ওজন

বাড়ীর পেছনদিকেই পারিবারিক গোরস্থান। একটু এগুতেই চোখে পড়ে মরা ডোবাটা।বাঁশ ঝাড় পেরিয়ে সামনে খুদের ভিটা। পাতার মচমচ আওয়াজে চমকে ওঠে শাহীন। এদিকটায় কেউ খুব একটা আসে না। আগে এখানেই ছিল হেঁসেলঘর। হেঁসেলে মার ব্যস্ততা ছিল সারাদিন। তখন এখানে পুকুর ছিল। বাড়ীর মেয়েরা গাঙে যেতে পারতো না। এই পুকুরেই গোসল হতো। বিশাল তেঁতুল গাছটা নিয়ে কতরকমের গল্পই না আছে। ছোটবেলায় তেঁতুল গাছের নীচে এলে গা ছমছম করতো। গোরস্থানের প্রাচীর ঝুরঝুরে হয়ে গেছে। এইখানে শাহীনের পূর্বপুরুষ ঘুমিয়ে। মা মারা যাবার পর এখানেই শাহীনের যাবতীয় আকর্ষণ। মা মারা যাবার ঘটনাটা শাহীনকে তাড়া করে রোজ।

সেইরাতে খুব বৃষ্টি ছিল। উঠোনে পানি জমে আছে। টিনের চালে বৃষ্টির ছন্দ। খুব বাতাস বইছে।গাছগুলো দুলে দুলে সারা শরীরে জল আঁকছে। ঘুটঘুটে আঁধারে টিমটিমে হেরিকেন জ্বলে ঘরে। বাতাসে নিভে যেতে চায় আলো। মা অনেক চেষ্টা করে হেরিকেন জ্বালিয়ে রাখতে।
সন্ধ্যা থেকেই শাহীনের পেটে ব্যথা আর বমি। একটুও ঘুমোতে পারে না। বাবা ঘরে ফেরেনি এখনো। এটা নতুন কোনো ঘটনা নয়। বাবা এমন রাত করেই ফেরে। মেজাজী বাবাকে মা ভয় পায়। কোনো প্রশ্ন করার সাহস নেই। শাহীনও বাবাকে খুব ভয় পায়।
আচ্ছা বাবা মানেই কি জুজুর ভয়?
বৃষ্টি বাড়ছে। আকাশে মুহূর্মুহু বিজলী চমকায়। চিকন রেখায় বিদ্যুৎ চমকায়,আলোয় সাজে আকাশ। মাকে হেরিকেনের আলোতে অদ্ভুত সুন্দর লাগছে। বাবার ভাত নিয়ে মার অপেক্ষা… শাহীনের নিত্য দেখা দৃশ্য। মা ঘুমে ঢুলে ঢুলে পড়ছে। শাহীনের পেটে অসহ্য ব্যথা শুরু হয়। পায়খানাটায় উঠোন পেরিয়ে যেতে হবে। ঘরটা বেশ দূরে। সন্ধ্যারাতে জমিলা ফুফু এসে স্যালাইন বানিয়ে দিয়ে গেছে। জমিলা ফুফু বাবার দূরসম্পর্কের বোন। স্বামী মারা যাবার পর এখানেই থাকে। নিঃসন্তান জমিলা ফুফু শাহীনকে খুব আদর করে। একান্নবর্তী পরিবারে জমিলা ফুফু মানিয়েই থাকে। শাহীনের বড় চাচা, ছোট চাচা আর তাঁদের পরিবার… সবাই মিলেমিশে দিন কাটায়।
…. মা,মা, পেটে ব্যথা। পায়খানায় যাবো।
তন্দ্রাঘোরে মা গা ঝাড়া দিয়ে ওঠে। ….চল বাবা। ছাতিটা নিয়ে নেই। ছাতি আর হেরিকেন নিয়ে মাথায় ঘোমটা টেনে মা শাহীনকে নিয়ে হাঁটে। বৃষ্টির ছাঁট লাগছে। তেঁতুল গাছটাকে কেমন ভয় ভয় লাগে। নারিকেল গাছগুলো বাতাসে বেঁকে বেঁকে যাচ্ছে। শাহীনকে ভেতরে ঢুকিয়ে মা বাইরে দাঁড়িয়ে। মাটির চাঁড়ি আর বাঁশের ঘের দেওয়া পায়খানা।

খুট করে জমিলা ফুফুর ঘরের দরজা খোলার আওয়াজ। ততক্ষণে শাহীন চলে এসেছে মার কাছে।… তোর জমিলা ফুফু উঠলো বুঝি! মা হেসে বলে। জমিলা ফুফুর দরজায় অন্ধকারে একজন মানুষের ছায়া। মানুষটা ছাতা নিয়ে শাহীনদের ঘরের দিকে হাঁটতে থাকে।
..… বাবা! বোকার মত শাহীন ডেকে ওঠে। মা শাহীনের মুখ চেপে ধরে। সেইরাতে প্রথমবারের মত মা কথা বলেছিল বাবার মুখে। মা সেই রাতে হয়েছিল সাহসী এক রমণী। … ছেলে বড় হচ্ছে, আপনি এখনো এসবই করবেন? আজ তো ছেলেও দেখলো! আপনার কোনো লজ্জা নাই। পারলে বিয়ে করেন, তবুও নষ্টামি বন্ধ করেন। বাবার গনগনে চোখে তখন আগুনের ধোঁয়া। তেজোবান মানুষের মধ্যে একটা ক্ষিপ্ত বাসনা। তেড়ে আসে বাবা….শাহীন ভয়ে কুঁকড়ে যায়। পাগলের মত মারতে থাকে মাকে। … তুই আমাকে এত বড় কথা বললি? আজ তোর একদিন কি আমার…
মাটিতে পড়ে যায় মা। তারপর শুরু হয় খিঁচুনি। সকাল হতে হতে শান্ত হয়ে যায় মা।

বৃষ্টির পানিতে কবর দিতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিল। মাকে গোরস্থানে রেখে এসে বাবা আর শাহীনের মুখোমুখি হয়নি সেদিন। জমিলা ফুফুও কোথায় চলে গেলো? আর খুঁজে কেউ পায়নি। বাবা আরো অনেকদিন বাঁচুক, শাহীন এখন এটাই চায়। বাবাকে আর কোনোদিন ডাকেনি শাহীন। এখন আর বাবাকে ভয়ও পায় না।

এই জায়গায় এসে শাহীন রোজ মায়ের সাথে কথা বলে। কত কথা….। বাড়ীর লোক, পাড়ার লোক কেন যে তাকে পাগল ভাবে! কই মা তো তাকে পাগল ভাবে না!
মায়ের সেই শান্ত চেহারাটা মনে পড়ে…. শাহীন জানে মায়ের সব কষ্ট নাই হয়ে গেছে। কি শান্তির ঘুম ঘুমায় মা! আচ্ছা কষ্টগুলো কি ভূতের মত…. সব কষ্ট কেমন করে শাহীনকে ভর করে! মায়ের কষ্টগুলোর এত ওজন….

-ফারহানা নীলা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *