কই তুমি? মিজান সাহেব ঘরে ঢুকতে ঢুকতে ডাক দেয়। বাসায় ফিরে ফিরোজাকে কখনই সামনে পাওয়া যায় না। বেক্বল আর কাকে বলে! সারাদিন পর বাসায় ফিরে মেজাজটাই খিঁচড়ে যায়। রবরব পরিবহনের যাবতীয় রাগ জমা হয় মনে। কেরাণীর চাকরী… সারাদিন স্যার স্যার করে জিভে ফেনা ওঠে। আর ঘরে এসে একটু শান্তিও নেই। ফিরোজা একটা স্কুলে পড়ায়। মাস্টারি করতে করতে অভ্যাসই খারাপ হয়ে গেছে। সবাইকে ছাত্র ভাবে! সংসারে শান্তি হলো না! মিজান সাহেব ভাবী আর বোনদের কথা মনে করে। তারা কেউ এত লেখাপড়া করেনি। তার মা গত হয়েছেন ছোটবেলায়।স্মৃতি হাঁতড়ে মায়ের অবয়বে তিনি এমনটি খুঁজে পান না। লেখাপড়াই নষ্টের মূল! মেয়েরা হবে মোমের মত… গলে গলে যাবে। মেয়েরা হবে লবঙ্গ লতিকা, কুঞ্জলতা, অপরাজিতা… জড়িয়ে পেঁচিয়ে উঠবে। তা না ফিরোজা একটা বেটাছেলের মত… আত্ম নির্ভরশীল! কোনো রস কষের বালাই নেই। চাকরী,রান্নাবাড়া, সংসার আর বাপের বাড়ীর টান… যত্তসব বোগাস!
আজ অফিসে তার শেষ কর্মদিবস ছিল। বাঁচা গেলো! চাকরী করতে করতে জীবনটা তেজপাতা! গ্রামের বাড়ীতে একটা মাদ্রাসার কাজ শুরু করেছেন। গ্রামেই থাকতে চান তিনি। গ্রামে গেলে নিজেকে বেশ বড় বড় লাগে। মূর্খ মানুষগুলো বেশ সম্মান দিয়ে কথা বলে। ওখানে নিজের কথা আর কাজের দাম পাওয়া যায়। মিজান সাহেবও বেশ ওজন নিয়ে চলেন গ্রামে। ফিরোজার চাকরী আছে এখনো। তিনি একাই থাকবেন গ্রামে। মেয়েটার বিয়ে হয়ে গেছে। ছেলেটা চাকরী করে।মিজান সাহেব এখন ঝাড়া হাত পা।
ফিরোজার সাথে সেই কবে থেকে থাকতে চান না তিনি। কিন্তু চাকরীর জন্য থাকতে হয়েছে। ভাই বোনের বাড়ীতে থাকতে গিয়েছেন… কিন্তু সব তো আর আগের মত নেই। সবারই সংসার বড় হয়েছে। অগত্যা ফিরোজাকে হজম করতে করতে এখন বদহজম হবার দশা! বিয়েটা যে ভুল ছিল তা তিনি আগেই বুঝেছেন।শিক্ষিত মেয়ের সংসার সুখের হয় না।মাসে মাসেই তিনি গ্রামে যান। কটা দিন শান্তিময় হয়। গ্রামের একটা মেয়েকে বিয়ে করলে আজ কত সুখের হতো জীবনটা! মিজান সাহেবের দীর্ঘশ্বাস বাতাসে মিলায়।
… এই যে আমি! ডাল ঘুটনা দেই। আঁচলে ঘাম মুছতে মুছতে ফিরোজা কথা বলে।
… ঘোটো ঘোটো বেশী করে ঘোটো! জীবনটাই তো ঘুইট্যা ফেলাইছো! গজগজ করতে করতে মিজান সাহেব ঘরে ঢোকেন।
মেয়ের ঘরে ফিরোজা নামাজে বসে। হজ্ব করে এসে মিজান সাহেব দাঁড়ি রেখেছেন। নামাজ পড়েন পাঁচ ওয়াক্ত। আজকাল ইসলামী তড়িকায় সাজগোজ করেন। বড় ভাল লাগে.. সবাই যখন নূরানী চেহারার প্রশংসা করে।
চটপট ব্যাগ গুছিয়ে নেন। আতর, বডি স্প্রে, পান্জাবী,কোটি, শাল… সব! সকালে পড়ে যাবার কোট আর টাই আগেভাগেই বের করে রাখেন।
ফিরোজা আবার কি প্রশ্ন করে বসে… বলা যায় না। যতসব সৃষ্টিছাড়া কথা।
গতরাতেই তিনি কথাটা ফিরোজাকে বলে ফেলেছেন… খুব মামুলীভাবে।
…. কাল বাড়ী যাবো। কাজ আছে। আর তুমি তো আমাকে গ্রামের একটা মেয়ে বিয়ে করতে বলেছিলে!
…. হুম বলেছিলাম।এখনো বলছি। গ্রাম্যবালা একদম টসটসা কচি দেখে! ফিরোজা নির্বিকার উত্তর দেয়।
…. ভাবছি বিয়েটা করেই ফেলি।পুরুষ মানুষ তো আর একা থাকতে পারে না। আর তুমিও তো যাবে না। কি আর করা…. মিজান সাহেব ভার লাঘব করেন।
কইতুরি—-
কুপি বাতির সলতে দিয়ে কাজল বানাচ্ছে কইতুরি। শীতের রাত,কুয়াশায় কিছু দেখা যায় না।কইতুরি আজ সন্ধ্যাবেলায় জানতে পারে …. কাল দাদা আসবে। তারপর থেকেই মনটা পাখীর মত! দাদাকে আকাশের মত মনে হয় কইতুরির। কইতুরির উড়বার ঠিকানা! দাদা যখন বাড়ী আসে,কত কিছু নিয়ে আসে। কইতুরির রাত কাটে না। দাদা এবার থেকে বাড়ীতেই থাকবে… ভাবতে ভাবতে লাল হতে থাকে কইতুরি।
সালামের মেয়ে কইতুরি। সালাম বংশ পরম্পরায় কাজ করতো মিয়া বাড়ীতে। মিয়াদের কাছেই বড় হয়েছে সে। এখন বয়স হয়ে গেছে। মিজান সাহেবকে ছোটবেলায় দেখাশোনা করতো। চাচা বলে ডাকে। বাড়ী এলেই মিজান সাহেব কইতরীকে ডেকে পাঠায়। এই নিয়ে গ্রামে কানাঘুসা চলে। তাতে অবশ্য কিছু যায় আসে না…. মিজান সাহেব মেয়েটারে খুব আদর করেন।
মিজান সাহেব রওনা হচ্ছেন। ফিরোজা ফজরের নামাজ শেষ করে। সারাঘর আতরের গন্ধে ভরে গেছে। ব্যাগগুলো আগেভাগেই বাইরে রেখে এসেছেন মিজান সাহেব। ঘরের জন্য একটা কার্পেটও যাবে এবার। ওখানে থাকার পরিবেশ তৈরী তো এখন থেকেই করতে হবে!
ফিরোজার ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা… মিজান সাহেব দেখতেও পান না!
ফিরোজা:
আজকাল এই মানুষটাকে চেনে না সে। বিগত যৌবনা ফিরোজা আজ উচ্ছিষ্ট। মিজান সাহেবের জীবনে সোপান দরকার ছিল। ফিরোজা বেশ জেনে গেছে কথাটা। সারা জীবন কেবল দোষই শুনে গেছে সে। কতবার মানুষটা তাকে ছেড়ে গেছে….
আসলে মিজান তো কখনোই ছিল না তার! শুধু মাত্র সংসার নামক অভ্যস্থতায় দিন কেটে গেছে। স্থূল বোধের মানুষটা… কোনোদিনই ফিরোজাকে বুঝতে পারেনি। আর মানুষই তো বদলায়…. যখন তখন বদলায়! মিজানের অবদমিত মনে আজ ভালবাসার চাষাবাদ। ভালই লাগে ফিরোজার! আহা মানুষটা প্রেমে পড়েছে… সেটা কি আর বোঝার বাকী থাকে!
আঙুলের টোকায় সব ফেলে দেয় ফিরোজা। আজকাল চোখটা পোঁড়ায় বড়…. ভালবাসার সাথে দেখা না হওয়ার কষ্টটা….. এক জীবনের অসঙ্গতি মেনে নেওয়া আর নিজেকে ভালবাসা….. ফিরোজা ঘুরে দাঁড়ায় একশ আশি ডিগ্রী!
–ফারহানা নীলা