আজ অনেকদিন পর মানবী খুব যত্ন করে সাজল। কতদিন পর দেখা হবে। কপালে টিপ পড়া ছেড়েই দিয়েছিল। আজ বড় একটা লাল টিপ পড়ল। চোখে আই লাইনার দিল। খুব মিষ্টি, মায়াবী এমন কমেন্ট সেই ছোট বেলা থেকেই শুনে অভ্যস্ত। আজ নিজেকে দেখে মানবী নিজেই মুগ্ধ। আজ যে তার বিশেষ দিন। শুভকে প্রায় ১২ বছর পর দেখবে মানবী।
খুব সকালে বের হয়ে গেল। যাওয়ার পথে ভাবছিল কিছু রজনীগন্ধা নিলে ভাল হত। এখন বরষা আর শুভ কদম ফুল খুব ভালবাসে। অবশ্য মানবী একটা কাজ করেছে,শুভর আগের কিছু ছবি ছিল যা সে শুভর এফ বি থেকে সংগ্রহ করেছে। সেই স্কুল ,কলেজ থেকে শুরু করে বর্তমান পর্যন্ত কত ছবি যে এফ বি তে পেয়েছে। ওর ছবি গুলোকে একটু ভিন্নতা দেয়ার জন্য বেছে বেছে কিছু একসাথে করে সাদাকালো প্রিন্ট করিয়ে কালো ফ্রেমে বাঁধিয়েছে। নিশ্চয় শুভ খুব সারপ্রাইজড হবে। শুভর প্রিয় রঙ কালো তাই আড়ং থেকে একটা কালোর মাঝে হালকা স্ট্রাইপ দেয়া শার্টও নিয়েছে।
শুভর সবকিছু টাইম লাইনে পাবলিক করা তাই গতবিধি , ব্যবসা, পরিবার সব কিছুই মানবীর জানা। মানবী আজ ১২ বছর পর মুখোমুখী হতে যাচ্ছে শুধু দেখাই হয়নি কিন্তু শুভ’র প্রতিটি পরিবর্তন যা সময়ের সাথে সাথে হয়েছে তার সবটুকুই যে তার নখদর্পণে। প্রতিদিন একটা দীর্ঘ সময় কাটে শুভর প্রোফাইল দেখে আর ওর দুষ্ট মিষ্টি ছবির সাথে কথা বলে। আচ্ছা শুভও কি কখনো এফ বি বা অন্য কোন ভাবে মানবীকে খুঁজেছে ? আকাশ পাতাল ভাবতে ভাবতে সিএনজি চালকের কথায় সন্ধি ফিরে পায়। আপা…… কোন দিকে যাব বলেন? ঠিকানা টা বের করে মানবী বা-দিকে যেতে বলে।
শুভর অফিসের সামনে গিয়ে মানবীর পা আর চলছিল না। কি এক অজানা আশংকায় নাকি আবেগ উত্তেজনায় মানবীর সারা শরীর কাঁপছিল। কড়া নাড়তেই দরজা খুলে দিল অফিসের একজন। শুভর কথা বলতেই বলল বসেন… স্যার আছেন। মানবীর ভিতরে আজ যে যুদ্ধ চলছে। ঠিক মিনিট দশেক পর সেই পরিচিত আফটার সেভের গন্ধ নাকে লাগে।মুহূর্তেই মানবী মোহাচ্ছন্ন হয়ে যায়। তারপর পিছন থেকেই শুনতে পায় সেই ভারী কণ্ঠ,তুমি?
মানবী আজ অনেকদিন পর তার সেই স্বপ্নের মানুষটাকে দেখছে। মানবীর খুব ইচ্ছে করছিল শুভকে ঠিক আগের মত জড়িয়ে ধরতে। কিন্তু আজ শুভ কেমন আবেগহীন যন্ত্রের মত কথা বলছে। এতদিন পর দেখা অথচ শুভর মাঝে এর কোন ভাব লেশ টুকু নেই। ওর চোখে কোন আবেগ নেই।
মানবী প্রথম জানতে চাইল কেমন আছ? শুভ কোন উত্তর না দিয়ে বলল “তা কি মনে করে এত দিন পর? তা প্রায় ১০ বছর কি বল!” মানবী মাথা নেড়ে বলল …না ১২ বছর।
কিছুক্ষন চোখাচখি,আর দীর্ঘশ্বাস। কিছুক্ষণ পর শুভ বলল.. ‘তোমাকে এগিয়ে দিয়ে আসি চল।’ মানবী বাকরুদ্ধ হয়ে গেল। অভিমানে বলল থাক আমি একাই যাব। মানবী পিছন ফিরে আর তাকায়নি। চলে আসার সময় শুধু শুনতে পেল শুভ বলছে ভাল থেকো। আজ বারবার মানবী সেই ১২ বছর আগে ফিরে যাচ্ছিল।
মানবী তখন মাত্র গ্রাজুয়েশন শেষ করেছে। জীবনে প্রথম ইন্টারভিউ দিয়েই চাকরি পেয়ে যায় একটি এয়ারলাইন্স সেলস এজেন্ট হিসেবে। প্রতিদিন হাজার মানুষের সাথে যোগাযোগ হত। শুভ অনেক বিদেশে ট্রাভেল করত তাই মাঝে মাঝে আসত। এসেই যত ব্যস্তই থাক না কেন মানবীর জন্য অপেক্ষা করত। মাঝে মাঝে কাজের প্রয়োজনে ফোনেও কথা হত। সবসময় মনে হত শুভ কিছু বলতে চায়। এক সময় কথা বলা প্রতিদিনের রুটিন হয়ে গেল। শুভর সব কথাই মানবী মুগ্ধ হয়ে শুনত। কি যে সুন্দর করে কথা বলত। এভাবে সম্পর্ক টা অনেকদূর এগিয়ে গেল। শুভ’র সাথে বাইরে প্রথম দেখা করার আগ্রহ মানবীই প্রথম জানায়। শুভ দেখা করার বিষয় টা এড়িয়ে যেতে চাইত। একদিন শুভ জানাল সে বিবাহিত এবং এক সন্তানের জনক।
শুভ মানবী’র কাছে বারবার ক্ষমা চায়। বলে, ‘আমি তোমাকে ঠকাতে চাইনা’। কিন্তু আমি যে তোমাকে না দেখলে তোমার কথা না শুনলে থাকতে পারিনা। শুভ র এই আবেগপূর্ণ মায়াময় কথা কখনোই মানবীর ভাণ বা মিথ্যে মনে হয়নি। খুব কষ্ট হয়েছিল যদিও তবু কোনভাবেই নিজেকে সে সংযত করতে পারেনি শুভর চিন্তা থেকে। শুভ খুব সুন্দর কবিতা আবৃত্তি করত, থিয়েটার শুভর প্রান ছিল। মাঝে মাঝে মানবীর হাত ধরে ঠিক চোখের দিকে তাকিয়ে গভীর কণ্ঠে আবৃত্তি করত। ‘বড় অসময়ে দেখা হল বন্ধু…. তবু ভালোবাসি.. শুধু ভালোবাসি।”
মানবীর এই সম্পর্কটা নিয়ে নিজের সাথে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ হতো। হায়! কেন যে নিজেকে কোনভাবেই শুভর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারত না। তাই সম্পর্ক টা থেমে না গিয়ে আরও গতিময় হয়েছিল। মাঝেমাঝে ভীষন অপরাধবোধ কাজ করত। কিন্তু কি যে দুর্নিবার ভয়ানক সেই আকর্ষণ, মানবী কোনভাবেই নিজেকে সামলাতে পারতো না।
এক সময় মানবীই বেশি দুর্বল হয়ে পড়ে। একদিন অফিসের পর শুভ র অফিসে গিয়েছিল। সেদিন অফিসে নতুন বছরের প্রথম দিন উপলক্ষে সবাই শাড়ি পড়ে ছিল। মানবীকে দেখে শুভ কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়েছিল। তারপর মানবী কে জড়িয়ে কপালে আলতো করে চুমু খেয়েছিল। মানবী সেই মূহুর্তটা এখনও ভুলতে পারেনি। শুভ এরপর বারবার ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিল। আসলে মানবীর ঐ দিন ইচ্ছে করছিল শুভর অনেক কাছে যেতে। কিন্তু শুভ কখনো সুযোগ নিতে চাইত না।
মানবী কে মাঝেমাঝে ই শুভ একসাথে অনেক বই পাঠাত। সুনীল,সমরেশ, রবীন্দ্রনাথ, শামসুর রহমান আর ও কত বই। মাঝেমাঝে বিভিন্ন বই নিয়ে কথা বলত। কি যে সুন্দর করে বলত। মানবী শুধু মুগ্ধ হত। একদিন শুভ বলেছিল চল আমরা একদিন খুব সকালে রমনাতে যাই। তুমি আমি খালি পায়ে ঘাসের উপর হাঁটবে। শুভ তো এমনই ছিল। শুভর মাঝে মানবী কখনো পাওয়ার লোভ দেখেনি। কখনো মানবীকে ব্যবহার করতে চায়নি। শুভর চোখ ছিল ভীষণ মায়ায় ভরা সেখানে কোন লাম্পট্য ছিলনা।
মাঝেমাঝে শুভ মানবী কে এক নজর দেখার জন্য অফিসের সামনে নয়তো বাসস্টপে দাঁড়িয়ে থাকত। কখনো হাতে থাকত এক গুচ্ছ রজনীগন্ধা নয়ত কদম বা বেলি ফুলের মালা।
মানবীর এই জটিলতাপূর্ণ জীবনের অবসান হবে বলেই হয়ত এক সপ্তাহের নোটিশে বিয়ে হয়ে যায়। ছেলে মানবীর বাবার পছন্দের আর মানবীর কিছু বলার ছিল না। ছেলে ডাক্তার আর মানবী কোন মুখেই মা বাবাকে শুভর কথা বলবে। মানবী শুভর সংসার ভাঙতে চায়নি!
আজ ১০ বছর হল মানবী তমালের ঘরনি। একটা ফুট ফুটে কন্যা আছে ওদের। মানবীর সংসারে কোন অভাব নেই। তমালের সাথে যে মানবীর ঝগড়া হয় তাও নয়। কিন্তু ওদের সম্পর্কে কোন প্রান নেই।
মানবী কে গভীর আবেগে কখনো তমাল কোন কথা বলে নি। মানবীকে ভালোবেসে কোন দিন জড়িয়ে ধরে নি। বর্ষাকালে কদমফুল বা রজনীগন্ধা এনে দেয় নি। আসলে শারিরিক সম্পর্ক ছাড়া যে ভালোবেসে স্পর্শ করা যায় এটা তমাল জানেই না। দিন দিন এই যান্ত্রিক সম্পর্ক টা মানবী কে শুধুই শুভকে মনে করিয়ে দেয়।
এরপর শুভ কে মানবী ফোন করে একদিন। শুভ জানতে চায়,এতদিন পর কেন? তুমি কি বলতে চাও? মানবী প্রতি উত্তরে বলে আমার আবার তোমাকে চাই। আমি আবার তোমাকে অনুভব করতে চাই। শুভ অবাক এবং বিরক্তি নিয়ে বলে দেখ! আমার সময় নেই। আর তুমি আমার সাথে কোন যোগাযোগ রাখোনি এতদিন।” মানবী তবু বলে, আমরা কি বন্ধু হতে পারিনা? শুভ কিছু না বলে শুধু বলে ভাল থেকো আর আমায় তুমি ফোন করোনা! আমি তোমার জীবন কে আর জটিল করতে চাই না। মানবী কোনভাবেই বুঝাতে পারে না। আসলে জীবন সবসময়ই জটিল।
অসময়ের শুভকে মানবী কোন দিন ভুলতে পারেনি। মানবী শুভকেই যে জীবনে চেয়েছিল। মানবীর স্বপ্ন কল্পনায় যে শুভর পদচারণা। মানবী তার জীবনের প্রথম ভালোবাসাকে কোনভাবেই ভুলতে পারেনি। বাকি জীবনটা হয়ত এভাবেই কাটবে। কারো কারো জীবনে বড় ভুল সময়ে ভুল মানুষের সাথে দেখা হয়।
মানবীর কানে বারবার একটা সুর বেজে উঠে,
তবুও বেঁচে আছি।
সেই দিনের ভালোবাসার স্মৃতি নিয়ে
কারন আমি যে অসময়ের
সেই ভালোবাসাকেই চেয়েছিলাম ।
– হালিমা রিমা