‘আজ আমরা কোথায় যাচ্ছি?’
ঘর থেকে বের হয়ে রুবিনা জিজ্ঞেস করল সোহেলকে।
‘প্রথমেই যাবো গ্রাউন্ড জিরোতে। সেখান থেকে ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেন। তারপর নিউইয়র্ক পাবলিক লাইব্রেরী। রাতে জ্যাকসন হাইটসের কোনো বাংলাদেশী রেস্টুরেন্টে দেশী খাবার, তারপর বাসা।’
‘তারপর?’ রুবিনার হাসিতে দুষ্টুমি।
‘তারপর…’ সোহেল আর কিছু না বলে একটা অর্থ পূর্ণ হাসি ফিরিয়ে দিল রুবিনার দিকে।
একদিনে যতটুকু সম্ভব রুবিনাকে নিউইয়র্ক শহরটা ঘুরিয়ে দেখাল সোহেল।
‘কি আশ্চর্য্য। কি ভয়ঙ্কর! ওয়াও! ইশ, এখানে না এলে কত কিছু অদেখাই থেকে যেত।’ সারাক্ষনই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করল সে। যা দেখে তাতেই মুগ্ধ হয় রুবিনা।
ম্যানহাটনে এসে কেমন যেন অন্যমনস্ক হয়ে গেল সোহেল। নিজের মনেই আক্ষেপ করতে থাকে। ‘মাঝে মাঝে ভাবি, এদেশে না এলেই বোধ হয় ভাল হতো। দেশে থেকে নিশ্চয়ই কিছু না কিছু করতে পারতাম। দেশে আমার সব বন্ধুরাই আজ দাঁড়িয়ে গেছে।’
‘তুমিই না অস্থির হয়ে গেলে? আর কিছুদিন অপেক্ষা করে দেখতে, চাকরী নিশ্চয়ই একটা পেয়ে যেতে।’
‘সত্যিই, তোমার জীবনটাও তাহলে এমন প্যাঁচের মধ্যে পড়ত না। আর আমারও এ অবস্থা হতো না। হাজার হাজার ডলারের লোনে প্রায় ডুবে গেছি আমি। কত টাকা খরচ করেছি। একটা সবুজ কাগজের অভাবে কিছুই করতে পারলাম না।’ সোহেলের কন্ঠে হতাশা ঝরে পড়ল।
রুবিনা এগিয়ে এসে সোহেলের হাত ধরল। তারপর গাঢ় স্বরে বলল, ‘এখন আর এসব কথা ভেবে কষ্ট বাড়িয়ে লাভ কি? এতদিন হয়নি তো কি হয়েছে, এখন হবে। তুমিই তো বললে, কত মানুষ দশ বছর এমনকি বিশ বছরও অপেক্ষা করে একটা গ্রীনকার্ডের জন্যে।’
সোহেল সামান্য হাসল। রুবিনা তাকে সাহস দিয়ে বলল, ‘আমরা একটা নতুন জীবন শুরু করব সোহেল। আমি জানি আমাকে সবাই খারাপ বলবে। বলুক। আমি আমার ভালবাসার মানুষের সাথে জীবন কাটাতে চাই। তারজন্যে যে কোনো অপবাদ আমি মেনে নেব। জীবনটা আমার, আমি আমার মত করে বাঁচতে চাই। আর সেই অধিকার নিশ্চয়ই আমার আছে?’ বলতে বলতে রুবিনার কন্ঠ ভারী হয়ে গেল।
সোহেল নীরবে রুবিনার কথা শুনতে থাকে। রুবিনা আবার বলল, ‘আমিই বা কি করব। দুজন মানুষের সাথে যদি কোনো কেমিস্ট্রিই না কাজ করে, তাদের একসাথে থাকার কি মানে? যার সাথে শরীর-মন কোনো কিছুরই মিল নেই, তার সাথে সারাটা জীবন কাটানোর কথা আমি ভাবতেও পারি না। কোন মানুষ এভাবে তার সারাটা জীবন কাটাতে পারে না।’
কিচুক্ষন চুপ করে থেকে রুবিনা আবারও বলল, ‘মানুষের জীবনে একটা ভুল সিদ্ধান্তে অকালে নষ্ট হয় তার জীবন। ঠিক তার বললে ভুল হবে, সাথে জড়িয়ে থাকে আরও কয়েকটি জীবন। কষ্ট পেতে হয় সারাটা জীবন।’
দিনের আলো কমে আসছে। ধীরে ধীরে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামছে নিউইয়র্কের আকাশে।
অনেকক্ষন থেকেই দূরের স্ট্যাচু অফ লিবার্টির দিকে মোহাবিষ্ট হয়ে তাকিয়ে আছে রুবিনা।
রুবিনার খুব কাছে এসে দাড়াল সোহেল। আজ সকাল থেকেই সে ভাবছিল রুবিনাকে একটা কথা বলা দরকার। অনেকবার বলতে চেয়েও বলা হয়নি। এখন না বললে দেরী হয়ে যাবে। অথচ বলা হচ্ছে না। কিছুটা দ্বিধা কাটিয়ে সোহেল রুবিনার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘রুবি, তোমাকে আমার কিছু কথা বলার ছিল।’
রুবিনা চোখ না ফিরিয়েই বলল, ‘আমি ওখানে যেতে চাই, আজকেই।’ রুবিনা সোহেলের কোনো কথা শুনেছে বলে মনে হলো না।
‘লাস্ট ফেরীটা তো ছেড়ে চলে গেছে। দিনের আলোয়ে না গেলে ভাল লাগবে না। আমরা বরং আরেকদিন যাবো।’
রুবিনা কিছু বলল না। সোহেল কিছুক্ষন চুপ থেকে আবার বলল, ‘রুবি, তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে। ইটস ইম্পোর্ট্যান্ট।’
‘বাসায় যেয়ে শুনব।’ বলেই রুবিনা আফসোসের সুরে বলল, ’ইশ, কেন যে আগে বললাম না। লাসড় ফেরীটা কখন ছেড়ে গেছে?’
‘বিকেল পাঁচটায় সম্ভবত।’
‘ও।’
এরপর সোহেল আর কোন কথা বলতে পারল না।
রুবিনা মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে রইল লিবার্টি আইল্যান্ডের দিকে।
ফেরার পথে সোহেল রুবিনাকে নিয়ে গেল বাংলাদেশী অধ্যুষিত এলাকা জ্যাকসন হাইটসে। জ্যাকসন হাইটসের ৭৩ থেকে ৭৪ স্ট্রীটে অবস্থিত বাংলাদেশী দোকানগুলি নিউইয়র্ককে বাংলাদেশীদের কাছে একটা বিশেষ মহিমা দিয়েছে। ৭৪ স্ট্রীটে ঢুকলে দেখা যাবে যে অদৃশ্য স্টারগেইট জাতীয় কোন গেইট পার হয়ে আমেরিকার নিউইয়র্ক থেকে হঠাৎ ঢাকার ফার্মগেটে পৌছে গেছে। লোকেরা জটলা করে বাংলায় আড্ডা দিচ্ছে। রাস্তা ঘাট বাংলাদেশের মতই সংর্কীণ আর নোংরা। দোকান পাট বাংলায় নামকরন করা। এমনকি একটা রাস্তার নাম দেয়া হয়েছে বাঙ্গালীর নামে। আমেরিকার ব্যস্ততম শহরে হঠাৎ বাংলাদেশ। রুবিনা কৌতুহলী দৃষ্টিতে চারিদিকে দেখল আর অবাক হলো।
একটা দেশী রেস্টুরেন্টে ঢুকে পড়ে ওরা রাতের খাবার অর্ডার দিল। রুবিনা অবাক হয়ে লক্ষ্য করল, দেশের যাবতীয় খাবারের আয়োজন এখানে আছে। একেবারেই বাংলাদেশী কায়দায়। অনেকদিন পর খুব মজা করে দেশের খাবার খেতে পেরে তার মনটা প্রফুল্ল হয়ে গেল। সে ক্ষনে ক্ষনে বলল, দারুন। দারুন। খাওয়া শেষ করে বের হয়ে সোহেল একটা পানের দোকান থেকে দুটো মিষ্টি পান কিনে রুবিনার হাতে দিল। রুবিনা হাসতে হাসতে একটা পান মুখে নিয়ে বলল, ওয়াও! অসম্ভব সুন্দর একটা দিনের শেষ করে যখন ওরা বাসায় ফিরল তখন অনেক রাত।
শরীফ অফিসে বসে আছে, অন্যমনষ্ক ভাবে। কাজে মন দিতে পারছে না। কিছুই ভাল লাগছে না তার। অবশেষে হাতের কিছু কাজ গুছিয়ে বাসায় চলে আসল। মনটার সাথে ধীরে ধীরে শরীরটাও কেমন যেন অবশ হয়ে আসছে।
শরীফ অনুভব করল–মনের সাথে শরীরের অদ্ভুত এক সম্পর্ক রয়েছে। মন ভাল অবস্থায় শরীর খারাপ থাকলেও তা ভাল হতে সময় লাগে না। আবার মন খারাপ থাকলে শরীর ভাল থাকলেও তা খারাপ হতে সময় লাগে না। মনই সব, শরীর কিছু নয়।
ঘরে ঢুকে শরীফের মনটা আরো খারাপ হয়ে গেল। মেয়েটা সবকিছু কি সুন্দর পরিপাটি করে সাজিয়ে রাখত। সোফায় হেলান দিয়ে শরীফ ভাবতে থাকে রুবিনার কথা। পেছনের কথা ভাবতে ভাবতে তার একদিনের কথা মনে পড়ল। খাবার টেবিলে রুবিনা তাকে জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা, একটা কথা তোমার কাছে অনেকবার জানতে চেয়েছি। তুমি এড়িয়ে গেছ। আই’ম জাস্ট কিউরিয়াস।’
‘কি কথা?’ হাসতে হাসতে শরীফ চোখ তুলে তাকাল রুবিনার দিকে।
‘তুমি সময় থাকতে বিয়ে করলে না কেন? আই মিন একজন পুরুষ সাধারনত যে বয়সে বিয়ে করে। বিয়েরও তো একটা বয়স আছে, তাই না?’
শরীফ কোনো কিছু না বলে চুপচাপ খেতে থাকে।
‘বুঝেছি, বলবে না।’
‘কি বলব? প্রয়োজন হয়নি, তাই।’
‘নাকি প্রয়োজনটা মিটে যেতো অন্য কোনো উপায়ে।’
‘হোয়াট ডু ইউ মিন?’ শরীফের হাসিটা নিমিষে মিলিয়ে গেল।
‘নাথিং।’ বলে চুপ করে গেল রুবিনা। তারপর আবার বলল, ‘অবশ্য প্রয়োজনের বাইরে কোন কাজটাই বা তুমি করো?’
শরীফ কিছুটা অস্বস্তি বোধ করলে কিছু বলল না। কিন্তু রুবিনা বলে চলল, ‘প্রয়োজন মনে করনি বলে গত বিশ বছরের মধ্যে একবারও দেশে যাবার সময় বের করতে পারনি। দেশে যাওয়া মানেই তো একগাদা অর্থের অপচয়। যথেষ্ট উপার্জন তোমার, টাকা পয়সার অভাব নেই, সিটিজেনশীপও আছে। তাহলে?’
শরীফ বুঝতে পারল না কি বলবে, কি বলা উচিত। আর রুবিনাই বা হঠাৎ করে এধরনের কথা জিজ্ঞেস করছে কেন? মেয়েটা কেমন ফুঁসে ফুঁসে কথা বলছে। ওর এমন রাগের ভঙ্গি সে আগে কখনও দেখেনি। চিৎকার করছে না, কিন্তু রাগটা ঠিকই বোঝা যাচ্ছে।
‘তা হঠাৎ তোমার বিয়ের প্রয়োজন পড়ল কেন? বয়স হয়ে যাচ্ছে, দেখাশোনার জন্যে একজন মানুষ তো চাই, তাইনা?’
শরীফ না বোঝার দৃষ্টিতে তাকাল রুবিনার দিকে। রুবিনা বলল, ‘তবু ভাল, সাদা চামড়ায় যত রুচিই থাক না কেন, বিয়ে করতে হবে একশত ভাগ খাটি বাঙ্গালী। তাই বিশ বছর পর দেশে গিয়ে নিজের অর্ধেক বয়সের একটা মেয়েকে বিয়ে করে আনলে। অথচ, মেয়েটার কথা একবারও ভেবে দেখার প্রয়োজন বোধ করলে না।’
ফোনের শব্দে শরীফের ভাবনায় ছেদ পড়ল। ফোন ধরতে ইচ্ছে করছে না। কারো সাথেই কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। তবুও কি মনে করে সে ফোনটা ধরল। রুবিনা হতে পারে। নাকি অফিসের কেউ? সে দ্বিধা হাতে ফোন নিয়ে বলল, ‘হ্যালো?’
‘কেমন আছ শরীফ?’ ফোনের ওপাশে আহমেদ মামার কন্ঠ শোনা গেল।
‘জ্বি মামা, আছি। বুঝতেই তো পারছেন।’
আহমেদ মামা শিকাগোর কমন মামা। বাঙ্গালী কনিউনিটির মধ্যে সবচেয়ে পুরনোদের একজন। তিরিশ বছরেরও বেশী সময় ধরে উনি আছেন এই শহরে। কমিউনিটির সকলে তাই তাকে মুরুব্বী হিসেবে সন্মান করে। তিনিও বুদ্ধি পরামর্শ দিয়ে সাহায্য করেন। জন্মদিন, বিবাহ বার্ষিকী, ঈদ পূনর্মিলনী, বনভোজন, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস—সব দিবসেই তাকে দেখা যায়। শহরে অবাঞ্ছনীয় কিছু ঘটলেই মামার কর্ণ গোচরে সবার আগেই সেটা চলে যায়। তিনি তখন নিজ দায়িত্বে সেটার একটা সমাধান না হওয়া পর্যন্ত লেগে থাকেন।
মামা বললেন, ‘শোনো, আমার খোঁজে একজন ভাল ল’ইয়ার আছে। বেটা জিউইস, কিন্তু আমার সাথে খুব ভাল সম্পর্ক। তুমি চাইলে আমি কথা বলে দেখতে পারি।’
‘না না মামা, আমি এমুহুর্তে এসব কিছুই ভাবছি না।’
‘আচ্ছা ঠিক আছে। আমি এই উইকএন্ডে তোমার বাসায় আসব। কিছু কথা বলা দরকার। কমিউনিটির ব্যাপার তো বুঝতেই পারো। লোকজন বলাবলি করছে।’
শরীফ বুঝতে পারল না লোকজন বলাবলি করছে কিসের ভিত্তিতে। রুবিনা তো সত্যি সত্যিই বেড়াতে যেতে পারে। তা সে নিউইয়র্কেই যাক আর ডালাসেই যাক। সেটা নিয়ে মানুষের এত মাথা ব্যথা কেন? আর এই খবরটাই বা এত তাড়াতাড়ি কানাকানি হয়ে গেল কি করে? সে কিছুইতেই মেলাতে পারল না ব্যাপারটা।
রুবিনার এভাবে চলে যাওয়াটা যতটা না ওকে ব্যথিত করেছে, তার চেয়েও বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে এখানকার বাঙ্গালী কমিউনিটি। ইতিমধ্যে তার স্বল্প পরিচিত কয়েকজনের মাধ্যমে সে জানতে পারল, রুবিনা যে তার প্রেমিকের হাত ধরে পালিয়ে গেছে এই ব্যাপারটা এখন সবাই জানে। আশ্চর্য্য!
অনেক বছর ধরে শিকাগোতে থাকলেও শরীফের পরিচিত তেমন কেউ নেই এখানে। সোসাইটির কোন কার্যক্রম বা অনুষ্ঠানেও সে খুব একটা যায় না। তবে রুবিনা দেশ থেকে আসার পর বেশ কিছু ইভেন্টে সে গিয়েছে তাকে নিয়ে। দু’চারজন বাঙ্গালী ভাবীদের সাথে হয়ত পরিচয় হয়েছে রুবিনার। কিন্তু সে নিশ্চয়ই কাউকে কিছু বলেনি। তারপরেও কিভাবে যে ব্যাপারটার হাত-পা গজিয়ে হাটাহাটি শুরু করে দিল শরীফ কিছুতেই বুঝতে পারল না। সেদিনও আহমেদ মামা ওকে ফোন করে এসব কথাই জানতে চেয়েছেন। আজ আবার ফোন করলেন।
শনিবার সকালে মামা এসে হাজির।
বসন্তের সকাল। চার ঋতুর দেশ আমেরিকার প্রকৃতিতে এখন বসন্ত চলছে। শীতের শেষে গরমের আগে আসে গরমের মতই ক্ষণিকের বসন্ত। ফুরফুরে একটা হাওয়া বইছে চারিদিকে। নানা রঙের পাতার ফাঁকে ফাঁকে রোদের কিরণ উঁকি দিচ্ছে। রোদ ঝলমলে একটা দিনের শুরু।
শরীফ দরজা খুলে দিতেই মামা ভিতরে ঢুকে চলে গেলেন ব্যাকইয়ার্ডে। ছাতার নিচে চেয়ার থেকে কুশনটা ঝেড়ে নিয়ে বসলেন আয়েশ করে। তার হাতে কিছু পুরনো বাংলা পত্রিকা। সেগুলোর একটা ভাজ খুলে চোখের সামনে মেলে ধরলেন।
শরীফ কিচেন থেকে দু কাপ কফি নিয়ে এসে বসল মামার পাশে। মামা তার কফিতে একটা চুমুক দিয়ে কথা শুরু করলেন, ‘আচ্ছা, ব্যাপারটা আমাকে খুলে বলতো? পুরো ঘটনাটা বলবে। কিছুই বাদ দেবে না, দেখি, তোমাকে কোনোভাবে হেল্প করতে পারি কিনা।’
শরীফ কিছু না বলে অন্যমনস্ক ভাবে তাকিয়ে থাকে ওক গাছের ঝাকের মধ্যে দিয়ে পিছনের লেকের দিকে।
মামা অবশ্য শরীফের উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে বলে চললেন ‘আরে আমরা আছি কেন তাহলে? এক কমিউনিটিতে থাকব আর কেউ কাউকে হেল্প করব না, তা কি হয় নাকি? এটি আমাকে দিয়ে হবে না। এদেশে আমাদের আর আছেই বা কে বলো? একে অপরের বিপদে যদি এগিয়ে না আসি, তাহলে চলবে কি করে? তুমি একেবারেই ভাববে না। বলো।’
মামা তাকিয়ে রইলেন শরীফের মুখের দিকে।
শরীফের সব কথাই মামা জানেন। তবুও খানিক্ষন চুপ করে থেকে সে বলল, ‘আপনি তো মোটামুটি সবই জানেন। দীর্ঘদিন পর দেশে গিয়ে পারিবারিক পছন্দে বিয়ে করি। স্ত্রী উচ্চ শিক্ষিত, দেখতেও মোটামুটি সুন্দরী বলে বিয়েতে আপত্তি করিনি। বরং খুশীই হয়েছিলাম।’
আহমেদ মামা এখানে আপত্তি করলেন। তিনি বললেন, ‘তোমার বউ মোটামুটি নয়, যথেষ্ট সুন্দরী। আর তুমি আপত্তি করবে কেন? তুমি যেই বয়সে বিয়ে করেছ, রুবিনার মত একটা মেয়ে তোমাকে বিয়ে করতে রাজী হয়েছিল সেটাই তো যথেষ্ট।’
শরীফ মনে মনে বলল, ‘আরে এ তো দেখি বেশি কথা বলে। আপনি তো এসেছেন কথা শুনতে, বলতে নয়!’ কিন্তু সে মামার কথায় সহমত জানিয়ে বলল, ‘জ্বি মামা, বয়সের ঐ গ্যাপটাই যা একটু বেশী। কিন্তু ওকে আমি খুবই পছন্দ করি। অনেক ভালোওবাসি।’
‘সে কথা কি তোমার বউ জানে?’
‘জানবে না কেন? না জানার কি আছে?’
‘আছে, না জানার অনেক কিছুই আছে। তাকে সেটা জানাতে হবে। বোঝাতে হবে। না হলে সে জানবে কি করে?’
শরীফ না বোঝার দৃষ্টি নিয়ে মামার দিকে তাকিয়ে রইল। মামা বললেন, ‘বাদ দাও। আচ্ছা বলত, রুবিনা কি তোমাকে ভালবাসে?’
শরীফ চুপ করে রইল। এ প্রশ্নের কোনো উত্তর তার কাছে নেই। সে নিজেও জানে না রুবিনা তাকে ভালবাসে কিনা।
‘শোন শরীফ, তোমাকে একটা কথা বলি। তিরিশ বছরের বেশী হলো এদেশে এসেছি। চোখের সামনে অনেক কিছু দেখেছি। মনে কিছু করো না। আমার ধারনা রুবিনার অন্য কারো সাথে এফেয়ার হয়েছে। তা না হলে এভাবে চলে যাবার তো কোনো কারন থাকতে পারে না।’
শরীফ আপত্তি জানিয়ে বলল, ‘কিন্তু সেটা কি করে সম্ভব। মাত্র চার মাস হলো রুবিনা আমেরিকায় এসেছে। তাছাড়া, কারো সাথে তো ওর জানাশোনাও হয়নি এখনও।’
‘জানাশোনা হয়ত আগেই ছিল। তুমি জানতে না।’
শরীফ অবিশ্বাস্য দৃষ্টি নিয়ে তাকাল মামার দিকে। তারপর দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে তাকিয়ে থাকল দূরের লেকের দিকে, যত দূর দৃষ্টি যায়। ভাবনাগুলো আবার এলোমেলো হয়ে গেল।
(শেষ পর্বের অপেক্ষায় থাকুন…)
ফরহাদ হোসেন
লেখক-নির্মাতা
ডালাস,টেক্সাস