হিজল ভালোবাসা

পুকুর পাড়ে সন্ধায় বসে থাকতে হনুফার খুব ভালো লাগে। কি সুন্দর ঠাণ্ডা শীতল পানি। পুকুরের চারপাশটাও কেমন শীতল। চারপাশে সারি সারি নারিকেল গাছ দাঁড়িয়ে আছে। যেন একজন অন্যজনের বন্ধু। আর আছে একটা বিরাট হিজল গাছ। গাছটা পুকুরের দিকে অনেকটা নুয়ে পড়েছে। হিজলের লাল রক্তিম ছায়া যখন পানিতে পরে পুকুরের পানিকেও লাল মনে হয়। হনুফার মাঝে মাঝে মনে হয় সে যেন গাছেদের কথা বুঝতে পারছে। ঘাটে আসা বারণ তবুও মাকে ফাঁকি দিয়ে ছোটভাই তনুকে নিয়ে চলে আসে চুপি চুপি। দুই ভাই বোন মিলে শান বাঁধানো ঘাটে পা ডুবিয়ে বসে থাকতে খুব মজা পায়। কত গল্পই না ওদের ।
হনুফার বয়স বারো আর তনু দুই বছরের ছোট।

হনুফার গাছেদের সাথে একা কথা বলার স্বভাব। তনু যখন পুকুরপাড় আপন মনে খেলে হনুফা তখন হিজল গাছের সাথে কথা বলে। এই খেলা হনুফার পছন্দের খেলা। বাপজানের গঞ্জে মুদির দোকান ভালোই চলে। হনুফারা তিন ভাই বোন। সে বড় আর ছোট দুই ভাই তনু আর মানু।

হনুফা এবার সপ্তম শ্রেণিতে উঠেছে। তনু পঞ্চম আর মানু খুব ছোট। সুন্দর সংসার। গতবার গ্রামে বিরাট মেলা বসে ছিল। কি যে জাঁকজমকপূর্ণ ছিল। আর বাপজান তাদের তিন ভাই বোন কে নিয়ে গিয়েছিল। কত জিনিষ পাওয়া যায় মেলায়। হাটে আবার মস্ত বড় হাতি নিয়ে আসে সার্কাসের দল। তারা কত খেলা দেখায়।একবার হাতি শুড় দিয়ে তার হাত ধরে টেনে ধরেছিল। এটা নাকি সৌভাগ্যের প্রতীক। সবাই বলল আমি নাকি অনেক বড় লোক হবো……………আমার অনেক টাকা হবে।

বাবা একদিন গঞ্জে গিয়ে আর ফিরে আসে না। একদিন দুইদিন এভাবে বছর চলে যায়। হনুফাদের সংসারে অভাব অনটন হানা দেয়। মা চেয়ে চিন্তে সংসার চালায়। চাচারা বলে বাবা নাকি দোকান বিক্রি করে দিয়েছে। হনুফার পড়াশুনোর পাঠ চুকলো। অনাহারে অর্ধাহারে সবার দিন কাটে। জীবন যখন দারিদ্র্যতার মাঝে মুখ থুবড়ে ঠিক তখন আম্বিয়া খালার প্রস্তাবে হনুফার মা যেন স্বস্তি পেল। মাসে ছয় হাজার টাকা বেতন ঈদে বোনাস এর চাইতে আর কি ভালো হতে পারে। মা বলেন…. “ছোট ভাই দুইটার দিকে চাইয়া দেখ । তুই ঢাকা যা আমাগো বাঁচা । তোর দুই ভাই না থাকলে আমি নিজেই যাইতাম।“ ছোট দুই ভাই ,মা,পুকুরপাড়,প্রিয় গাছ সব রেখে যেতে হনুফার বুকটা কষ্টে ফেটে যাচ্ছিল। তবুও কিছুই করার নাই। তার পরিবারের জন্য তাকে যেতেই হবে।

আহারে! প্রিয় মাটি, ভাই মা আর প্রিয় হিজল গাছ সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে খালার সাথে ঢাকার পথে রওয়ানা হয় সে। খালা শহরে এক বাড়িতে নিয়ে যায় । বিরাট বাসা,মস্ত গেট। নিচে বসার কিছক্ষনের মাঝে মেমসাহেব এল। কি মোটা অবাক হয়ে ভাবে হনুফা। মেমসাহেব বললো,বেশ ভালো ! একে ঘষা মাজা দিলেই আমার কাজে লাগবে।” আমি ওকে দেখে খুশী বলেই খালাকে এক হাজার টাকার চারটি নোট ধরিয়ে দিল।

হনুফা যতই দিন যায় অবাক হয়। কাজ বলতে কিছুই না। মেমসাহেবা কে হাতে পায়ে লোশন মালিশ করে দেয়া, খাবার টেবিলে সাজিয়ে দেয়া আর সাথে মাঝে মাঝে দামি শোপিস গুলো মুছে সাজিয়ে রাখা। মেমসাহেব তাকে দামি শাম্পু স্নো কিনে দিয়েছেন। তিন বেলা ভাল খেতেও পায়। সব মিলিয়ে হনুফা বেশ ভাল আছে। মাস গেলে ছয় হাজার টাকা বেতন দেয়। হনুফাকে একটা ফোনও কিনে দিয়েছে। বিকাশে প্রতি মাসে টাকা পাঠায়। মা ভাইরা খুব খুশি। তনুটা আবার স্কুলে যাচ্ছে।এভাবে বেশ সুখেই দিন কাটছে তার।

একদিন মাসিক হবার দিন থেকে মেমসাহেব একটা রঙিন ছোট ট্যাবলেটের পাতা দিয়ে বললেন প্রতিদিন খেতে। এটা খেলে নাকি শরীরে রক্ত হবে জোর পাবে।এরপর থেকে হনুফা নিয়ম করে খায়। মেমসাহেব তাকে বেশ আদর যত্নই করে। মেমসাহেব তাকে বেড়াতে নেবেন বলে একদিন রেডি করান। একটা বাসায় নিয়ে যান বলেন ‘তুমি থাক আমি রাতে এসে নিয়ে যাবো।’ হনুফা অবাক হয়ে দেখতে থাকে। ঠিক কিছুকাল পরই একজন বিশালদেহী কালো মধ্যবয়সী লোক আসেন। হনুফা অনুনয় বিনয় করেও কোন ছাড়া পায় না। তার জীবনের কাল রাত্রির সূচনা হয়। সন্ধ্যায় মেমসাহেব আসেন হনুফা দৌঁড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। মেমসাহেব পিঠে চাপড় দিয়ে বলেন……… ‘গুড গার্ল।’ শোনো প্রথম দিন তাই কষ্ট পেয়েছ। এটা কিছু নয়। মাঝে মাঝে আসবে। তুমি এর জন্য বেতনের বাইরে বাড়তি টাকা পাবে। হনুফা চিৎকার করে কাঁদতে থাকে।

হনুফা বার বার খালার ফোনে বিষয় টা বলার চেষ্টা করে কিন্তু খালা যেন বুঝেও বুঝতে চান না। বলেন…… ‘একটু অসুবিধা মেনে নে। তোর ভাই দুইটার কথা ভাব।’ অবশেষে মা আসে একদিন দেখতে। মাকে দেখেই মেমসাহেব তার পুরানো দুইটা শাড়ি দেন মিষ্টি ফল খেতে দেন। মা বলে তুই কি সুন্দর হইয়া গ্যাছস আমার মাইয়া মনেই হয় না । মনে হয় তুই এই বাসার ই মাইয়া। হনুফা মাকে খুলে বলে সব। মা যেন বুঝেও বুঝতে চান না। খালি বলেন …………’আর পাঁচটা বছর কষ্ট কর তারপর তোরে নিয়া যামু । ভাই গো কথা ভাইবা নিজেরে না হয় কুরবানি দে হনুফা। ’

হনুফা ভাবে তার কথায় কি মার চোখে কোথাও পানি এসেছিল নাকি মা তার কষ্ট বুঝতে পারলেন না। দিন দিন হনুফা সেই গ্রামের ফুল লতা পাতার সাথী একজন স্থবীর জড় পদার্থে পরিনত হতে থাকে। মাঝে মাঝে মেমসাহেব তার স্বামীর ঘরেও পাঠান । এমন নরক মনে হয় সপ্ত নরকেও নাই। আস্তে আস্তে বাসায় মেয়ের সংখ্যা বাড়তে লাগল। একদিন পুলিশের এক বড় কর্তা এলো, তিনি কিছুক্ষন থেকে মেমসাহেবের সাথে কথা বলে হাসি মুখে চলে গেলেন। পরে জানলো বাসায় থাকা লোকটি মেমসাহেবের স্বামী নন তার কাজের পার্টনার । পুলিশ বাবুও তার কাছ থেকে প্রতিমাসে টাকা পান।

দিন যায় মাস যায় । মাস শেষে কখনো আট হাজার বা দশ হাজার টাকা পাঠায়। মা কি পাষাণ । হনুফাকে বাড়ি নিতেও চায়না। একবছর পর মেমসাহেব অনুমতি দেন বাড়ি যাওয়ার। বাড়িতে যেতেই সবাই তাকে দেখতে আসে। কি সুন্দর চকচক করছে গায়ের রঙটা । চুল গুলো দামী শাম্পুর বদৌলতে যেন রেশমের মত কোমল । হনুফা দেখে মা ভাই তাকে ছাড়া কি খুশী । বাড়ির ঘরটায় নতুন চাল উঠেছে । ভাইদের পরনে নতুন কাপড় , ঘরে চাল ডাল সব অফুরন্ত। হনুফা কে মোট পাঁচ দিনের ছুটি দেয়া হয়েছে । সে দেখল মা ভাইদের খুব একটা তার কাছে ঘেঁষতে দিতে চায়না। মার কাছে মার বুকে একবারটি শুতে চেয়েছিল ঠিক আগের মত মা কেমন গুটিয়ে গেলেন। হনুফা বুঝে গেল মা তাকে মনে মনে অস্পৃশ্যা ভাবে।

হনুফা তার প্রিয় পুকুরপাড়ে গিয়ে বসল। তার কত কথা জমা হয়ে আছে। হিজল গাছটা কেমন যেন বেশী নুয়ে পড়েছে । আর একটু হলেই পুকুরে মিশে যাবে যেন। কেমন ভুতুরে নীরবতা। হনুফাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ঘাটে বসে থাকতে দেখে সবাই বলাবলি করতে লাগল হনুফার উপর জীনের আছর আছে। এই পুকুরে কেউ আসে না। একবার গল্প শুনেছিল গ্রামের এক বউ নাকি এই পুকুরে ডুবে প্রান দিয়েছিল। হনুফার এত ভয় ডর নাই । এমন নিরজন শান্তির জায়গা মনের কথা বলার আর যে নাই। আজ তার ভাই মা কেও তার সাথে আগের মত মিশে না। সবাই কেমন বাড়ির মেহমানের মত ব্যবহার করে।

ঠিক ঢাকা যাবার আগের দিন হনুফা শেষ বিদায় নিতে গেল। হঠাৎ কি মনে করে পুকুরে নামতে লাগল। আস্তে আস্তে আরও গভীরে নেমে যেতে লাগল। আজ সে তার হিজল কে আলিঙ্গন করবে বলে ঠিক করেছে। তার সারা শরীরে অসংখ্য নোংরা আর কাদা মাটির ছাপ । এসব আজ তাকে ধুয়ে ফেলতেই হবে। তাই আরও নামতে নামতে অথৈ পানিতে নেমে গেল। কি ঠাণ্ডা শীতল অনুভুতি। ঠিক মায়ের কোলে যখন শুয়ে থাকত তার মত অনুভূতি। এত ভালোবেসে মা ও যে আর তাকে বুকে টেনে নেয় না।

রাতে যখন হনুফা আর বাড়ি ফিরল না। সবাই খুঁজতে বের হল। হনুফার মা তার দুই ছেলেকে নিয়ে পুকুরপাড়ে আসলেন। দেখলেন হিজল গাছটি ভেঙ্গে পড়েছে আর গাছের ফাঁকে খুব সাদা মত একটা কিছু। কাছে গিয়ে দেখলেন হানুফা যেন শ্বেত পাথরের একটা মূর্তি । কি মায়াময় তার হাসি। মাথার রেশমের মত চুল গুলি হিজল ফুল দিয়ে জড়ানো । যেন এক দুধ সাদা পরী লাল জামা পরে লাল ফুলে জড়িয়ে শান্তিতে ঘুমাচ্ছে।

হনুফার মা কি কাঁদলেন ? তার ভাই দুটি হতবিহবলের মত দাঁড়িয়ে রইল। জীবন যুদ্ধে পরাজিত হয়ে কেউ কাঁদতে পারে কেউ সেই সুখ টিও পায় না। তারা বাইরে সচল হলেও ভিতরে পাথরের মূর্তি হয়ে যায়।

– হালিমা রিমা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *