গোধূলিবেলায় (অষ্টম পর্ব)

আজ বিকেলে রেবেকাকে ছেলে পক্ষের দেখতে আসার কথা। তাই সকাল থেকেই রশীদ সাহেবের বাড়িটা বেশ সরগরম। আয়েশা বেগম সকাল থেকেই রেবেকাকে চুলার আশপাশে যেতে দিচ্ছেন না। তিনি রান্না করার পাশাপাশি রিমি ও খোকাকে দিয়ে গোটা বাড়িটার ঝুল , ধুলো বালি ময়লা সব সাফ করতে বসেছেন। রেবেকা সংসারের কোন একটা কাজ করতে গেলেই তিনি ছুটে এসে সে কাজটা নিজেই করতে শুরু করে দিচ্ছেন। এসব কিছু দেখে রেবেকা অস্বস্তিতে আরও জড়োসড়ো হয়ে যেতে লাগলো। একটু পর রমজান এসে রশীদ সাহেবকে নিয়ে বাড়ির বাইরে বের হয়ে গেলো। ঘন্টাখানেক পর রশীদ সাহেব দুই হাত ভর্তি বাজার করে বাড়িতে প্রবেশ করতেই রিমি ও খোকা দৌঁড়ে এসে বাবার হাত থেকে বাজারের ব্যাগটা নিয়ে রিমি মায়ের উদ্দেশ্যে জোরে ডেকে উঠে বললো, ” মা দেখে যাও বাবা কত্ত কি বাজার করে নিয়ে এসেছে! মা … ও মা …. ! ”

রিমির চিৎকার শুনে আয়েশা বেগম রান্নাঘর থেকে দ্রুত বেরিয়ে এসে দেখতে পেলেন রিমি ও খোকা বাজার ভর্তি একটা বড় ব্যাগ নিয়ে খুশির আতিশয্যে লাফালাফি করছে। আয়েশা বেগম বাজারের ব্যাগটা হাতে নিয়ে আঙ্গিনায় উপুর করতেই বড় আকারের একটা তাজা রুইমাছ , মাংস সহ অন্যান্য বাজার সদাই দেখতে পেলেন। রশীদ সাহেব স্ত্রীর কাছে এগিয়ে এসে মিষ্টির প্যাকেট সহ ফলমূল ও শুকনো খাবার দাবারের আরও একটি ব্যাগ এগিয়ে দিতেই আয়েশা বেগম স্বামীর দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইতেই রশীদ সাহেব বেশ বিরক্ত মুখে স্ত্রীকে বললেন, ” ওমন হা করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে কি দেখছো? ”

আয়েশা বেগম বেশ গম্ভীর গলায় জিজ্ঞাসা করে উঠলেন, ” তুমি টাকা পেলে কোথায়? এতসব দামী খাবার দাবার কিনতে তো অনেক টাকা লাগে! কোত্থেকে তুমি এতোগুলো টাকা পেলে? ”

” আহ ! সকাল সকাল কি সব অদ্ভুত প্রশ্ন করা শুরু করলে? চুরি করে তো আনিনি, এইটুকু নিশ্চিত থাকো। নাও এখন ব্যাগটা ধরো। রেবু মাকে দেখতে লোকজন আসবে। তাদেরকে একটু ভালমন্দ না খাইয়ে কি ছাড়া যায়? তুমিই বলো! আর রেবু মাকে যে দেখছি না! কোথায় গেলো মেয়েটা? ”

” তোমার মেয়েকে ঘরে চুপ করে শুয়ে থাকতে বলেছি। আজকে তাকে আমি কিছুতেই চুলার কাছে যেতে দিবো না। আজ সারাদিন শুয়ে বসে থাকলে মেয়েটা আমার একটুখানি রেস্ট পাবে, এতে চেহারাটাও একটু ভালো দেখাবে। ”” ঠিক করেছো! আর শোনো, রমজানকে দুপুরের আগেই তার পরিবার পরিজন নিয়ে এখানে চলে আসতে বলেছি। আজকে তারা দুপুরে আমাদের সাথেই নাহয় চারটি ডালভাত খাবে, আর বিকেলে ওর বৌ মেয়েটাকে একটু সাজিয়ে গুছিয়ে দিবে! তুমি কি বলো রেবেকার মা? ” ‘ ভালোই করেছো। আমিও মনে মনে তাই চাচ্ছিলাম। তুমি বরং ঘরে গিয়ে একটু আরাম করো। আমি যাই রান্নাটা শুরু করি গিয়ে। ”
কথাটা বলেই আয়েশা বেগম বাজারের থলেটা হাতে নিয়ে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলো।

