ওয়াল টু ওয়াল একটা বুকশেল্ফ। সেটাতে হাজার খানেক বই। এই অজ পাড়াগাঁয়ে এতো বই দেখবে কল্পনাও করতে পারেনি রাজিব। আরেকটি দেয়াল জুড়ে নানান সময়ের নানা প্রকার ঘড়ি। বিশাল এক ঘড়ির কালেকশন। ঘরটার এক কর্নারে একটি রকিং চেয়ার রাখা, পাশে একটি ছোট্ট টেবিল। টেবিলটার ওপর রবীন্দ্রনাথের গল্প গুচ্ছ রাখা তার উপর একটি চশমা। দেখে মনে হচ্ছে কেউ যেনো পড়ছিল একটু সময়ের জন্য রেখে গেছে। বইটার দিকে রাজিবকে তাকাতে দেখে চেয়ারম্যান সাহেব বলে উঠলেন।
– কি অবাক হচ্ছেন?
– নাহ, ভাবছি আপনি এতোকিছু করে পড়ার সময় কিভাবে পান? তাও আবার রবীন্দ্রনাথের বই?
– আসলে কি জানেন, যার যা নেশা, সারাদিনের মধ্যে কিছুটা সময় না পড়তে পারলে আমার ভালো লাগেনা।
– রায়হান মাহমুদ কে? বইয়ের উপর লিখা নামটি দেখে প্রশ্ন করলো রাজিব।
– স্যরি, আপনার সাথে তো অামার নাম দিয়ে পরিচয়ই হয়নি। আমিই রায়হান মাহমুদ। আপনি?
– রাজিব হুমায়ুন। হেসে বললো রাজিব। আসলে আমাদের পরিচয় টা তো সেভাবে হয়নি সেজন্য নামটা জানা হয়নি।
রুমটা খুটিয়ে খুটিয়ে দেখতে লাগলো রাজিব। দু পাশের দুটো দেয়ালে বই আর ঘড়ির কালেকশন থাকলেও বাকি দুটো দেয়াল নিরেট সাদা। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় এই ঘরটিতে কোনো জানালা নেই। একটি মাত্র দরজা। এখানে বসে বই পড়া একটা অসম্ভব ব্যাপার, তারমানে এই লাইব্রেরী ও বই পড়ার বিষয়টি পুরোটাই ভাওতাবাজি। তারমানে কি? এই ঘরে নিশ্চই কোনো ব্যাপার আছে।
এমন সময় কাজের লোক এসে খবর দিলো, খাবার দেয়া হয়েছে টেবিলে।
-চলুন খেতে খেতে গল্প করা যাবে।
চমৎকার ভাবে টেবিলটি সাজানো হয়েছে। নেপকিন, গ্লাস, চামচ কাটাচামচ যেখানে যেটা দেয়ার দরকার সব কিছু দেয়া আছে। রাজিবের জন্য হাঁস দিয়ে বাাঁ শশ রান্না করা হয়েছে।
এই আইটেমটা রাইয়ান সাহেব নিলেন না। বললেন হাসে তার এলার্জি। তিনি খান না।
রাজিব সব কিছুই নিল তবে সব কিছুই পরিমানে অল্প অল্প করে।।
প্রতিটি আইটেমই খুব যত্ন করে রাধা, বোঝাই যায় এটা কোনো গাঁয়ের বাবুর্চির রান্না নয়। অন্যরকম স্বাদ এবং গন্ধই বলে দেয় এগুলো খুব ক্লাস বাবুর্চি র রান্না।
খাওয়া শেষে তিনজন বারান্দায় এসে বসলেন। রায়হান নিজ হাতে তিন কাপ কফি তৈরি করলেন। চমৎকার সুগন্ধযুক্ত কফি খেয়ে শরীরটা জুড়িয়ে গেলো রাজিবের।।
রাজিব নিজেই প্রসঙ্গটা তুললো,
– আপনি তো অনেকদিন থেকেই দেশে নেই, এই বিশাল বইয়ের কালেকশান কিভাবে হলো আর কে ই বা এগুলোর দেখাশোনা করে?
– এই বইয়ের কালেকশন আমার দাদার সময় থেকে শুরু। কিছুটা বাবার করা আর কিছুটা আমার। তবে বাপ দাদার বইগুলো আসলে বহু বছর বাক্সবন্দী ছিল, আমি এসে ঝেড়ে মুছে এগুলো সেলফে সাজিয়ে গুছিয়ে তুলেছি।
ঘড়ির কালেকশনও সেভাবেই হয়েছে।তবে ইউ এস এতে অনেক এন্টিকের দোকান আছে, সেখান থেকেও কিছু কেনা। যখন যে স্টেটে গিয়েছি সেখান থেকেই কিছু না কিছু নেয়ার চেষ্টা করেছি। আসলে কালেকশন আমার কাছে অনেকটা নেশার মতো। কম বয়সে আমেরিকায় গিয়েছিলাম। তখন বয়স ছিল কম, দু হাতে পয়সা কামিয়েছি , খরচও করেছি গায়ে লাগেনি।
মনে মনে হাসলো রাজিব। এই দেয়ালের একটা ঘড়িও অরিজিনাল না। প্রতিটি রেপ্লিকা। আজকাল এন্টিক কালার দিয়ে পুরোনো আমলের ঘড়ির রেপ্লিকা তৈরি করে বাজারে হরদম বিক্রি হচ্ছে। ভদ্রলোক সবার মতো তাকেও বোকা বানানোর চেষ্টা করছেন।
রাত দশটা এই এলাকার জন্য গভীর রাতই বলা যায়।।
রাজিব নিজে থেকেই বলল, আজ উঠি রায়য়ান সাহেব, খুব ভালো লাগলো আপনার এখানে এসে। আসা রাখি আবারও আসবো।
– অবশ্যই, যখন আপনার ইচ্ছে। আমারও ভালো লাগলো আপনাকে পেয়ে। যদিও আপনার সম্পর্কে তেমন
কিছুই জানা হলোনা। ক’ দিন আছেন?
– আছি, আরও দু চারদিন। ভালো লাগলে হয়তো আরও কিছুদিন থাকবো।
রাজিবকে নামিয়ে দিয়ে মারুফ চলে গেলো, যাবার আগে বলে গেলো দেখলেন স্যার কি অমায়ীক আর ভালোমানুষ। এতোটুকু অহংকার নেই, জীবনের এতোটা সময় বিদেশে কাটিয়েছেন অথচ দেশের মানুষের জন্য কি অকৃত্তিম ভালোবাসা।
শুধুমাত্র দেশের মানুষের সেবা করার জন্য গত তিন বছর ধরে পড়ে আছেন এই পাড়াগাঁয়ে।।
মারুফের গাড়ি চলে যেতেই চারিদিক সুনসান নিরব হয়ে গেলো।
রুমের দরজা খুলে লাইট জালালো রাজিব। যা ভেবেছিল তাই, আজ আরও বেশি তন্ন তন্ন করে ঘাটাঘাটি করা হয়েছে তার রুমের প্রতিটি অংশ। যদিও সাধারন মানুষ দেখলে কিছুই বুঝতে পারবেনা। আপাত দৃষ্টিতে সবই স্বাভাবিক, কিন্তু রাজিব জানে কিছুই স্বাভাবিক না। ওরা রাজিবের প্রতিটি জিনিস সার্চ করেছে। মনে মনে হাসলো রাজিব, এটা তার আগেই মনে হয়েছে, তাই সে যাবার আগে সব প্রয়োজনীয় জিনিস সরিয়ে গিয়েছিল। ওরা যা পেয়েছে তাতে রাজিবকে ছুটি কাটাতে এসেছে বলে যে ধারনা দিয়েছে, তা আরও পাকাপোক্ত হয়েছে। কাপড় চেন্জ করলো রাজিব। ছোট ছোট যে ট্রান্স পারেন্ট সুতো গুলো বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে রেখে গিয়েছিল তা বিশেষ আলোর মাধ্যমে সনাক্ত করে এক সাথে করলো, এগুলো ভবিষ্যতে আবার কাজে লাগবে ভেবে তুলে রাখলো। মাথার পাশে তার ছোট অটোমেটিক রিভলবারটা রেখে শুতে গেলো রাজিব। ভাগ্যিস আজ এটা সাথে নেয়নি, না হলে রায়য়ান সাহেবের সন্দেহটা তার উপর থেকেই যেতো।
রায়য়ান সাহেব তার বাড়ীটাকে যতই খোলামেলা দেখাননা কেন এটি আসলে একটি সুরক্ষিত দূর্গ।। সমস্ত বাড়ীর প্রতিটি দরজার সামনে শক্ত লোহার অটোমেটিক দরজা, সাধারনত এ্যামবেসি গুলোতে এধরনের গেইট দেখা যায়। বিপদের মুহূর্তে যে গেইটগুলো মাটি ফুড়ে উপরে উঠে আসে। প্রতিটি দরজা যে সুরক্ষিত এটা
রাজিব বুঝতে পারে প্রতিটি দরজার সামনে ম্যাট বা পাপোশ দেখে। সবাই দরজার ভেতরে অথবা বাইরে পাপোশ রাখে কিন্তু ঐ বাসার প্রতিটি পাপোস দরজা বরাবর ব্যাপারটা খুবই অদ্ভুত।
তখনই রাজিব বুঝতে পারে এই পাপোশের নিচে কোনো ব্যাপার আছে।।
কিন্তু যে বিষয়টা রাজিবকে দ্বন্দে ফেলে দিয়েছে তা হলো এতো সিকিউরিটি কেনো? কি আছে ঐ বাড়িতে? কেনো গত চারমাসে এই সাধারন মানুষ গুলো খুন হলো? আর রানা কি জানতে পেরেছিল? যার জন্য তাকে জীবন দিতে হল? হাজারটা প্রশ্ন মাথায় জট পাকাতে লাগলো রাজিবের। রানার কলমটা তার বুক পকেটে রাখা, হাত দিয়ে স্পর্শ করলে রানার স্পর্শ পাওয়া যায়।
হাতে নিয়ে কলমটা ভালো করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলো। নিতান্ত সাধারন একটা কলম, কি আছে এতে রানা কি তথ্য রেখে গেছে এটায়? আলোর কাছে নিয়ে ভালো করে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখলো কলমটি, খুব সূূূূক্ষভাবে ইংরেজিতে একটা কিছু লেখা, ফোন দিয়ে ছবি তুলে জুম করলো রাজিব। কয়েকটি ইংরেজি লেটার ও সংখ্যা লেখা। এগুলোর মানে কি? কি বোঝাতে চেয়েছে রানা?
যে করে হোক একবার ঢাকা যেতে হবে।
রানার অফিস ও বাসায় একবার ঢু মারতে হবে। তবে এদের চোখ এড়িয়ে।
চলবে….
-জাহেদা মিমি