রাত সোয়া বারোটা বাজে, আমি বিছানার এক কোণে বসে ফেসবুকিং শুরু করলাম। আমার সদ্য বিবাহিত স্বামীটি চার হাত-পা ছড়িয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে এমনভাবে ঘুমাচ্ছে যে ,বিছানার এদিক-ওদিক কোন দিকেই আমি নিজের শরীরের মাপ মতন জায়গা খুঁজে পেলাম না। তের ঘন্টা জার্নি করে এসে আবার বিবাহ সংক্রান্ত জটিলতা সারতে ভীষণ টায়ার্ড হয়ে পড়েছি। কিছুক্ষণ পূর্বে নামাজ পড়ার পর অবশ্য ভাবছিলাম, জায়নামাজেই শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। কিন্তু ঐটুকু জায়গার মধ্যে শোয়ার চেয়ে বসে ফেসবুকিং করে রাত কাটানোটাই বেশী আকর্ষনীয় মনে হল। স্বামীর নাক ডাকার শব্দে অবশ্য সে কাজেও ব্যাঘাত ঘটছে। তার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। কি নিস্পাপ ভঙ্গিতে নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে সে। তাকে দোষ দিয়েই বা কি লাভ ! সেও প্রায় দশ ঘন্টা জার্নি করে এসে সারাদিন কাজ করে ছুটতে ছুটতে এসে আমাকে কাজী অফিসে নিয়ে গেছে। আমি রেডী হয়ে দু’ঘন্টা অপেক্ষা করে বিরক্ত হয়ে তাকে ভয় দেখিয়ে বললাম ,
-শাড়ী খুলে এবার কিন্তু আমি থ্রিপিস পরে বসে থাকব।
-আচ্ছা, ঠিক আছে।
মুহূর্তেই ফোনটা কেটে গেল। আমি জানি, আমার চেঁচামেচি শোনার ভয়েই সে কল কেটে দিয়েছে। সেও জানে, মুখে যাই বলি না কেন, আমি শাড়ী পরেই বসে থাকব। কারণ, তার কোন ইচ্ছেকেই আমি অশ্রদ্ধা করিনা কখনো। সেই চেয়েছে আজ যেন আমি শাড়ী পরি। যদিও সে নিজে বিয়ে উপলক্ষে আমার জন্য কোন শাড়ী কেনেনি। দু’দিন আগে আমি নিজেই খুঁজে খুঁজে নিজের জন্য একটা নীল জামদানী কিনলাম ।শাড়ীর সাথে সবকিছু ম্যাচিং করলাম আগের রাত পর্যন্ত। সব শুনে সে বলল,
-আচ্ছা, ঠিক আছে। ভালই করেছো। তবে নীল না কিনে সবুজ জামদানী কিনলে আরও ভাল হতো।
সে বিকট শব্দে নাক ডাকে শুনেছিলাম । যতটা ভেবে রেখেছিলাম, নাক ডাকার শব্দটা অবশ্য ঠিক ততো জোরে নয়, কিঞ্চিৎ কম। তাকে দেখে হাসব না কাঁদব বুঝতে পারছিনা। শেষ পর্যন্ত বাসর রাতটা এভাবেই পার করতে হবে ভাবিনি। অবশ্য আমি নিজেও যে এ নিয়ে খুব বেশী আশাবাদী ছিলাম তাও না। তবু ভেবেছিলাম, শাড়ী পরে, কপালে একটা বড় নীল টিপ দিয়ে খোলা চুলগুলো ঘাড়ের একপাশে রেখে, বেশ রাত পর্যন্ত তার সামনে বসে গল্প করব। সে সেসবের ধারেকাছেও গেল না। কাজী অফিস থেকে বের হয়ে একটা চাইনিজ হোটেলে রাতের খাবার খেয়ে আমাকে নিয়ে তার ফ্ল্যাটে উঠল । ফ্ল্যাটটা বন্ধ থাকে প্রায় সারাবছর, সে থাকে দূর প্রান্তে। ফ্ল্যাটে ঢুকে বাসার ভেতরের অবস্থা দেখে প্রথমেই আমি ঝাড়ু খুঁজতে লাগলাম। সে একখানা চাদর হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,
-তাড়াতাড়ি বিছানা ঠিক করো, আমি শুব।
আমি তাড়াতাড়ি বিছানা ঝেড়ে চাদর পাততেই সে লম্বা হয়ে শুয়ে বলল,
-তাড়াতাড়ি আসো, শরীরটা একটু মাসাজ করে দাও।
কোন রকমে ঘরটা ঝাড়ু দিয়ে পরিষ্কার করে শাড়ীটা খুলে থ্রিপিস পরলাম। উপায় না থাকায় তার সামনেই পোষাক চেঞ্জ করতে খানিকটা ইতস্তত লাগলেও সে কিন্তু এ দিকে ভ্রুক্ষেপ করল না। আমি ফ্রেশ হবার জন্য বাথরুমে ঢুকব, সে আবার বলল,
-কই আসো, শরীরটা ব্যথা করছে।
আমি বিছানায় উঠে তার শরীরে মাসাজ শুরু করলাম। উপুড় হয়ে শুয়ে সে একবার বলে ডান পা, আবার বলে ডান হাত, কখনো বাম পা, কখনো বাম হাত।মাসাজ শুরুর পনের মিনিট যেতে না যেতেই সে চার হাত-পা চারদিকে ছড়িয়ে নাক ডাকা শুরু করল। আমি উঠে গিয়ে ওজু করে নামাজ পড়ে ফেললাম। কোন কারণ ছাড়াই আমি ভেবে নিলাম, এই সময়ের মধ্যে তার ঘুম ভেঙে যাবে। সেরকম কিছুই হলনা । সে ঘুমাতেই থাকল। বেচারার জন্য আমার কিছুটা খারাপই লাগছে। খুব বেশী রোমান্টিক না হলেও তাকে বেরোমান্টিক বলা চলেনা। বিয়ে নিয়ে তার নানারকম পরিকল্পনা ছিল।
-বিয়ের পর সোজা আমরা হানিমুনে চলে যাব থাইল্যান্ড ।
-বিয়ে করে ঐদিনই আমরা কক্সবাজার চলে যাব।
-বিয়ে করে আমরা ফাইভ স্টার হোটেলে গিয়ে উঠব।
এসবের কোনটাই হল না। বাসা থেকে আমার বিয়ের জন্য কিছুটা প্রেসার থাকায় তড়িঘড়ি করেই আমরা বিয়েটা সেরে ফেললাম। যদিও বিয়ের সিদ্ধান্তটা নিতে আমরা যথেষ্ট সময় নিয়েছি। গত দু’বছর নিজেদের ভালভাবে চিনে-বুঝে তবেই একসাথে পথচলার ব্যাপারে একমত হয়েছি। ভেবেছিলাম, দুজনে বেশ গুছিয়ে বিয়েটা সারবো। কোন পরিকল্পনাই টিকল না। খুব সাদামাটা বললেও ভুল হবে, বরং নি:শব্দে হয়ে গেল আমাদের বিয়ে।
বিকেল পাঁচটায় পৌঁছানোর সিদ্ধান্ত থাকলেও, আমার যখন কাজী অফিসে গিয়ে বসলাম ঠিক তখনই মাগরিবের আজান শুরু হল। এত দ্রুতগতিতে কাজী বিয়ের কাজটা শেষ করল যে, একটা ছবি পর্যন্ত তোলার অবকাশ পেল না কেউ। বিয়ে নিয়ে আমার ভেতরে সামান্য পুলক কাজ করলেও কাজীর তৎপরতায় সব কেমন গুলিয়ে গেল। কাজী অফিস থেকে বের হয়ে সে সোজা মসজিদে ঢুকে গেল মাগরিবের নামাজের উদ্দেশ্যে। আমি ব্যস্ত রাস্তায় দাঁড়িয়ে রইলাম স্বাক্ষীসমেত। আমার উকিল বাবা আমার হাতে একটা মিক্সড ফ্রুটজুস ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
-আপনার কি কোন বিশেষ অনুভূতি হচ্ছে?
আমি মৃদু হেসে জবাব দিলাম,
-বুঝতে পারছিনা।
-আপনাকে দেখেও আমার তাই মনে হচ্ছে।
-আর ওকে দেখে?
-পুলিন ভাইয়ের মধ্যে পরিবর্তনটা চোখে পড়েছে।
-কি দেখে বুঝলেন?
