ক্ষরণ ( ২য় পর্ব )

৩.
হাসপাতালের এই ঘর টা অনেক ঠাণ্ডা, নীরব। পুরানো একটা বেঞ্চের একপাশে অদ্ভুত ঘোর নিয়ে বসে আছে রুমী। কিছুক্ষণ আগে যা ঘটে গেছে, তার অনুভূতি থেকে বের হতে পারছেনা এখনো। সেদিন রাতে যা ঘটেছিল তেমনি আরেক বিভৎস পুনরাবৃত্তি প্রায়। দুজন মাঝবয়সী আয়া টাইপের মহিলা নোংরা একটা ঘরে নিয়ে গেল তাকে। চারিদিকে তুলা আর ওষুধের খালি বাক্স পড়ে আছে। স্যাঁতস্যাঁতে ঘরটায় কেমন ভ্যাপসা গন্ধ। একজন আচমকা তার গা থেকে কাপড় গুলো খুলে নিল। আপত্তি করার বোধ টুকু তৈরী হবার আগেই সে নিজেকে আবিষ্কার করল বিবস্ত্র ভাবে। লোহার একটা খাটে তাকে শুইয়ে চাদর দিয়ে ঢেকে দেয়া হল। এরপর সাদা এপ্রোন পড়া একজন ভদ্রলোক এলেন। গ্লোভস পড়লেন হাতে। চাদর তুলে আবার উন্মুক্ত করতে লাগলেন তার প্রয়োজন মত। স্পর্শকাতর জায়গা গুলোতে হাত লাগা মাত্রই সংকুচিত হতে লাগল সে। দুই উরুসন্ধিস্থলের সবচেয়ে স্পর্শকাতর জায়গাটা এমনিই ক্ষতবিক্ষত, সেখানে হঠাৎই তীব্র যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠল সে। বয়স্ক মহিলাটা তার কাঁধ চেপে ধরে ধমক দিলেন — আরে! ফিংগার টেস্ট করতেছে, সহ্য করন লাগব ! কি লজ্জা! কি লজ্জা ! তার এই মরমে মরে যাওয়ার অনুভূতিটুকু একটুও স্পর্শ করল না অপরিচিত এই মানুষ গুলোকে। বেশ কিছুক্ষণ পরে তাকে ফেলে এরা চলে গেল। মৃত মানুষের মত সে পরে রইল কতক্ষণ। শরীর মন অসাড়, নড়তে পারছিল না। তারপর ধীরে ধীরে উঠে বসল, যন্ত্রের মত পড়ে নিল কাপড় গুলো। অবশ পায়ে বেরিয়ে এল অসহ্য ঘরটা থেকে। “আপনি আসুন।” কথাটায় সম্বিৎ ফিরে পেল। পুলিশের একজন মহিলা কনস্টেবল দরজায় দাঁড়িয়ে। উঠে দাঁড়াল রুমী। হাঁটতে হাঁটতে দূরে বাবাকে দেখতে পেল। মানুষটা কেমন দুদিনেই দুশ্চিন্তার ভারে কুঁজো হয়ে গেছে। এত্ত মায়া লাগল ! সে কি দায়ী এই অবস্থার জন্য ? থেমে যাবে ? থানার অফিসারই কি ঠিক ? শেষপর্যন্ত কিছুই হবেনা ! বরং এই সমাজে সে নিক্ষিপ্ত হবে আরও গহীন অন্ধকারে ? টলতে লাগল রুমী। ক্রমশ ঝাপসা হতে লাগল বাবার মুখ টা। পড়ে যাবার আগমূহুর্তে টের পেল কেউ শক্ত হাতে ধরে ফেলেছে তাকে।

অনেক্ষণ ধরে বসে আছেন রাশেদুল হক। ভেতর থেকে ডাক পড়ছেনা। তার জানা মতে নিউজ টা এখনো পাব্লিক হয়নি। শক্তপোক্ত ভাবে নিউজ টা সাজাতে হবে। যেন দেখা মাত্রই মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়ে। সেলিব্রেটি আর রাজনীতিবিদদের লাইফ নিয়ে সাধারণ পাব্লিকের সাংঘাতিক কৌতুহল থাকে। তারপর আবার রেপ কেস! মাথার মধ্যে সাজিয়ে ফেলেছেন পুরোটা। শুধু ভিকটিমের সাথে কথা বলা বাকী। ডাক পড়ল অবশেষে। মরা মানুষের মত ফ্যাকাসে চেহারার একটা নার্স এসে ডেকে নিয়ে গেল। ভিকটিম চোখ খুলেছে। আসতে আসতে নার্স বলছিল, মেয়েটা নাকি ফরেনসিক টেস্টের পর অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। তারা চেক-আপ করে প্রাথমিক ভাবে ধারনা করছে– মেয়েটা গত দুদিনে তেমন কিছুই খায়নি। শরীর খুবই দুর্বল। স্যালাইন দেয়া হয়েছে। কথা বলতে হবে খুবই আন্তরিক ভাবে। এই মূহুর্তে তার শরীর মন দুটোই দুর্বল। চেহারায় একটা সহানুভূতির ভাব রাখার চেষ্টা করলেন। এতে ভিকটিম প্রভাবিত হয়, আপন ভাবতে শুরু করে। গড়গড় করে স্টেটমেন্ট দেয়। সে সামান্য ঝুঁকে হেসে জিজ্ঞেস করল — “ভাল আছেন রুমী ? ” মানুষের চোখের আলাদা ভাষা আছে। রাশেদুল বুঝতে পারল তার পদ্ধতি কাজ করছে। মেয়েটা কথা না বললেও চোখে আকুতি আছে। নিজেকে গুছিয়ে নিলেন রাশেদুল “আমি সংবাদ মাধ্যমের লোক। আপনাকে সাহায্য করতে চাই। ঘটনাটার ব্যাপক প্রচার না হলে আসামীদের গা বাঁচাতে সুবিধা হবে। ক্ষমতার বলে বেঁচে যাবে। আপনি আমাকে সব খুলে বললে বিষয়টা সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে পারব। তবে আজ নয়। আজ আপনি অসুস্থ। ডাক্তার বোধহয় ঘুমের ওষুধ দিয়েছে। আপনার যখন বলতে ইচ্ছে করবে, আমাকে ফোন করবেন। পকেট থেকে কার্ড বের করে বালিশের কাছে রাখলেন তিনি। এটাও একটা কৌশল। ভিকটিমকে আশ্বস্ত করা, তাকে বিশ্বাস করানো যে আমি আপনার উপকার করতে এসেছি। নিজের ফায়দার জন্য নয়। উঠে দাঁড়ালেন তিনি। হাসপাতাল থেকে বের হয়ে সোজা বাস ধরলেন। তার অভিজ্ঞতা বলে মেয়েটা কাল সকালের মধ্যেই যোগাযোগ করবে। একটু ঝুঁকি নিলেন অবশ্য। এর মধ্যে অন্য কোন গণমাধ্যম চলে এলে সমস্যা। কিছু করার নেই, এক্ষেত্রে তাড়াহুড়ো করা যাবেনা। আস্থার ঘাটতি হলেই ভিকটিম মুখ বন্ধ করে ফেলবে, বিস্তারিত জানা যাবেনা। আকর্ষণীয় একটা নিউজ তৈরী করতে হবে। সেক্ষেত্রে খুঁটিনাটি সব জানা দরকার। এই অসময়েও বাসে জানালার ধারে চমৎকার একটা সীট পাওয়া গেল।

৪.

আধা ঘন্টা পার হয়ে গেছে কনস্টেবল হিরাকে পাঠানো হয়েছে চা আর শিঙাড়া আনতে। রামুর দোকানের শিঙাড়ার তুলনা হয়না। সাথে সর তোলা কড়া মিষ্টি মালাই চা। আহা! স্বর্গীয় স্বাদ। হিরাকে মনেমনে কুৎসিত একটা গালি দিল। নির্ঘাত আড্ডায় বসে গেছে, শালা ! সরকারী খামটা হাতে নিল সে। মেয়েটার ফরেনসিক টেস্টে কিছুই আসেনি। দুদিন পার হয়ে যাবার পর টেস্ট করানো হয়েছে, কিছু আসবেনা এটাই স্বাভাবিক। গায়ে যথেষ্ট আঘাত আর ক্ষতের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বিশেষ করে দাঁতের কতগুলো গভীর ক্ষত আছে। চোখ বন্ধ করল খোরশেদ। মাইগ্রেনের ব্যাথা টা খুব যন্ত্রণা দেয় আজকাল। হঠাৎ তীব্র ব্যথা শুরু হল। অসহ্য যন্ত্রনায় উঠে দাঁড়াল সে, ব্যথার সাথে বমি বমি একটা ভাব হয়। হেঁটে কোনরকম পৌঁছল বেসিনটার কাছে। প্রচণ্ড শব্দে বমি করল । আহ! কি শান্তি! ব্যথাও কমে গেছে অনেক টা। ডাক্তার দেখানো দরকার। আসামী ধরতে গিয়ে এই ব্যথা উঠলে সর্বনাশ! সে ব্যথায় চিৎ হয়ে পড়ে থাকবে, আর আসামী মহা আনন্দে তাকে কিক্ করে পালাবে। চা শিঙাড়া এসে গেছে। সে আরাম করে বসে শিঙাড়া ভেঙে মুখে দিল। হারামি টার হাতে জাদু আছে, মুখে দেয়া মাত্র শিঙাড়া গলে যায় মোমের মত।

আজকের খবরের কাগজ হাতে নিল। বেশ সাজিয়ে গুছিয়ে নিউজ তৈরী করা হয়েছে। এম পির ছেলের শেরোয়ানী পড়া হাসি মুখের একটা ছবি ছাপা হয়েছে। সামনে একটা কেক। সম্ভবত এটা তার জন্মদিনের ছবি। ইনসেটে আবার এম পির ছবি। মেয়েটার কোন ছবি দেয় নেই। রিপোর্টার আনাড়ি। এসব কেসে ভিকটিমের চেহারা দেখার জন্য পাব্লিকের মুখ দিয়ে লালা পড়ে। মূল রসালো জিনিস বাদ দিয়ে গেছে। গাধার গাধা। মেয়ের পারিবারিক অবস্থা ভালো না। বেইজ্জতি হলেও প্রতিবাদ করার কেউ নেই। মেয়ের ছবি দিলে পেপারের কাটতি ভাল যেতো। দুনিয়া ভরা খালি বেকুবের দল।

মাগরিবের আজান পড়ছে। আজানের সুরে একধরনের অপার্থিব ব্যাপার আছে। সম্মোহিত করে। জানালায় দাঁড়িয়ে রুমি, ঘোর লাগা চোখে দেখছে আলোকিত আকাশ একটু একটু করে কিভাবে ঢেকে যায় অন্ধকারে। এই ঘরে বাস করা দুজন মানুষের মধ্যে দুরাতেই নেমে এসেছে এক অদৃশ্য প্রাচীর। চাইলেও সে বাবার কাছে যেতে পারছেনা। বাবাও আসেন না। সারাদিন বসার ঘরে বসে থাকেন চুপচাপ। এ দুদিন স্কুলে যান নি। নামাজ পড়তে মসজিদেও যান না। ইতোমধ্যে জানাজানি হয়ে গেছে পুরো এলাকায়। সবাই এড়িয়ে চলছে তাদের, বুঝতে পারে সে। প্রতিদিন দুধ দিতে যে লোক টা আসত , সেও আসেনা গতকাল থেকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলল রুমী। দীর্ঘদিনের চেনা পরিবেশ টা কেমন অচেনা হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। বুকের মধ্যে প্রচণ্ড চাপ অনুভব করল। দরজায় কড়া নাড়ার শব্দে চমকে উঠল সে। পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে যাকে দেখতে পেল, সে এলাকার পরিচিত মুখ। অজানা আশংকা জাগল মনে।

“সালাম চাচা! শরীর ভাল আপনার? স্কুলে গেলাম দুপুরে শুনলাম দুদিন ধরে যান না। তাই খোঁজ নিতে আসলাম। চাচী নাই বাড়ীতে ? “

রহমান সাহেব দরজা থেকে সরে দাঁড়ালেন। বেশ কিছুক্ষণ কেটে গেল চুপচাপ। এলাকার সুযোগ্য কমিশনার যে তার খোঁজখবর নিতে আসেনি এটা নিশ্চিত। সে অপেক্ষা করতে লাগল মূল বিষয়ের জন্য। নিরবতা ভাঙল একসময়।

“চাচা আপনারা কি শুরু করছেন এগুলো? দেখেন, এলাকার মুরব্বী আপনি, তার উপর শিক্ষক। সবাই সম্মান করে আপনারে। এলাকায় ছিঃ ছিঃ পড়ে গেছে। আমরা তো ছিলাম ! আপনি কাউরে কিছু না বলে মেয়েটারে নিয়া থানায় চলে গেলেন। মিডিয়ায় খবর দিলেন। দেশের পাব্লিকেরে জানাইলেন যে আপনার মেয়ে ইজ্জৎ হারাইছে। লাভ কি হইল ? দেশের মানুষ আপনেরে খাওয়াইবো ? এম পি সাহেবের বিপক্ষে দাঁড়াইয়া আপনি টিকতে পারবেন এলাকায়? আপনার মেয়ের না হয় বয়স কম, তাই হুড়ে নাচতেছে। তার হিরোইন হইবার শখ হইছে !” শেষের কথা গুলোয় তীব্র ঝাঁঝ ছিল।

মাথা তুললেন আবদুর রহমান — “তুমি কি করতে বলতেছ? যার ছেলে এমন ঘটনা ঘটাইছে, তারে গিয়া বলব – বিচার করেন? “

“আপনার তেজ বড় বেশী চাচা। এলাকায় এম পি সাহেবের প্রায় ২০০ পোলাপান আছে। চাইলে তিনি বহুত কিছু করতে পারেন। কিন্তু তিনি ভাল মানুষ। কিছুই করেন নাই। আমারে ডেকে বলছেন বিষয়টা দেখতে। আপনি যেভাবে বলবেন সেভাবেই সমাধান হবে। শুধু শর্ত একটা, থানায় গিয়া অভিযোগ তুলে নিবেন। মিডিয়া ফিডিয়া ম্যানেজ করার দায়িত্ব এম পি সাহেবের উপরে ছেড়ে দেন। তার হাত অনেক লম্বা মাশাল্লাহ্।

আবদুর রহমান দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এমন কিছু ঘটবে, তার জন্য যে তিনি প্রস্তুত ছিলেন না, তা নয়। তারপর ও প্রচণ্ড বিক্ষিপ্ত হল মন। উঠে দাঁড়ালেন তিনি — “তোমরা এখন যাও। নামাজের সময় হইছে, নামাজে দাঁড়াব। “

“আচ্ছা পড়েন। কাল মেয়েটারে নিয়া সকাল ১০ টায় থানায় চলে আসবেন দয়া করে। এম পি স্যার থাকবেন। আমরা ও থাকব চাচা। এলাকার মেয়ে, তার প্রতি একটা দায়িত্ব আছে না ! জোয়ান ছেলে জোশে আইসা একটা ভুল করছে। অবশ্যই অন্যায় এইটা। তারপরও ঘরের জিনিস বাইরে যাবে ক্যান! উঠি। বুদ্ধি খাটান চাচা। মেয়ে মানুষের বুদ্ধি নিয়া চলছেন কি, জীবন ধ্বংস!”

প্রতিটা মূহুর্তে মনে হচ্ছিল, এই বুঝি বাবা এসে বলবেন — “অনেক হইছে খুকী, কাল সকালে আমার সাথে থানায় যাবা, কেস তুলে নিবা।” কিন্তু বাবা এলেন না। বাবার ঘরের বাতি নিভল একসময়। বিছানায় শুয়ে তাকিয়ে রইল সিলিং এর দিকে। বাম পাজরের তীব্র ব্যাথায় চাপাস্বরে আর্তনাদ করল সে। খুব জোরে ঘুষি মেরেছিল জানোয়ার গুলো। হাঁটুতেও অনেক ব্যাথা। শক্ত বুট জুতো দিয়ে চেপে ধরেছিল পা গুলো। বুকের মাংসপিণ্ড গুলো কামড়ে আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত করেছে। কি যে বিভৎস যন্ত্রনা হয়েছিল তার ! দম বন্ধ হয়ে আসছে। উঠে বসল সে। ওষুধ খাওয়া হয়নি। পানির গ্লাসটা রেখে চোখ বন্ধ করল রুমী। ওষুধে এই ব্যথা, ক্ষত কমে যাবে হয়ত, কিন্তু মনের ক্ষত ! কেমন করে ভুলে যাবে! চোখ বন্ধ করলেই জীবন্ত হয়ে ওঠে সব। তীব্র যন্ত্রণা শুরু হয় শরীর – মন জুড়ে। সহ্য করতে পারেনা। বুকের ঠিক মাঝখানটায় হাত রাখল সে। কত স্বপ্ন ছিল এখানটায় ! কারও ভালবাসার গভীর স্পর্শ, সাজানো গোছানো ছোট্ট একটা সংসার, মান অভিমানে সেখানে বসবাস ! আহ ! মেঝেতে বসে পড়ল। কেঁদে উঠল ফুঁপিয়ে। বুকটার মধ্যে কেন এত কষ্ট হয়! আর্তনাদ করল সে — “মাগো! আমার মা! একটাবার বুকের মধ্যে শক্ত করে জড়িয়ে ধর আমারে ! খুব কষ্ট মা ! খুব কষ্ট !………

-নাঈমা পারভীন অনামিকা

                                       চলবে.........

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *