থামতেই দৌড়ে এলো মামাতো ভাই রক্তিম সঙ্গে মৌপিয়া, ওর স্ত্রী।
“বাব্বা! শেষ পর্যন্ত এলি তাহলে?”
অনিমেষের খুব পছন্দের দুইজন। ভাইয়ের থেকে বন্ধু বেশি। ওরাই নিয়মিত ফোন করে যোগাযোগ রেখেছে।
নয়তো অনিমেষ নিজে যা আলসী!
নিজের মনেই হাসল।
মাও খুব খুশি সবাইকে পেয়ে।
হাত তুলে দেখাল রক্তিম।
“ওই দেখ… মনে পড়ে কিছু?”
উঠোনের একপাশে লালে লাল হয়ে আছে অনিমেষের ভালোবাসার নিশান। ঝেঁপে ফুটেছে লাল পলাশ। এই গরমেও ঠাণ্ডা হাওয়ায় টুপটাপ ঝরছে ফুল… যেন প্রকৃতি নিজেই গালিচা বিছিয়েছে।
“তোর মনে আছে? এই পলাশের গাছটা তুই লাগিয়েছিলি সেইবার যখন দোল উৎসবে এসেছিলি।”
তাকাল অনিমেষ।
আজ যেন এত বছর পর ফাগুনের আগুন লেগেছে পলাশে.. কিছু শুকনো ফুল ঝরে পড়েছে নিচে।
ওরা দুজনে মিলে সোনাঝুরির হাট থেকে কিনে এনেছিল শিশু মহীরুহ। নিজের হাতে লাগিয়েছিল।
নিচু হয়ে ফুল কুড়োতে যাবে,
“কেমন আছ অনি?”
চমকে তাকাল।
কে এ?বৃষ্টি নামল মন কেমনের গহীনে।
“বহু যুগের ওপার, হতে আষাঢ় এলো “
মধুবনী!!
মনে মনে একলাই ভিজতে থাকল অনিমেষ বুকের ভেতর ঘরে।
***********************
প্রথম যখন দেখা হয়েছিল,অনিমেষ তখন বি.কম পড়ছে, মধুবনী সবে টুয়েলভে উঠেছে।
সেই বসন্তে দোল উৎসবে যোগ দিতে এসেছিল, মধুবনী শান্তিনিকেতনে… দিদির বাড়ী।
মৌপিয়াই পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল।
“আমার ছোট বোন মধুবনী। আর ইনি হচ্ছেন আমার মিষ্টি একটা দেওর,অনিমেষ।
মধুবনী, অনিও দোল উৎসবে যোগ দিতে এসেছে…”
এক মুহূর্তের জন্য চোখ ফেরাতে পারেনি অনিমেষ।
বছর আঠারোর এক লাস্যময়ী যুবতী, দীঘল কাজল কালো চোখ, কোমর ছাপিয়ে নেমেছে একঢাল মেঘের মতো চুল। কাঁধ অবধি ঝোলানো টেরাকোটার দুল।
পরনে হলুদ রঙের ঘাগরা আর সাদা কুর্তি।
একটা অদ্ভুত মিষ্টি মনছোঁয়া গন্ধ ছড়িয়ে যাচ্ছিল চারিদিকে।
“তোরা গল্প কর। আমি চা নিয়ে আসছি..”
বলে চোখ টিপে চলে গেছিল মৌপিয়া।
ভেবলে বসে ছিলো অনিমেষ।
কলকল করে একথা, সেকথা বলেই যাচ্ছিল মধুবনী.. একলাই।
আর, অনিমেষ লক্ষ্য করছিল, মাথা নাড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আলতো গাল ছুঁয়ে যাচ্ছে লম্বা দুল দুটো।
খুব ইচ্ছে করছিল একটিবার ছুঁয়ে দেখতে।
দু’‘চোখ ভরে দেখছিল মধুবনীকে।
মনে হচ্ছিল, পৃথিবী থেমে যাক আজ।
অনন্ত হয়ে থাকুক এই পল।
*********************
“কী দেখছ বলতো এমন করে?”
প্রথমবার ও ঠিক একই প্রশ্নই করেছিল মধুবনী!!
চমকে উঠল অনিমেষ।
“তোমার জন্য অপেক্ষাতে দাঁড়িয়ে ছিলাম বলে,
মেঘ বলেছে খানিক আঁধার ঢেলেও,
বৃষ্টি আসুক আর কিছুক্ষণ পরে।”
“কত বছর পর দেখা হল ? প্রায় কুড়ি বছর হবে?”
কিন্তু!!
এ কোন মধুবনী?
কোথায় হারিয়েছে সেদিনের সেই উচ্ছল তরুণী?
হাড় ঝিরঝিরে শরীর, রিক্ত সিঁথি, নিরাভরণ গলা, কান, দু’হাত খালি.. পরনে সাদা শাড়ি।
রংহীন এক মূর্তি!
ঠিক যেন, এক একটা দিন বড় বেরঙিন, অসুখের মত আসে।
অনিমেষের মনে হল, দাঁড়িয়ে আছে এক অতলান্ত খাদের পাশে,পায়ের নিচে নড়বড়ে জমি.. টুং টাং শব্দে গড়িয়ে পড়ছে নুড়ি পাথর.. আলগা হচ্ছে..মন জমিন।
“চিনতে পারো নি বোধহয়?”
সম্বিত ফিরে পেল অনিমেষ।
“ভোলা যায় কি আমার মধুবনীকে?”
বেতস পাতার মতো থরথর করে কেঁপে উঠল সেই কাজল চোখের মেয়ে।
“কী বললে? তোমার মধুবনী?
***********************
পরদিন দোল উৎসবের রেশ শান্তিনিকেতনের অলিতে গলিতে।
হলুদ শাড়ি আর পলাশ খোঁপায়, অপরূপা সবাই.. ঢোল মাদলের সাথে গান ভেসে আসছে।
“ওরে গৃহবাসী খোল্, দ্বার খোল্,লাগল যে দোল..”
সবে চায়ের কাপে চুমুক দিয়েছে অনিমেষ, হৈ হৈ করে ছুটে এলো মধুবনী।
লাল আবিরে মাথা থেকে পা পর্যন্ত রাঙিয়ে দিল অনিমেষকে।
“তবে রে দুষ্টু মেয়ে…”বলে ওর থেকেই রঙ নিয়ে গালে লাগাল।
“ধ্যাত..” বলে পেছন ফিরতে যাবে, মধুবনীর চুল আটকে গেল অনিমেষের নীল পাঞ্জাবির বোতামে।
চুল ছাড়ানো জন্য ছটফট করছিল মধুবনী।
দু’হাতে আঁকড়ে ধরে অনিমেষ বলল,
“রোদ পোহানো চাদরখানা, শীত সকালে আমার হবে,
নীল যে বোতাম আজ ছিঁড়ল, সেও সেদিন ঐ জামার হবে।”
কার লাইন বলো তো?”
চোখ নিচু করে জবাব দিল মধুবনী।
“আমার অন্যতম প্রিয় কবি সাদাত হোসাইন…”
“তাহলে অন্য কিছু জিজ্ঞাসা করি কবির ভাষায়?”
গাঢ় গলায় বলল অনিমেষ।
“কোনদিন, আচমকা একদিন..
ভালোবাসা এসে যদি হুট করে বলে বসে,-
‘চলো যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাই’
যাবে?”
সেই শুরু..
প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয় ছিল রক্তিম আর মৌপিয়ারও।
দু‘জনে একে অপরের প্রয়োজনে,
অপ্রয়োজনে লতার মতো জড়িয়ে, ভাগ করে নিতে লাগল সুখ, দুঃখ..
কখন যে মনের কাছাকাছি এসে পড়ল!!
ইতিমধ্যে মধুবনী বি.এ পাস করেছে । অনিমেষ ততদিনে এম.কম পাস করে হন্যে হয়ে চাকরি খুঁজছে।
এমনি এক বসন্তের দিনে অনিমেষকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল মধুবনী।
“চলো,পালিয়ে যাই “
“মানে?”
“বাবা জানতে পেরেছেন তোমার কথা। কিছুতেই রাজী নন। দিদিও অনেক বুঝিয়েছে।”
কাতর অনুরোধ করেছিল অনিমেষ…মধুবনীর বাবার কাছে… পায়ে ধরেছিল।
“আমাকে কিছুদিন সময় দিন… আমি ভালোবাসি মধুবনীকে।”
“বেকার, বাউণ্ডুলে ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে?”
পা ছড়িয়ে চলে গেছিলেন উনি।
তারপর?
কত জল বয়ে গেলো গঙ্গা যমুনা দিয়ে কে খবর রাখে!!
বাবার পছন্দকরা পাত্রের সাথেই বিয়ে হয়েছে মধুবনীর.. খবর পেয়েছিল।
কত কত রাত না ঘুমিয়ে কেটে গেছে।
নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করেছে বার বার।
“ক’ফোঁটা চোখের জল ফেলেছো
যে তুমি ভালোবাসবে?”
বিধবা মায়ের মুখের দিকে চেয়ে নিজেকে সামলেছিল সেদিন।
পালাতে চাইছিল কলকাতা থেকে।
কপালগুণে চাকরি পেয়ে গেল এক ওষুধের কোম্পানিতে… সেলসম্যানের।
পোস্টিং বিহার।
তখন যা মেলে তাই আঁকড়ে ধরে বাঁচতে চাওয়া।
চলে গেল সীতামারী।
এ শহর সে শহর ঘুরে থিতু হল মুম্বাইতে।
ততদিনে প্রমোশন হয়েছে, দায়িত্ব বেড়েছে।
এখন ন্যাশনাল হেড নিজের ডিপার্টমেন্টের। ফ্ল্যাট, গাড়ি সব কিনেছে। শুধু…
আজও ঘর “ঘর “হয়ে ওঠেনি ঘরণীর অভাবে।
কাউকেই বসাতে পারেনি মধুবনীর জায়গায়।
******************
নিজেকে সামলে নিল অনিমেষ।
“এই সব কবে হলো?”
ম্লান হাসল মধুবনী।
“ভাগ্যের ওপর কি কারও হাত থাকে, অনি? অতিরিক্ত ড্রিংক.. লিভার, কিডনি দুটোই ফেল করেছিল.. আর বাকিটা আমার পাপ..”
“পাপ বলছো কেন?”
“সেদিন যদি সবাইকে খুশি করতে না গিয়ে নিজেকে খুশি করতাম, পালিয়ে যেতাম তোমার হাত ধরে, তাহলে হয়তো..”
থামল একটু..শ্বাস নিল খুব জোরে।
অনিমেষ বলল,
“বাদ দাও পুরোনো কথা। তোমার মেয়ে না ছেলে? তার কথা বলো।”
“মেয়ে.. মৌরভী.. টুয়েলভ দেবে এবার।
দাঁড়াও ডাকছি।”
ডাকতেই দৌড়ে এলো একটা রঙিন প্রজাপতি.. নাকি পরী!
পিঠে ফিনফিনে পাখা স্পষ্ট দেখতে পেল!!
আবার চমকে গেল অনিমেষ!
এ কাকে দেখছে? সেই কত বছর আগের
মধুবনী! হুবহু সেই চোখ, মুখ!
যেন সময় থমকে থেমেছে কুড়ি বছর আগে!
কলকল করে কথা বলছে!!
অস্ফুট স্বরে বলল অনিমেষ।
“একদম তোমার মতো, উজ্জ্বল, চঞ্চল, উচ্ছল…”
“শুধু চোখদুটো তোমার”
“মানে?”
বিস্ফারিত দু’চোখ অনিমেষের।
“বিমল জানতে পেরে গেছিল। আমি তখন দু’মাসের প্রেগন্যান্ট।”
“তারপরেও?”
“কী করতো? নিজের অক্ষমতা লুকিয়ে বিয়ে করেছিলো। তাই হয়তো… আমাকে মুক্তি দিয়ে গেলো।
যাক গো। আজ চলি?
তুমি আসছো, দিদির কাছে খবর পেয়েছিলাম। বড্ড ইচ্ছে করছিল একবার তোমায় দেখি।
কতকাল দেখিনি তোমায়…”
“এই বসন্তে অনেক জন্ম আগে
তোমায় প্রথম দেখেছিলেম আমি
হেঁটেছিলেম নিরুদ্দেশের পানে
সেই বসন্ত এখন ভীষণ দামী
আমার কাছে, তোমার কাছে..”
টুপটাপ ঝরে পড়ছে পলাশফুল। গালিচা বিছিয়েছে আঙিনায়। যেন কোনও অদৃশ্য শিল্পীর হাতে আঁকা নকশিকাঁথার আল্পনা।
অনিমেষ হাত ধরল মধুবনীর।
বলল,
“কবিগুরুর থেকে ধার নিয়েই বলি।
যে প্রশ্নটার জবাব এতকাল থেমে আছে, শুনব তোমার মুখে৷
সত্য করে বলবে তো?
‘আমাদের গেছে যে দিন একেবারেই কি গেছে- কিছুই কি নেই বাকি?”
মধুবনী চুপ করে রইল কিছুক্ষণ । তারপর খুব ধীরে বলল,
‘রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোর গভীরে৷’
অনিমেষ কুড়িয়ে নিল কিছু লাল পলাশ পাপড়ি। সাজিয়ে দিল মধুবনীর রিক্ত সিঁথি।
মৌরভীর হাত শক্ত করে ধরল অন্য হাতে।
“তোমার জন্য দাঁড়িয়ে ছিলাম বলে,
শিমুল ফুলের একটা নবীন কুড়ি,
পড়ল ঝরে অকাতরে, উতল হাওয়ার বুকের ভেতর কে সে প্রিয়তমা!”
শ্রাবণী গুহ
কবিতা কৃতজ্ঞতা স্বীকার :
সাদাত হোসাইন,হেলাল হাফিজ,অনুপম রায়,কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