রুমানার আজকাল কি যে হয়েছে নতুন আসা এই স্যারকে দেখলেই ওর হার্টের একটা বিট মিস হয়ে যায়। সামনে দাঁড়ালে ঘেমে নেয়ে একাকার। সামনে তার ফাইনাল প্রফ, এসময় এ কি সমস্যা! যে রুমানার ধ্যানজ্ঞান শুধুই পড়াশোনা তাকে কি এসবে মানায়।। নতুন এই স্যার জয়েন করেছেন খুব বেশীদিন হয়নি, সপ্তাহ তিনেক হবে। ঝামেলাটা বেঁধেছে প্রথম দিনই। সবার কাছে নিজের পরিচয় দিয়ে, সবার পরিচয় জানতে চাইলেন স্যার। সবাই সবার পরিচয় দেয়ার পর যখন রুমানার পালা এলো, সে তার পরিচয় দিল রুমানা মমতাজ বলে।
স্যার প্রতি উত্তরে যখন ভরাট গলায় বললেন, ও তুমিই রুমা। কি যে হলো রুমানার। তারপর থেকেই স্যারকে দেখলে একটা বিট মিস হয়ে যায়।।
সপ্তাহে দুদিন স্যারের ক্লাস থাকে এই দুদিন রুমানা অধির আগ্রহে অপেক্ষা করে, আজ সেই দিন। কিন্তু আজ স্যার কলেজে আসেন নি। তার নাকি অস্ট্রেলিয়া না কোথায় স্কলারশিপ হয়েগেছে সেটা নিয়ে ব্যস্ত তার বদলে অন্য একজন আজকের ক্লাসটা নিয়েছেন। মনটাই খারাপ হয়ে গেছে রুমানার।। পরের ক্লাসটা না করেই হোস্টেলে চলে এসেছে, যা তার স্বভাব বিরুদ্ধ, সে কাজটাই আজ সে করেছে। ফাইনাল প্রফের আগে একটা ক্লাস মিস করা মানে নিজের পায়ে কুড়াল মারা।।
তবুও কিছু করার নেই।
হোস্টেলে নিজের রুমে এসে ব্যাগটা টেবিলে রেখে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লো বিছানায়।
রুমানাকে বিছানায় শুয়ে পড়তে দেখে রুমমেট জারা মুচকি হেসে বললো,
: কি রে, ক্লাস না করেই চলে এলি?
: এমনি, ভালো লাগছে না। তুই গেলি না?
: শরীরটা ভালো না। পেট ব্যাথা।
: শরীর খারাপ নিয়ে হোস্টেলে পড়ে আছিস কেন? বাসায় চলে যা। কাল পড়শু তো কলেজ বন্ধ, দুদিন রেষ্ট নে।
: আর রেষ্ট, বাসায় অনেক ঝামেলা। ভাইয়ার বিয়ে নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে। হুট করে লেগে যেতে পারে।
: তোর বাসার মানুষ কি রে? সামনে তোর ফাইনাল প্রফ, এ সময় কেউ বাসায় বিয়ে লাগায়?
: আরে বিয়ে তো আমার না, ভাইয়ের, আমার সমস্যা কোথায়।
: তবুও।
কলেজে যাওয়ার সময় ফোনটা সাথে নেয় না রুমানা। সবাই জানে এ সময় সে ক্লাসে থাকে। তাই খুব একটা কেউ ফোন দেয়না এ সসময়। ফিফথ ইয়ারে ওঠার পর নকিয়ার সাধারন একটা সেট কিনেছে রুমানা। যেটাতে নেট ব্যবহার করা যায় না। ফেসবুক, ওয়াটস আপ ভাইবার এ সব কিছু থেকে, এবছর ছুটি নিয়েছে সে। এবছর শুধু পড়া আর পড়া। যে করে হোক ফাইনাল প্রফটায় তাকে ভালো রেজাল্ট করতেই হবে। আনমনে বালিশের নিচ থেকে মোবাইলটা বের করে রুমানা। গুনে গুনে তেরোটা মিস কল। দেখে চমকে যায় সে। সব গুলো বাসা থেকে। বাবার কিছু হয়নি তো? কলব্যাক করার সাহসটুকুও হারিয়ে ফেলে।
: কি রে, কি হল তোর? শরীর খারাপ লাগছে? রুমানার চেহারার হঠাৎ এ পরিবর্তন দেখে প্রশ্ন করলো জারা।
: না না। বাসা থেকে, তেরোটা মিস কল।
: তো, কি হয়েছে? কলব্যাক কর।
: ভয় লাগছে।
: আরে কর, ইনশাআল্লাহ ভালো খবরই শুনবি।
তাদের কথার মাঝেই ফোনটা আবার বেজে উঠলো।
দাদাভাই, নামটা দেখে কাঁপা হাতে ফোনটা রিসিভ করলো রুমানা।
কিছুক্ষন কথা বলে ফোনটা রেখে দিল।
: কি হলো? দাদাভাই কি বললো?
: বললো, বাড়ী যেতে, খুব জরুরী, তিনটার বাসের টিকেট কেটে রাখা আছে কাউন্টারে। আমার খুব ভয় লাগছে রে।
:বাসার সবার কথা কি বললো? বললো তো ভালো আছে।
: নে ওঠ, সময় বেশী নেই, যা নেয়ার গুছিয়ে নে। আমি তোকে বাসে উঠিয়ে দিয়ে বাসায় চলে যাবো।
বাসে বসেও দুশ্চিন্তা কমেনা রুমানার। কি এমন জরুরী দরকার পড়লো যে তাকে এই অসময়ে ডেকে আনতে হলো।
মায়ের ফোনে ঘুম ভাংলো রুমানার, ভাবতে ভাবতে আর বাসের দুলুনীতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল বুঝতেই পারেনি।।
: কি রে, বাস কতদূর এলো?
: এই তো মা, আর আধ ঘন্টার মতো।
: ও, তোর বাবা খুব টেনশন করছে তুই এখনও এসে পৌঁছলি না। মায়ের কথা শেষ হবার আগেই ছোট ভাই টা মায়ের কাছ থেকে ফোনটা নিয়ে নিলো।
: আপু, জানিস কাল না তোর বিয়ে।
: কি যা তা বলছিস।
: সত্যি বলছি। চেয়ারম্যান দাদার নাতী সাজুর সাথে। কিছুদিন আগে এই লোকটা বিদেশ থেকে এসেছে, আবার বলে কথাটা শেষ করতে পারলো না ছোট ভাইটা, কেউ একজন ফোনের লাইনটা কেটে দিল।
ছোট ভাইয়ের মুখে বিয়ের কথাটা শোনার পর থেকেই মেজাজটা সপ্তমে চড়ে গেলো রুমানার। সে একটা শিক্ষিত মেয়ে অথচ তার বিয়ে ঠিক করার আগে তার মতামত নেয়ার প্রয়োজনটুকুও মনে করলো না তার পরিবার। এই কি সমাজে আমরা বাস করছি। কান্না পাচ্ছেনা রুমানার, ভীষন রাগ লাগছে। বাড়ীর প্রায় কাছাকাছি চলে এসেছে। এই মূহুর্তে ঢাকায় ফেরার কোনো উপায় নেই। না হলে ফিরে যেতো রুমানা।
গাড়ী থেকে নেমেই দেখলো দাদাভাই দাঁড়িয়ে আছে। সিএনজি সাথে নিয়ে।
একটা কথাও বললো না রুমানা। রাগে তার সমস্ত শরীর জলছে।
যার সাথে বিয়ে দিচ্ছে দিক। এই লোকটার সাথে সে একদিনও থাকবে না। পরদিনই হোস্টেলে চলে যাবে। পরিবারের মানসম্মান গেলে যাবে। সে এখন আর কাউকে কেয়ার করবে না। যাদের কাছে তার মতামতের কোনো মূল্য, সে তাদের আর মূল্য দেবেনা।
বাড়ীতে ঢুকেই বুঝতে পারলো বিশাল উৎসব উৎসব ভাব চারিদিকে। ছোট খালা এসেছেন, বড় ফুফু এসেছেন। তাদের বাচ্চাকাচ্চারা এসেছে।
মা তাকে দেখে বললেন, কি রে তোকে এমন দেখাচ্ছে কেনো?
: যে যেমন, তাকে তো সে রকমই দেখাবে। বেশ ঝাঁঝালো কন্ঠে উত্তর দিল রুমানা।
রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল রুমানা। কিছুটা সময় একা থাকতে চায় সে। সব কিছু থেকে। আজ সকালেই জ্ঞান দিয়েছিল জারাকে কি রকম ফ্যামেলী তাদের মেয়ের ফাইনাল প্রফের আগে ভাইয়ের বিয়ে লাগায়, আর এখন তার ফ্যামেলী কি করলো,স্বয়ং তার বিয়েই লাগিয়ে দিল তাকে না জানিয়ে।
দরজায় টোকা পড়লো। বাবা দাঁড়িয়ে আছেন দরজায়, মা রে আমি জানি, সামনেই তোর ফাইনাল প্রফ। এ সময় বিয়ের ব্যাপারটা হওয়া উচিৎ হয়নি। কিন্তু কি করবো বল, সবাই যেখানে রাজী, তাছাড়া সাজু এবার যখন দেশের বাইরে যাবে এক বছরের মধ্যে আসতে পারবে না। আরও এক বছর আমি বেঁচে থাকবো কি না কে জানে।
বাবার কথার উপর একটা কথাও বলতে পারলোনা রুমানা। অথচ তার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হচ্ছিল সে সাজু নামের এই লোকটাকে বিয়ে করতে চায়না।।
কথাছিল আজ শুধু কাবিন বা আকদ হবে। পরে রসুমাত। কিন্তু এখন শোনা যাচ্ছে ছেলে তার পরিবার নিয়ে এসে রাতেই রুমানাকে নিয়ে যেতে চাচ্ছে।।
সব শুনে রুমানা যেনো অধিক শোকে পাথর। বর এসেছে, বর এসেছে, বাচ্চারা হৈ হৈ করে চিৎকার করছে।
এমন সময় জারা এসে রুমানার ঘরে ঢুকলো। জারাকে দেখে, জড়িয়ে ধরে কাদতে শুরু করলো রুমানা।
: আরে আরে কাঁদছিস কেনো? আর কি ভূতের মতো চেহারা বানিয়ে রেখেছিস।
আমার ভাই দেখে যে ভয় পেয়ে যাবে।
: তোর ভাই মানে?
: মানে আবার কি? যার সাথে তোর বিয়ে হয়েছে সে আমার ভাই।
: আমার এতোবড় সব্বনাসটা তুই করলি?
: আমি আবার কি করলাম। হাসতে হাসতে বললো জারা। যা করার তুই ই করলি।
গাড়ী যখন বরের বাড়ীতে ঢুকলো, রাত শেষ হতে খুব বেশী সময় তখন বাকী নেই। সবাই ভীষন ক্লান্ত। কোনো রকম বউ বরণ করে, রুমে ঢুকিয়ে দিয়ে যে যার মতো ঘুমাতে চলে গেলো।
রুমানার সব কিছু মিলিয়ে প্রচন্ড বিরক্ত লাগছিল। না জেনেশুনে, না দেখে একটা মানুষকে বিয়ে করেছে। ভেবেছিল বিয়ের পর দিনই চলে যাবে হোস্টেলে কিন্তু এখন ওখানে গিয়েও শান্তি নেই কারন জারা তার রুমমেট। হে খোদা এ কোন পরীক্ষায় ফেললে আমাকে। এমন দিন যেনো আমার দুশমনের জীবনেও না আসে।
দরজা খোলার শব্দে চোখ তুলে তাকালো রুমানা। তাকিয়েই থাকলো মানুষটার দিকে। সে কি ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছে, না কি জেগে জেগে দৃষ্টিভ্রম হচ্ছে। লোকটা পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে রুমানার হাত দুটো ধরে বললো, কি ব্যাপার রুমা, আমাকে কি ভূতের মতো লাগছে?
সমস্ত লাজলজ্জা ভুলে মানুষটাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে রুমানা বললো, এই ভূতটাকেই যে আমি বড্ড ভালোবাসি।
-জাহেদা মিমি