-যখন উনি কবুল বললেন, উনার মুখ দেখে মনে হল।
-কি রকম?
-মনে হল, একটা বুলেট বিঁধল।
পুলিন মসজিদ থেকে বের হতেই আমরা স্বাক্ষীদের নিয়ে আড়ংয়ে ঢুকলাম ওদের পাঞ্জাবী কিনে দেব বলে। ওদের পছন্দমত কেনাকাটার ফাঁকে আমিও পুলিনের জন্য আমার শাড়ীর কালারের সাথে ম্যাচিং নীল কালারের পাঞ্জাবী খুঁজতে লাগলাম। যদিও আজ ও যে নীল পাঞ্জাবীটা পরেছে সেটা আমিই কিনে এনেছি। আমার জামদানী শাড়ীর সাথে ম্যাচিং করতে চাইলেও মফস্বল শহরে পুরোপুরি মেলাতে পারিনি পাঞ্জাবীর রঙটা। তার পাঞ্জাবী নিয়ে আমার অযথা তৎপরতা দেখে তাকে কিছুটা বিরক্ত মনে হল। আমি বললাম,
-এসো, এখন দুজনে একটা ছবি তুলি।
সে আরও বিরক্ত হল দেখে বললাম,
-না হয় একটা সেলফি তুলি। বিয়ের দিনে দুজনের একটা ছবি থাকবেনা, এ কেমন কথা !
-ছবি নিয়ে এত মাথাব্যথার কি আছে? আজই কি আমাদের শেষ দিন নাকি? পরে তুললেই হবে।
আমাদের দুজনের খুব স্বাভাবিক আচরণ দেখে উকিল বাবা কয়েকবার মনে করিয়ে দিল,
-আজ কিন্তু আপনাদের বিয়ে হয়েছে।
-হুম।
-আপনি অন্তত: হাতে মেহেদী পরতে পারতেন !
আমি হাসলাম। অনেকদিনের শখ ছিল, জামদানী পরে বিয়ে হবে। ব্যস, সেটুকু পূরণ করেছি। না হাতে মেহেদী, না গায়ে গহনা, কপালে টিপ না, দু’হাত ভরা চুড়ি না। এমনকি ছিনতাইয়্রের ভয়ে তার দেয়া সোনার কঙ্কন জোড়াও খুলে রেখে এসেছি। শুধু ঠোঁটে হালকা লিপষ্টিক আর পরনে নীল জামদানী। অথচ, একসময় বিয়ে নিয়ে আমার কত স্বপ্ন ছিল। প্রথম বিয়েতে যখন এই স্বপ্নগুলো পূরণ হয়নি, তখন খুব কেঁদেছিলাম। আমার মায়ের পুরনো একটা হাফসিল্ক শাড়ী পরে বিয়ে হয়েছিল সেবার। না ছিল কোন সাজ, না সানাই। বাসর রাতে মোমবাতির আলোয় তাকে আমার পর্ণ সিনেমার নায়ক ছাড়া অন্যকিছু মনে হয়নি। মনে করার কোন অবকাশই পাইনি। সবচেয়ে বেশী আহত হয়েছিলাম, যখন সারারাতের পাশবিক খেলা শেষে সে বিছানায় আমার সতীত্বের চিহ্ন খোঁজা শুরু করেছিল। এরপরেও পরিবারের মুখের দিকে চেয়ে আরও কতগুলো বছর ঐ লোকটার সাথে কাটিয়েছি। কি ভীষণ ভয়ঙ্কর ছিল দিনগুলি। রাত মানেই যেন এক বিভীষিকা। যেন আমি এক ভোগ্যপণ্য ছাড়া অন্য কিছু নই।
পুলিনের সাথে আমার কাকতলীয়ভাবে পরিচয় হয় সেই সময়, যখন একাকীত্ব, সামাজিক যন্ত্রণা আর পারিবারিক চাপে প্রতিনিয়ত হতাশার সাথে যুদ্ধ করতে করতে আমি ক্লান্ত প্রায়। প্রতিদিনই যখন একবার করে আত্মহননের কথা চিন্তা করি, তখনই ফেরেশতার মতই সে আমার জীবনে উদয় হল। সে আমাকে এক প্রকার টেনে-হিঁচড়েই হতাশা থেকে বের করে নিয়ে আসলো। প্রাথমিক ধাক্কাটা পার হতেই আমি নড়েচড়ে বসলাম, ভাবলাম,
‘আবার? না না আর নয়’ ।
আমার জীবনে আমি আর কোন পুরুষ চাইনি। আমার কাছে তখন পুরুষ মানেই পশু। আমি আর কোন পশুর খাদ্য হতে চাইনা। তাকে সেকথা জানালাম, বিদায় নিলাম। তারপরও সে আবার ফিরে এল, কোন এক অদৃশ্য যাদুর বাঁধনে সে বেঁধে ফেলল আমায়। এরপর কিভাবে কেটে গেছে দুটি বছর বুঝিনি আমি। এ দুটি বছর তার সাথে কথা বলেছি ঘন্টার পর ঘন্টা, হেসেছি প্রাণভরে, কেঁদেছি মন খুলে। তারপর সিদ্ধান্তে এসেছি একসাথে পথচলার।
পুলিন আর আমার মধ্যে রোমান্টিকতা বলতে ছিল কেবল অনর্গল কথা আর অকৃত্রিম হাসি। মাসে এক’দুবার সে আমার ছোট্ট মফস্বল শহরে চার ঘন্টা গাড়ী চালিয়ে আসতো। দেখা হলে হঠাৎ কখনো কখনো হাত ধরা কিংবা কখনো ফেরার সময় কপালে হালকা করে ঠোঁট ছোঁয়ানো। ব্যস, এটুকুই। এর বেশী কখনো সে আমার কাছে কিছু চায়নি, কিংবা আমিও কখনো আশা করিনি। একবার সে মজা করে বলেছিল,
-আমি কিছুই চাই না বলে ভেবোনা, আমার মধ্যে কোন অনুভূতি কাজ করেনা। আমি কিন্তু নপুংশক নই।
সে জানেনা, আমার চোখে সে শুধু সুপুরুষই নয়, দেবপুরুষ। বাসর রাতে আমার দেবপুরুষ নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। ঘুমটা ওর বড্ড প্রয়োজন ছিল আজ। আমি বিছানায় এসেই তাকে ব্যথার ওষুধের সাথে একটা ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিয়েছি, সে বুঝতে পারেনি। আগের রাতের জার্নি আর সারাদিনের ধকল ছাড়াও অনেকদিন পর আমাকে হারানোর ভয়টা থেকে আজ সে বেরিয়ে এসেছে। আমাকে বিয়ে করার শাস্তি থেকে তার পরিবার তাকে রেহাই দিবেনা জেনেও আমার বিশাল দায়িত্বটা সে কাঁধে নিয়েছে। আজ সে ক্লান্ত, ভীষণ পরিশ্রান্ত। তাই সে পছন্দ করেনা জেনেও আমাদের বাসরে তাকে একটু প্রশান্তির ঘুম দিতে স্লিপিং পিলের মত সহজলভ্য জিনিসের সাহায্য নিয়েছি আমি।
-এই, তুমি পায়ের কাছে বসে আছো কেন? এসো।
হঠাৎ তার কণ্ঠ শুনে চমকে তাকালাম। আলো-আঁধারীতে দেখলাম সে দু’হাত বাড়িয়ে রয়েছে আমার দিকে। আমি আস্তে গিয়ে তার হাতের উপরে শুয়ে পড়লাম। সে আমাকে বুকে জড়িয়ে নিয়ে আবার নাক ডাকতে শুরু করল। জানিনা কেন, অজান্তেই আমার দু’চোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। পুলিন জেগে থাকার প্রাণপণ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হল। ঘুম জড়ানো কণ্ঠে একবার শুধু অনেক কষ্টে বলল,
-এই তুমি কাঁদছো কেন?আজই তো আমাদের শেষরাত নয়।
ভাবছিলাম, আজ আর আমার ঘুম হবেনা। কিন্তু আমার সব অনুমান ভুল প্রমাণ করে কখন যে প্রশান্তির ঘুমে তলিয়ে গেলাম বুঝতেও পারিনি। জীবনের অস্তিত্ব টের পেলাম খুব ভোরবেলা কপালে তার ঠোঁটের স্পর্শ পেয়ে ।
-ফাহমিদা নীলা
২২/০৪/২০১৮ইং