বিকেলের পর পরই ছেলে পক্ষের লোকজন রশীদ সাহেবের বাড়িতে এসে উপস্থিত হলো। রশীদ সাহেব ও রমজান দ্রুত এগিয়ে এসে তাদের সাদরে গ্রহণ করে ঘরের মধ্যে নিয়ে গিয়ে বসালেন। একটু পর রিমি ও খোকা দুজনে মিলে শরবতের জগ ও কয়েকটা গ্লাস নিয়ে এসে মেহমানদের শরবত বিতরণ করতে শুরু করলো। উভয়েরই কুশল বিনিময়ের পর কি এক জরুরী কথা মনে হয়ে যাওয়ায় রশীদ সাহেব মেহমানদের বসিয়ে রেখে নিজের ঘরে এসে ঢুকতেই রেবেকাকে তার মায়ের শাড়ি পরা অবস্থায় দেখতে পেয়ে সব কাজ ভুলে একরাশ মুগ্ধতা নিয়ে অপলক দৃষ্টিতে রেবেকার দিকে একমনে তাকিয়ে রইলেন। রেবেকা কাছে এগিয়ে এসে বাবাকে কদমবুচি করতেই রশীদ সাহেবের চোখদুটো গভীর আবেশে বন্ধ হয়ে আসলো। ক্ষণকাল পর তিনি ঝাপসা চোখ মেলে মেয়েকে কাছে টেনে বুকে জড়িয়ে ধরে নীরবে কেঁদে উঠলেন। একটু পর কিছুটা স্বাভাবিক হতেই তিনি মেয়ের মাথায় স্নেহের হাত বুলাতে বুলাতে বললেন, ” দোয়া করি, সুখী হোস মা! তোর মায়ের এই শাড়িটা তোকে খুব মানিয়েছে। অনেকদিন বাদে শাড়িটা কাউকে পড়তে দেখলাম। এটা আমার খুব পছন্দের একটা শাড়ি। বিয়ের পর অনেক শখ করে তোর মাকে এই শাড়িটা কিনে দিয়েছিলাম। জানতাম না, তোর মা এতো যত্ন করে শাড়িটা এতদিন ধরে তুলে রেখেছে। ”

সন্ধ্যের পর মেহমানদের খাওয়া দাওয়ার পর উভয়পক্ষ মিলে বিয়ের দেনা পাওনা নিয়ে আলোচনায় বসলেন। ফয়সালের বাবা রহমত সাহেব এক খিলি পান মুখে দিয়ে রশীদ সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন, ” বুঝলেন রশীদ সাহেব, মেয়েতো আমাদের পছন্দ হয়েছে। আমাদের অবশ্য যৌতুক টৌতুক কিছুই চাই না। তবে এক খান কথা, মেয়েকে কিন্তু গয়না গাটি দিয়ে সাজায় দিতে হবে। এই যেমন ধরেন কানের এক জোড়া ঝুমকা, গলার মালা, এক জোড়া হাতের বালা এই আর কি। ”

রহমত সাহেব থামতেই ফয়সালের মা সঙ্গে সঙ্গে বলে উঠলেন, ” ভাইজান, হাতের বালা কিন্তু দুই ভরির নিচে হয় না। কানের এক জোড়া ঝুমকা, একেকটা আট আনা করে। এর নিচে করলে আবার দুইদিন ব্যবহার না করতেই ভেঙ্গে যাবে। আর রইলো গলার এক ভরি মালা। ছেলের জন্য একটা গলার চেইন হলেই চলবে। ছেলের বিয়ে দিবো বলে ওর আব্বা আলাদা করে নতুন একটা ঘর বানিয়েছে। অবশ্য নতুন আসবাবপত্র কিছুই তৈরী করা হয়নি। তাই বলছিলাম কি মেয়ে ও জামাইয়ের জন্য একটা খাট ও একটা ড্রেসিং টেবিল দিলেই চলবে। ”

ফয়সাল এতোক্ষণ চুপচাপ বসে ছিলো। তার মায়ের কথাগুলো শুনতে শুনতে লজ্জায় তার কান দুটো গরম হয়ে উঠতে লাগলো। তাই তার মায়ের শেষের দিকের কথাগুলো কানে যেতেই মৃদু প্রতিবাদ করে উঠতেই মিসেস রহমত ছেলেকে সবার সামনেই একটা ধমক দিয়ে উঠে বললেন, ” দেখো বাবা তোমার পছন্দের উপর আমরা কোন কথা বলিনি। আর আমরা কি কোন যৌতুক চেয়েছি ? কি বলেন ভাইজান? ” শেষের কথাগুলো তিনি রশীদ সাহেবের দিকে তাকিয়ে বললেন।

রশীদ সাহেব মনে মনে প্রমাদ গুণলেন। সামনে দরজার চৌকাঠে দাঁড়ানো আয়েশা বেগমের দিকে এক নজর চাইতেই আয়েশা বেগম চোখ ইশারায় না করলো। রশীদ সাহেব স্ত্রীর দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে পাশে বসা রমজানের দিকে তাকাতেই রমজান তাকে অভয় দিয়ে ছেলে পক্ষকে উদ্দেশ্য করে বললো,
” চাচা, আপ্নেরে তো আগেই সবকিছুই খুলে বলছি, কিছুই গোপন করি নাই। এতোগুলান সোনার গয়না গাটি ও খাট পালঙ্ক ওনাগো পক্ষে দেয়া সম্ভব না। এছাড়াও বিয়ের বাজার ও লোকজনকে খাওন দাওন বাবদ অনেক টাকার হ্যাপা আছে বুঝলেন মুরুব্বী। ছেলেরে কি হাটে তুলছেন বেচোনের লাইগা! কি কন এইসব! ”

ফয়সালের বোন সালমা মধ্য থেকে বলে উঠলো,
” আমরাতো যৌতুকের কোন আলাপই করিনি। মেয়ের যা গয়নাপত্র তাতো মেয়েরই থাকবে। ”

রমজান সালমার দিকে তাকিয়ে বেশ ঠান্ডা গলায় বলে উঠলো, ” তুমি থামো বইন, বড়গো কথার মধ্যে কথা কইতে আইসো না। ”
এরপর রমজান বেশ দৃঢ়চিত্তে ফয়সালের মা বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললো, ” আপনেরা এইসব ডিম্যণ্ড টিম্যণ্ড বাদ দিয়া যতটুকু না হলেই নয় তাই নিয়া আলোচনা করেন। যেটা এনারা দিতে পারবো না তাই নিয়া বেকার প্যাচাল পাইরা লাভ নাই চাচা। ”
রমজান মিয়ার সোজাসাপ্টা কথা শুনতে শুনতে রশীদ সাহেব মনে মনে বেশ ঘাবড়ে গেলেন। তার মনে হলো রমজানের কথা শুনে ছেলে পক্ষ আবার উঠে না যায়। অবশেষে ফয়সালের বড় চাচা ও রহমত সাহেবের বন্ধু আজমল সাহেবের মধ্যস্থতায় ঠিক হলো, মেয়ে জামাইয়ের থাকার জন্য একটা খাট ও ড্রেসিং টেবিল আর মেয়ের এক জোড়া কানের ঝুমকা ও ছেলের জন্য একটা আট আনা স্বর্ণের চেইন রশীদ সাহেবকে দিতে হবে। পরিশেষে অনেক জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ফয়সালের সাথে রেবেকা এনগেজমেন্ট বেশ ভালভাবেই সম্পন্ন হয়ে গেলো। এছাড়াও বিয়ের জন্য সামনের মাসের মাঝামাঝি সময়ে একটা সম্ভাব্য তারিখ নির্ধারণ করে ছেলে পক্ষ রশীদ সাহেবের সাথে কোলাকুলি করে রওনা দিলো।

রাতে ঘুমাতে যাওয়ার সময় এই প্রথম আয়েশা বেগম মুখ খুললেন। আজ সন্ধ্যা থেকে তিনি একটা কথাও না বলে নীরবে উভয়পক্ষের কথাবার্তা শুনে যাচ্ছিলেন। এতক্ষণ পর স্বামীকে একান্তে কাছে পেয়ে বেশ চিন্তিত মুখে প্রশ্ন করলেন, ” এই এক মাসের মধ্যে এতো সবকিছু জোগাড় করবে কিভাবে শুনি? আর এতগুলো টাকা-ই বা তুমি পাবে কোথায়? সব কিছুতেই তো হ্যাঁ বলে দিলে! এখন উপায়? ”

রশীদ সাহেব কিছু না বলে চিন্তিত মুখে পান চিবুতে চিবুতে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো, ” কিছু তো একটা করতেই হবে রেবুর মা! মেয়েকে তো সারাজীবন আই বুড়ো বানিয়ে ঘরে বসিয়ে রাখলে চলবে না। দেখি কি করা যায়! অফিস থেকে লোনের একটা ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া আর উপায় কি বলো! ”
কথাটা বলেই রশীদ সাহেব বালিশের উপর মাথাটা রেখে চোখ বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে পড়লেন।

(চলবে)

-ফিরোজ চৌধুরী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *