সম্পর্ক : সমীকরণ

ভদ্রমহিলার সাথে আমার দেখা হয়েছিলো এক বইমেলায়।
আমি তার প্রকৃত নাম না বলি। ধরে নিই তার নাম তাহমিনা।
পরিচিত এক স্টলের সামনে আড্ডা দিচ্ছিলাম বন্ধুবান্ধবের সাথে। একটু পর সেখানে তাহমিনা এলেন। তিনি আমার বান্ধবীর পরিচিতা। বান্ধবী তার সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন।
তাহমিনার চেহারায় উদভ্রান্ত ভাব। মনে হচ্ছে ভীষণ দুশ্চিন্তায় দিনযাপন করছেন।
আমার বান্ধবী তাকে জিজ্ঞাসা করলো, “কী হয়েছে, আপা?”
তাহমিনা স্মিত হেসে বললেন, “কী আর হবে! সংসারটা বোধ হয় টেকাতে পারলাম না!

আমি তাহমিনার দিকে তাকালাম। ভদ্রমহিলা আমাদের চেয়ে বয়সে নয়/দশ বছরের বড় হবেন। সম্ভবত পঁয়ত্রিশ/ছত্রিশ হবে। বেশ সুন্দরী তিনি। এখনো দেখলে মনে হয় পূর্ণযৌবনা। চেহারা ও ভঙ্গিমায় উচ্চশিক্ষার ছাপ স্পষ্ট। ভদ্রমহিলা বইপ্রেমী। মননশীল মানুষ। বেসরকারি স্কুলে শিক্ষকতা করছেন।

একটা সংসার ভেঙে যাবে ব্যাপারটা আমাকে খুব নাড়া দেয়। আমি মানতে পারি না। ভাবলাম ওনার সাথে একটু আলাপ জুড়ি।

তাহমিনার পাশে গিয়ে বসলাম। কথাবার্তা জমালাম। এরপর জানতে চাইলাম কেন সংসার ভাঙছে।

তিনি জানালেন তার স্বামী একটি গার্মেন্টস ইন্ডাস্ট্রিতে আছেন মার্কেটিং সাইডে। উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবার। ওনাদের প্রেমের বিয়ে। চার বছর প্রেম করে বিয়ে করেছেন। সংসার জীবনের এখন নয় বছর চলছে। দুটো বাচ্চা আছে। কী সুন্দর ছিমছাম একটা সংসার!

সমস্যা তাহমিনা যা বললেন, তার বর রুমেল সাহেব তাকে একদমই সময় দেন না। তাকে বুঝতে চান না। দুজনের এক সময় দারুণ বোঝাপড়া থাকলেও এখন দুজনের মধ্যকার মানসিক দূরত্ব ক্রমশ বাড়ছে।

ঘটনা বোঝার চেষ্টা করলাম। বললাম, “সমস্যা মূলত কী নিয়ে?”
তাহমিনা জানালেন, তার বর সারাটা দিন এমনকি সন্ধ্যা পর্যন্ত অফিসে থাকেন। বাসায় এসেও অফিস নিয়ে পড়ে থাকেন। টাকা ছাড়া তার মাথায় কিছুই ঘোরে না। তিনি কী চান তার বর তা বুঝতে চান না।

আমি জানতে চাইলাম, “আপনি কী চান?”
তাহমিনা খানিক থামলেন। বললেন, “আমি চাই সে আমার কেয়ার করুক। দিনশেষে আমার সাথে বসে গল্প করুক। যান্ত্রিক জীবন আমার ভালো লাগে না। বারান্দায় একসাথে বসে একটু চা খাক। আমাকে একটু জিজ্ঞাসা করুক আমি কেমন আছি। রোবটের সাথে কি সংসার করা যায় বলুন?”

“আপনাদের তো নয় বছরের সংসার। এতদিন সব ঠিক ছিলো?”

“বিয়ের পর থেকেই সে কেবল টাকার পেছনে ছুটছে। আর কিছুই না। আমার দিকে ফিরে তাকানোর সময়টাও তার হয় না।” -তাহমিনার চেহারার স্পষ্ট অস্থিরতা। ভীষণ জেদ চেপে আছে ওনার মনে। পারলে এখনই তিনি সংসারটা ভেঙে ফেলেন।

বললাম, “আপা শান্ত হোন। আপনার ছেলেরা নিশ্চয়ই ভালো স্কুলে পড়ছে?”

“হ্যাঁ, ওরা দুজনেই খুব ভালো ছাত্র।”

“তাদের পড়ালেখার খরচ কেমন? ”

“খরচ তো আছেই। স্কুল, টিউটর মিলে বেশ খরচ।”

“সামনে তো নিশ্চয়ই আরো খরচ বাড়বে? নিশ্চয়ই আপনারা অভিজাত এলাকায় থাকেন?”

“হ্যাঁ, তা থাকি।”

“এই যে এত অভিজাত এলাকায় থাকা, ছেলেদের নামী স্কুলে পড়ানো, এই উচ্চমানের জীবনযাত্রা এসবের জন্য টাকা কি গুরুত্বপূর্ণ নয়? আপনার বরের দুশ্চিন্তা কি অমূলক?”

তাহমিনা একটু ভাবলেন। বললেন, “টাকার প্রয়োজন আছে তা আমিও মানি। কিন্তু টাকার পেছনে ছুটে ছুটে জীবনটা উপভোগই করতে যদি না পারি, সে টাকার কি মূল্য? ওকে কিছু বললেই বলে তোমাদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে রাখবো বলে কলুর বলদের মত খাটছি। আর কী চাই তোমার? বলুন এবার, খাওয়াপরার খোঁচা দেয়। সংসার করা যায়?”

আরো আলাপ করার পর যা বুঝলাম, ভদ্রমহিলা চান তার বর তাকে সময় দিক। কিন্তু তিনি এটাও স্বীকার করেন লাক্সারি জীবনের জন্য টাকা প্রয়োজন। তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম আজ যদি তার বরের উপার্জন না থাকতো, তিনি কি তার বরকে মূল্যায়ন করতেন? তাহমিনা এর কোনো ঠিকঠাক উত্তর দিতে পারেন নি। এই জায়গায় আজকালকার সংসারগুলোতে অনেক বড় একটা ঝামেলা হয়।
তাহমিনার বর যেমনটা ভাবেন তা হল স্ত্রী সন্তানকে খাওয়ালে পড়ালেই দায়িত্ব শেষ হয়, তারা সুখে থাকে। মানসিক চাহিদা বলেও একটা চাহিদা যে থাকে তারা তা মাথায় রাখেন না। কেবল টাকার পেছনে ছোটা বরের স্ত্রীরা মানসিক একাকিত্ব থেকে ডিভোর্সের পথে হাঁটেন প্রায়ই, কেউ হয়তো তা করেন না সন্তান আর সংসার বাঁচাতে কিন্তু ভীষণ মানসিক অপ্রাপ্তি নিয়ে দিনযাপন করেন। সন্তানেরাও পিতার স্নেহ, শাসন আর সঙ্গ বঞ্চিত হয়। অনেক সন্তান কোনো কোনো দিন বাবার চেহারাও দেখে না, বাবা ফেরার আগেই ঘুমিয়ে পড়ে। একজন সন্তানের পূর্ণ বিকাশের জন্য তার মায়ের এবং বাবার উভয়ের সান্নিধ্য সমানভাবে প্রয়োজন। কেবল টাকা দিলেই দায়িত্ব শেষ হয় না।

আর তাহমিনার মত অনেক স্ত্রীই যেটা ভুল করেন, বরকে বুঝতে এবং বুঝাতে পারেন না। তারা টাকার জন্য বরের ছোটা মেনে নিতে পারেন না আবার একইসাথে লাক্সারি একটা জীবনও চান। তাহমিনা থেকে জেনেছি তার বন্ধুবান্ধব তাকে উৎসাহিত করেছে সংসার ভাঙার ব্যাপারে। এমন রোবটিক বর নিয়ে সুখী হওয়া যাবে না তাই নিজের মত লাইফ লিড করার পরামর্শ দিয়েছে। বর্তমান যুগে এসবকে আমরা স্মার্টনেস মনে করি। নিজের মত করে বাঁচা, কারো কেয়ার না করা এগুলো এখন খুব স্মার্ট টার্ম।
অথচ এসবই সমাজে ভয়ানক ভাঙন নিয়ে আসছে। আমরা এখন কাউকে ভালো পরামর্শ দেই না। কেউ সংসারে অশান্তিতে থাকলে সেসবে হাওয়া লাগাই, সংসার ভাঙার পরামর্শ দেই। খুব খারাপ এই মানসিকতা।
তাহমিনাকে বললাম, “যে বান্ধবীরা আপনাকে সংসার ভাঙার পরামর্শ দিলেন, নিশ্চয়ই স্ট্যাটাস মেইনটেইন করে তাদের সাথে আপনি প্রায় কোথাও গেট টুগেদার করেন? ”
তাহমিনা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ালেন।
“এক একবার গেট টুগেদারে কেমন খরচ যায়? ডিভোর্সের পর এই বান্ধবীরা আপনার খবর নেবে তো?”

তাহমিনার ভেতরটা ভীষণ রকম ঝড়ে উত্থালপাতাল হচ্ছিলো, তার সেট হয়ে যাওয়া ভাবনা দুমড়ে যাচ্ছে।

তাহমিনাকে বললাম, “আপনার দুটো ছেলে আছে। আমি আপনাকে বলবো না তাদের মুখের দিকে চেয়ে হলেও অসুখী জীবনযাপন করুন। কিন্তু তাদের কথা ভাবুন অন্তত। সংসার ভেঙে ফেলা মানেই সুখ নয়। নিজের মত বাঁচা টার্মটা শুনতে সুন্দর হলেও বাস্তবিক জীবনে এটা একটা ভিত্তিহীন ধারণা।”

তাহমিনা ফিরে গেলেন। ঘটনাটা এক বছর আগের। গেলো সপ্তাহে আমার বান্ধবীর আয়োজন করা এক অনুষ্ঠানে তাহমিনা এসেছিলেন তার পরিবারসহ। আমাকে দেখে খুশীতে তার চেহারা উজ্জ্বল হল। বললেন সেদিন থেকে অন্যভাবে ভেবেছিলেন। ভুল বুঝাবুঝিগুলো মিটিয়ে নিয়েছেন। সেদিন ধৈর্য ধরেছিলেন আমার কথায়, তাই সংসারটা বেঁচে গেছে।

আসলে জীবনে ঠিক কতটা টাকার প্রয়োজন তা আগে দুজনে মিলে ঠিক করে নিতে হয়। অপরিমিত আয় ও অপরিমিত ব্যয় দুটোই ক্ষতিকর। সুখী হতে টাকা যেমন অপরিহার্য, টাকা সুখ কেড়েও নেয়। টাকা দিয়ে সুখ অর্জন করুন, সুখ বিকিয়ে টাকা আনবেন না।

একটা সংসারকে অর্থনৈতিক ভাবে সচল রাখার যে মানসিক দুশ্চিন্তা স্বামীকে করতে হয়, স্ত্রীরা অতটা করেন না কখনো, কর্মজীবী হলেও। স্বামীর সেই অবদানকে সম্মান দিতে জানা উচিত স্ত্রীদের। আবার স্ত্রীকে খাওয়াচ্ছি পরাচ্ছি এই পুরুষালি অহংকারও খুব ক্ষতিকর সংসারে। পরিশেষে একটাই কথা, পারস্পরিক অবদানকে সম্মান করা, পরস্পরকে বোঝা, যেকোনো মানসিক টানাপোড়েনে হুট করে ভাঙনের পথে না হেঁটে ধৈর্য্য ধারণ  করাই একটা সংসারকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে।

-জান্নাতুন নুর দিশা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *