”আমার সাথে আজ বিকেলে নদীর পাড়ে আপনি কি একটু দেখা করতে পারবেন?” রেবেকা টেলিফোন করে ফয়সালকে কথাটা জানালো।
”না পারার কি আছে। কেনো কোন জরুরী কথা আছে নাকি? না কোন সমস্যা?”
‘তা না, একটু কথা ছিলো। দেখা হলে বলবো। তাহলে এখন রাখি কেমন?” ওই প্রান্তে ফয়সালকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে রেবেকা টেলিফোনের সংযোগটা বিচ্ছিন্ন করে দিলো। বিকেল বেলা রেবেকা একটা সাধারণ মানের সূতির শাড়ি পরে মায়ের ঘরে এসে বললো, ”আমি একটু বাইরে যাচ্ছি মা, ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ফিরে আসবো।”
”রিমি কই? তুই একাই যাচ্ছিস? ও যাবে না তোর সঙ্গে?”
”না মা, তার আর দরকার হবে না, আমি একাই যেতে পারবো।”
”কিন্তু কোথায় যাচ্ছিস, তা একবার বলবি তো?”
”আছে একটু দরকার। তোমাকে ঘুরে এসে সব বলবো।আমি তাহলে এখন আসি। তুমি বরং দরজাটা লাগিয়ে দাও।” কথাটা বলেই রেবেকা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো।
আয়েশা বেগম অবাক হয়ে মেয়ের গমন পথের দিকে চেয়ে রইলেন।
”তোর বুবু কোথায় গেলো রে? তুই কিছু বলতে পারবি?”
”রিমি একটা গল্পের বই পড়তে পড়তে ঠোঁট উল্টিয়ে ইশারা করেই বললো, ”আমি কি করে বলবো? তবে ফয়সাল ভাইয়ার সাথে দেখা করতে যায়নি, এ আমি নিশ্চিত।”
আয়েশা বেগম ভ্রুকুটি করে জিজ্ঞেস করলেন, ”তুই কেমন করে জানলি যে সে সেখানে যাবে না! কেনো তোকে কি রাবু কিছু বলেছে?”
রিমি বইটা বন্ধ করে বললো, ”আহ মা তুমি খুব বোকা, কিছুই বুঝো না! বুবু যদি ফয়সাল ভাইয়ার সাথে দেখা করতে যেতো তাহলে নিশ্চয়ই দামী একটা শাড়ি পরার পর অনেক সাজুগুজু করে যেতো! ব্যপারটা খুব সিম্পল।”
”বুঝছি গল্পের বই পড়ে পড়ে খুব ইঁচড়ে পাকা হয়েছিস না! তাই বড় বোনকে নিয়ে থিসিস করা শুরু করেছিস। মারবো একটা থাপ্পড়।” কথাটা বলেই আয়েশা বেগম চিন্তিত মুখে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
”কি ব্যপার কিছু বলছো না যে। তখন থেকেই দেখছি বালির মধ্যে কি সব দাগ কেটে চলেছো? বলবে তো কি কারনে আমাকে ডেকেছো?”রেবেকা একটু দম নিয়ে মাটির দিকে ঝাপসা চোখে তাকিয়ে বলে উঠলো, ”আপনি আমাদের বিয়েটা ভেঙ্গে দেন। আমার পক্ষে এই বিয়ে করা সম্ভব নয়।” ফয়সাল বেশ অবাক হয়ে বললো, ”তুমি কি বলছো এইসব? দুই বাড়ির কথাবার্তা থেকে শুরু বিয়ের বাজার পর্যন্ত করা হয়ে গেছে। তোমারও তা ভালোমতোই জানা আছে। তোমার মাথার ঠিক আছে তো? বাড়িতে ঝগড়া হয়েছে বুঝি? এইসময় এসব টুকটাক সব বাড়িতেই হয়ে থাকে। এ নিয়ে এতো মন খারাপের কিছু নেই। চলো যাই ফুচকা খাই গিয়ে।”
রেবেকা বেশ শান্ত ও ঠান্ডা গলায় বলে উঠলো, ”আমার মাথা ঠিকই আছে। আমি সব ভেবে চিন্তেই আপনাকে কথাটা জানালাম। দয়া করে আপনি আমার এই উপকারটুকু করুন। আমি সারাজীবন আপনার কাছে চিরকৃতজ্ঞ থাকবো।”
”কি এমন ঘটেছে যে শেষ মুহূর্তে এসে তুমি এসব কথা বলছো। আমাকে কি তোমার পছন্দ না? যদি পছন্দ না করো তবে বলো, আমি জোর করে তোমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তোমাকে বিয়ে করতে যাবো না। বিশ্বাস করো আমি সে ধরনের মানুষ না।”
”না, না, না! আপনি একথা ভাববেন না। আপনি অনেক ভালো একটা মানুষ। আপনাকে যে মেয়ে বিয়ে করবে সে অনেক সুখী হবে। আসল সমস্যাটা আমি আপনাকে বলতে পারছি না।” ”কি এমন সমস্যা যে আমাকে বলা যাবে না? আজ যদি আমি তোমাদের বাড়ির একজন হতাম তাহলে কি আমাকে জানাতে না?” রেবেকা একটু চুপ থেকে উত্তর দিলো, ”সমস্যাটা বাবাকে নিয়ে। এর বেশি আমি আর কিছু বলতে পারবো না। আমি চাই না আমাকে বিয়ে দিতে গিয়ে বাবা কোন ঝামেলায় পড়ুক। তাই আমি বিয়েটা ভেঙ্গে দিতে চাচ্ছি।”
”দেখো রেবেকা আজ তোমাকে একটা কথা বলি, ”আমাদের জন্মের আগে থেকেই সৃষ্টিকর্তা আমাদের জন্ম মৃত্যুর সাথে বিয়েটাও নির্ধারণ করে পৃথিবীতে পাঠিয়ে থাকেন। তাই এর উপর আমাদের কোন হাত নেই। তোমার সাথে আমার বিয়েটা যদি আল্লাহ লিখে রেখে থাকেন তাহলে কেউ তা খণ্ডাতে পারবে না। তাই বলছিলাম কি যদি আমাকে খুব কাছের একজন মনে করো তবে সমস্যাটা আমার সাথে শেয়ার করতে পারো। এখন চলো উঠা যাক, রিমিকে তুমি সাথে করে যেহেতু নিয়ে আসোনি তাই নিশ্চয়ই তোমাকে নিয়ে তোমার বাড়ির লোকজন চিন্তা করছে। আর চিন্তা করাটাই স্বাভাবিক। চলো তোমাকে একটা রিক্সায় তুলে দিই।” কথাটা বলেই ফয়সাল হাত দিয়ে ইশারা করে একটা খালি রিক্সা ডাক দিয়ে রেবেকাকে তাতে তুলে দিয়ে রিক্সা ভাড়াটা রিক্সাওয়ালাকে দিয়ে বিদায় করে দিলো।
ম্যানেজার দ্বীন মোহাম্মদ রশীদ সাহেবকে তার রুমে ডেকে পাঠালেন। রশীদ সাহেব রুমে এসে পৌঁছাতেই দ্বীন সাহেব বেশ গম্ভীর মুখ করে রশীদকে চেয়ারে বসতে ইশারা করলেন। রশীদ সাহেব চেয়ারে বসতেই ম্যানেজার ফাইলটা একপাশে সরিয়ে রেখে বললেন, ”দেখুন রশীদ সাহেব আপনি এই অফিসের সবচেয়ে পুরোনো কর্মচারী। অফিসের এমন কেউ নেই যে আপনার কাছে হাতে কলমে কাজ শিখেনি। এমনকি আমিও এখানে জয়েন করার পর কিছুদিন আপনার কাছে কাজ শিখেছি। তাছাড়া আমাদের মালিক আপনাকে বিশেষ স্নেহ করেন। আপনার কাজের ধরণ, অফিসের নিয়ম কানুন মেনে চলার প্রবণতা কোন কিছুতেই আপনার কমতি নেই। মালিক থেকে শুরু করে অফিসের আমরা সবাই আপনাকে অত্যান্ত বিশ্বাস করি। আপনার এতো বছরের অর্জন আজ কেনো আপনি শেষ বয়সে এসে ধূলোয় মিশিয়ে দিতে চলেছেন? আপনার কি হয়েছে বলেনতো? আপনার কোন ধরনের খারাপ নেশা নেই, কিংবা বেহিসেবী কোন খরচও আপনি কখনও করেন না। তবে আজ কি এমন হলো যে, আপনি নিজেকে এসবে জড়িয়ে ফেলেছেন? আমাকে কি সব খুলে বলা যায়? আমি এখনো কাউকে কিছুই জানায়নি।”
রশীদ সাহেব কোন কথা না বলে মাথা নিচু করে চুপ মেরে থাকলো। রশীদকে চুপ করে বসে থাকতে দেখে ম্যানেজার একটু কড়া গলায় বললো, ”চুপ করে থাকবেন না রশীদ সাহেব ; যা জিজ্ঞেস করছি তার উত্তর দেন। এতদিনের একটা সুসম্পর্কের কারনে আপনাকে শেষ একটা সুযোগ দিতে চাই। হয়তো এমন কিছু একটা ঘটেছে যে কারনে এতগুলো টাকার হিসেব আপনি দিতে পারছেন না। উত্তর দিন রশীদ সাহেব, তা নাহলে আমাকে অন্য ব্যবস্থা নিতে হবে।”
”আমি স্যার আপনার কাছে কিছুই লুকাবো না, সব কথা খুলে বলবো আপনাকে। আমাকে তো স্যার অনেকদিন সময় দিয়েছেন। শুধু আর কয়েকটা দিন সময় দিন। এরমধ্যে আমার বড় মেয়েটির বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর আপনার যা মন চায় তাই নাহয় করবেন। আপনার দেয়া যেকোন শাস্তিই আমি মাথায় পেতে নিবো। প্রয়োজনে আমার বসত বাড়িটাও বিক্রি করে দিয়ে সব টাকা পরিশোধ করবো। তবুও আমাকে আর কয়েকটা দিন সময় দেন স্যার। আর একটা কথা, এই নিন আমার ক্যাশ বক্সের চাবি আর হিসেবের লেজার বই। এতে সব হিসেব লেখা আছে। লেজারে চোখ বুলিয়ে গেলেই সব হিসেব বুঝতে পারবেন।”
”এসব কি কথা বলছেন রশীদ সাহেব? আমার নিজেরও তো বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে। এটা চাকরি, আমরা এখানে সবাই চাকরি করতে এসেছি। চাকরির ক্ষেত্রে আবেগের কোন স্থান নেই। আপনাকে আমি তিন দিন সময় দিচ্ছি। এই তিনদিনের মধ্যে আপনি কিভাবে আপনার হিসেব মিলাবেন সেটা আপনার ব্যপার। এই তিনদিনের মধ্যে আপনি যদি পাই টু পাই আমাকে হিসেব বুঝিয়ে দিতে না পারেন তবে আমি আপনাকে পুলিশে হ্যান্ড ওভার করতে বাধ্য থাকবো। এখন আপনি যান, গিয়ে কি করবেন সেটা বসে বসে চিন্তা করেন। আর আরেকটা কথা আপনাকে আমি পরিষ্কার করে বলে দিচ্ছি, যদি সব হিসেব পত্র ঠিক মতো মিলিয়ে দেন তবুও আপনাকে এখানে আর এক মুহূর্তও রাখা হবে না। কারণ বিশ্বাসভঙ্গ লোককে কেউ কখনও চাকরিতে রাখে না। এখন আপনি যান আমার চোখের সামনে থেকে।”
রশীদ সাহেব মাথা নিচু করে ধীরে ধীরে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো।
(আগামী পর্বে সমাপ্ত)
-ফিরোজ চৌধুরী