শিক্ষিত পতিতা (৩য় এবং শেষ পর্ব)

পতিতা হওয়া, নাকি ধর্ষিতা হওয়া- কোনটি বেশি খারাপ?, আমার দিকে প্রশ্নবান ছুড়ে দিলেন সুনয়না।

আমি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললাম, পতিতাবৃত্তিতে স্বেচ্ছায় শরীর দিতে হয়। মনের বিরুদ্ধে হলেও দিতে হয়। কেননা, এর উপর জীবিকা নির্ভর করে।
কিন্তু, ধর্ষণে জোরপূর্বক মিলিত হয়। ইচ্ছার কোন প্রশ্নই আসেনা।
পতিতাবৃত্তিতে একজন নারী পুরুষের শরীরের স্বাদ মেটায়। ধর্ষণে অনিচ্ছায় হয়, এবং পরবর্তীতে সে পুরুষের শরীরের স্বাদ মেটানোর জন্য বাধ্য হয়। তার কাছে যেয়ে সবাই শরীরে স্বাদ মেটাতে পারবেনা।
তাই, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ সুবিধাবাদের জন্য পতিতাকে ধর্ষিতার চেয়ে উপরে সম্মান দিয়েছে। কেননা, একজন পতিতাকে যে ক’জন চিনে, একজন ধর্ষিতাকে তার চেয়ে বেশি মানুষ চিনে। এবং পতিতাকে নিগ্রহ করার স্থান নেই; কিন্তু ধর্ষিতার চরিত্র নিয়ে প্রশ্ন তুলে বারবার তার জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করা হয়।

সুনয়না স্মিতহাসি হেসে বললেন, ঠিক বলেছো। পতিতা হওয়াটা যতটা অসম্মানের, তারচেয়ে বেশি অসম্মানের ধর্ষিতা হওয়া। পতিতাকে কেও মেরে ফেলতে প্ররোচনা দেয়না; কিন্তু ধর্ষিতাকে প্ররোচনা দেয় আত্নহত্যার।

পতিতা হওয়ার পর আমি যতটা কষ্ট পেয়েছি; তারচেয়ে বেশি পেয়েছি ধর্ষিত হবার পর। আমার অপরাধ কি ছিল? ধর্ষিত হওয়া? না কি ধর্ষিত হবার পর বেঁচে থাকা? সম্ভবত ধর্ষিত হবার পর বেঁচে থাকাই ছিল আমার অপরাধ।
উঠতে বসতে কথা শুনতাম। চরিত্র নিয়ে কথা উঠতো। বলা হতো, আমি ইচ্ছা করেই ধর্ষিত হয়েছি। আমি ওদের উত্তেজিত করেছি।

এসব শুনতে শুনতে মন দিনকে দিন দুর্বল হয়ে যাচ্ছিলো। এরকম চলতে থাকলে সম্ভবত আমার আর বেঁচে থাকা হতোনা। এসব কথা শোনার মাঝে একদিন বাংলা বিভাগের সভাপতি আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমি ভয়ে ভয়ে পা টিপে টিপে তার রুমে ঢুকলাম।
তিনি আমাকে দেখে বললেন, কি হে তোমাকে এখান থেকে বের করতে পারলোনা, দেখে কি শেষ অস্ত্র ব্যবহার করলো?
আমি বললাম, জানিনা স্যার।
উনি তখন আমাকে বললেন, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বন্দী করার শেষ অস্ত্র হলো ধর্ষণ। মনে করা হয়, ধর্ষণ করতে পারলে একটা মেয়ে চুপসে যাবে মান সম্মানের ভয়ে। কিন্তু, মেয়েটা প্রতিবাদী হয়ে মাথা তুলে দাঁড়ায়, তাহলে তার আর কোন বাঁধা থাকেনা। কেননা, মান-সম্মানের ভয়ে যে লেবাসটা থাকে সেটা আর ধারণ করা লাগেনা। নিজের মতো করে বেড়ে ওঠা যায়।
আর, মোক্ষম অস্ত্র ব্যবহার করে জয়ী না হতে পারলে প্রতিপক্ষ পরাজয় মেনে নেয়। এখন, তুমিই ঠিক করে কি করবা। মোক্ষম অস্ত্র ব্যবহৃত হয়েছে। তুমি পরাজয় স্বীকার করবা নাকি জয়ী হবা?
আমি নত শিরটাকে উন্নত করে বললাম, জয়ী আমাকে হতেই হবে।


স্যারের ওখান থেকে আসার পর আমাকে আর কেউ বিচলিত করতে পারেনি। আমি এগিয়ে গেছি আপন লক্ষ্যে। টিউশন, মেস সব ছাড়তে হয়েছিলো আমাকে। আবার, নতুন করে সব শুরু করি। মানুষের কথায় বিচলিত না হয়ে আমি লক্ষ্যে এগিয়ে যাই। দেখতে দেখতে আমার অনার্স জীবনের সমাপ্তি ঘটে।

এবার কি দিবো? বিসিএস? না,উচ্চশিক্ষার জন্য বাহিরে। এতদিনে যা পরিস্থিতির শিকার হয়েছি, তাতে বুঝতে পারলাম এদেশের সরকারী চাকুরী আমার কখনো হবেনা। আমাকে এমন কোথাও যেতে হবে যেখানে আমার অতীত নিয়ে কেউ মাতামাতি করবেনা। সুতরাং, বাহিরে যাওয়াটাই শ্রেয়।

টানা ৬ মাস আমি প্রচুর কষ্ট করেছি। পূর্বের জমানো টাকা আর নতুন করে টিউশন। পাশাপাশি পড়ালেখা। সবমিলিয়ে প্রতিদিনই খুব ক্লান্ত থাকতাম। তারপর, যখন স্কলারশিপ নিয়ে আমেরিকায় যাওয়ার ভিসা হাতে পেলাম, আমার মনে হলো, অবশেষে আমি অতীতটাকে ছাড়তে পারছি।

এটুকু বলে দম নিলেন সুনয়না। তারপর, একটু আসছি বলে উঠে গেলেন। আমি তার চলে যাওয়ার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম। আর ভাবতে লাগলাম,

মানুষের ভেতরে কত লুকায়িত শক্তি আছে তা মানুষ নিজেও জানেনা। আবার, এটাও ঠিক সেই শক্তিগুলো বিকশিত হওয়ার সময় বাঁধা দেওয়ার জন্যে মানুষের অভাব হয়না।
কিন্তু, যারা এই বাঁধার চৌকাঠ পেরিয়ে এগিয়ে যায় তারা একেকটি উদাহারণ তৈরি করে। তখন আমরা তাদের মাথায় নিয়ে নাচি। কিন্তু, শুরুতে যখন লড়ছিলো তখন আমরাই তাকে আটকে দিতে চেয়েছি।
এই বাঁধার চৌকাঠে আটকে গিয়ে কত শত মানুষের অপমৃত্যু হয়েছে, তা আমরা নিজেরাও জানিনা। টেনে ধরে প্রতিভাকে নষ্ট করে আবার তাচ্ছিল্য করেছি। কেন করেছি? কারণ, আমরা ব্যতিক্রম করতে পারিনি, তুমি কেন করবা? পরশ্রীকাতরতায় ডুবে গিয়ে মিশে গেছি প্রতিভামৃত্যুর লীলাখেলায়।

হলফ করে বলা যায়, পৃথিবীর পূর্ব প্রান্তে যদি প্রতিভা মৃত্যুর জন্য শাস্তি দেওয়া হয়, একটি মানুষও আর জীবিত থাকবেনা। প্রতিটি মানুষকে ফাঁসিতে ঝুলতে হবে।

ভাগ্য ভালো, পৃথিবীতে প্রতিভা হত্যার জন্য কোন শাস্তির বিধান করা হয়নি!


যেই অতীত ছেড়ে চলে আসার জন্য এত কিছু, সেই অতীত’ই আবার ফিরে এলো। অবশ্য এবার আমি’ই ফিরিয়ে এনেছি। যাওয়ার আগে ভাবলাম পরিবারের সাথে দেখা করে আসি।

সেই পরিবার, যে পরিবার থেকে আমাকে বের করে দেওয়া হয়েছিলো।

সুনয়নার কথাগুলো আমাকে বিস্মিত করলো। আবার সেই পরিবার? মুখ থেকে ছিটকে বেরিয়ে গেলো কথাটি।

সুনয়না হেসে বললেন, হ্যাঁ। তবে জানো, এবার এই পরিবারই আমার অতীতকে ফেলে দিতে সাহায্য করেছে।

কিভাবে?

সুনয়না ভনিতা না করে বলা শুরু করলেন, রহিমের কারণে বাবা-মা আমার অবস্থা জেনেছিলো। তাদের মনের মধ্যে বড় অপরাধবোধ কাজ করছিলো। যার ফলাফল আমার সামনে আসতে পারেননি। বাবা আমার জন্য অল্প কিছু টাকা জমিয়ে রেখেছিলো। মাকে বলেছিলো আমি কখনো ফিরে আসলে টাকাগুলো যেন আমাকে দেয়। আর, যদি না আসি তাহলে কোথাও যেন দান করে দেয়।

আমি ফোঁড়ন কেটে বললাম, মাকে দিলেন কেনো? বাবা নিজেই তো দিতে পারতেন?

আমি অবাক না হয়ে পারলাম না। ঢোক গিলে বললাম, মাকে দিলেন কেনো? আপনার বাবা নিজেই তো দিতে পারতেন।

সুনয়না একটু চুপ থেকে বললেন, বাবা মৃত্যুর আগে কথাগুলো মাকে বলে গিয়েছিলেন।

বাবা আমাকে প্রচন্ড ভালোবাসতেন। আমি জানি, তিনি এই অপরাধবোধের কারণেই মারা যান।

আর তার প্রায়শ্চিত্তের অর্থগুলোই আমাকে বোস্টনে যেয়ে প্রথমে বিপদে পড়ার হাত থেকে রক্ষা করে।

এটুকু বলে থামলেন সুনয়না। একটি সিগারেট ধরালেন। তারপর, আমার নীরবতা দেখে আবার বলা শুরু করলেন,
জানো যেই বাবা ধর্মের প্রতিটা নিয়ম মেনে চলতেন, সেই বাবা মাকে বলে গিয়েছেন, আমি যেন আমার মন মতো চলি সবসময়।

তারপর, আর কি। বোস্টনে মাস্টার্সের পাশাপাশি কাজ। এরপর সেখানে এক ছেলের সাথে প্রণয়। প্রণয় থেকে বিয়ে। কিন্তু, ছেলেটা বহুগামী ছিলো। আমারো শরীর নিয়ে বাছ বিচার ছিলোনা। বারে যেতাম। ড্রিংক করতাম। সেখানে পছন্দ হলে মিলিত হয়েছি। আবার পরেরদিন স্বামীর সাথেও শুয়েছি।

জানি, পৃথিবীর পূর্ব প্রান্তরে এটি জঘন্য অপরাধ। কিন্তু, পশ্চিমে অতি স্বাভাবিক। পশ্চিমে অপরাধ হলো জামাইকে না জানিয়ে শোয়া। তবে, সবার ক্ষেত্রে না। একগামীদের ক্ষেত্রে অন্যের সাথে মিলিত হলে সম্পর্ক থাকেনা। তবে, সেটা মিউচুয়ালি ভেঙে যায়।

এটুকু বলে সুনয়না চুপ হলেন। তারপর বললেন, কি হে, আমার স্বামীকে খারাপ ভাবছো?

আমি স্মিত হেসে বললাম, না। একেকটি সম্পর্ক একেক রকম।
যতটুকু সময় সাথে থাকা হয় ঠিক ততটুকু সময়কে সত্য ধরে, অতীত ভবিষ্যৎ ভুলে চলতে থাকে কিছু সম্পর্ক। আপনাদের সম্পর্কটি ঠিক তেমন।

সুনয়না কিঞ্চিত বিস্মিত হয়ে বললেন, ঠিক ধরেছো। তারপর বললেন, জানো, আমাদের সম্পর্ক এখন আর নেই।
আমি স্বাভাবিক গলায় বললাম, হ্যাঁ জানি। প্রতিটা সম্পর্ক একসময় পুরানো হয়ে যায়। পুরানো হয়ে যাওয়ার পর সেই সম্পর্কে যতটা না ভালো লাগা থাকে, তারচেয়ে বেশি থাকে অভ্যেস আর দায়বদ্ধতা। আপনাদের সম্পর্কে অভ্যেস যেমন নেই, দায়বদ্ধতাও নেই। তাই আপনারা আর সাথে থাকেননি।

সুনয়না এবারো খানিকটা অবাক হলেন। তারপর বললেন,
পিএইচডি শেষ করার পর আমি ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার সুযোগ পাই। কিন্তু, আমার ইচ্ছে ছিলো বাংলাদেশে ফিরে আসার। তাই, তিনবছর সেখানে শিক্ষকতা করার পর ঢাবিতে অ্যাপ্লাই করি। এবং আমি ডাকও পাই। যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমাকে বের করে দেওয়ার কথা ভাবা হয়েছিলো সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি শিক্ষক হিসেবে ফিরে আসি।

তারপর থেকে এই ফ্ল্যাট, এই পাঠাগার, এই বিশ্ববিদ্যালয়, এই সিগারেট- আমার নিত্যদিনের সঙ্গী।

সুনয়নার জীবনের গল্প শেষ হওয়ার পর আমি সেদিনের মতো বিদায় নিয়ে চলে আসি। নারী সমাজের প্রতিটি পদে পদে বাঁধা থাকায় অনেকে মাঝপথে হার মেনে নেয়। তাদেরকে অনুপ্রাণিত করতে লিখতে চেয়েছি এই লেখা। কিন্তু, দুর্ভাগ্য যেই সাহসটা সুনয়না দিয়ে গিয়েছিলো, তা তিনিই নষ্ট করে দিয়েছিলেন। কেননা, এই কথোপকথনের চার মাস পর সুনয়না আত্নহত্যা করেন। জীবনযুদ্ধে যিনি সবচেয়ে বেশি আঘাত প্রাপ্ত হয়ে লড়ে গেছেন; তিনিই সবকিছু পেয়ে আত্নহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন।

চারদিকে প্রশ্ন দলা পাকাচ্ছিলো, সুনয়না কেন আত্নহত্যা করবে? তিনি খুন হননি তো? তাকে খুন করে আত্নহত্যা বলে সাজানো হয়নি তো?

এসব বিতর্কে যেতে না গিয়ে আমি আমার মতো করে বুঝে নিয়েছিলাম।

যে নিঃস্ব, যে সবকিছু হারিয়ে ফেলে, সে হয় হারিয়ে যায়, নাহয় সারাটি জীবন পাওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু যে সবকিছু হারিয়ে ফেলে সবকিছু পেয়ে যায়, তার পাওয়ার জন্যে কঠোর সংগ্রাম পাওয়া হয়ে গেলে সমাপ্ত হয়। তখন, ভোগ ছাড়া আর কিছুই থাকেনা। কিন্তু, সে সংগ্রাম করতে করতে এতোটাই অভ্যস্ত হয়ে যায় যে ভোগে সে সুখ পায়না।

সুনয়না সবকিছু পাওয়ার জন্য সংগ্রাম করেছিলেন। তারপর সব পেয়ে গেলেন। পাওয়ার পর তার আর কোন সংগ্রাম বাকী নেই। যার ফলাফল ভোগে সুখ পাচ্ছিলেন না। বেঁচে থাকার জন্য কিছু খুঁজছিলেন। কিন্তু, কিছুই আর বাকী নেই। আর এই নেইটা তাকে শূন্য করে দিয়েছিলো। শূন্যে সে এতোটাই বিষণ্ণ হয়ে গিয়েছিলেন যে তার আর বেঁচে থাকার ইচ্ছেটাই চলে যায়। যার ফলাফল, আত্নহনন।

আত্নহননের কারণে সুনয়না উদাহারণটা ফিকে হতে পারে। কিন্তু, তার জীবন সংগ্রাম তো মিথ্যে হতে পারেনা। এই সংগ্রাম প্রতিটা সংগ্রামী নারীর মাঝে সংগ্রামী মানসিকতাকে আরো শক্তি দিবে। এগিয়ে যেতে সাহায্য করবে। তাই, সুনয়নাকে নিয়ে আমি লিখতে বসলাম।

জানি, এই গল্পের জন্য আমাকে অনেক কথা শুনতে হবে। কাঁচা হাতে এরকম লেখার জন্য অনেক ভুলও বের হবে। তারপরও, এই কাঁচা হাতের লেখায় কেও যদি অনুপ্রাণিত হয়, তবে সেটা আমার এবং সুনয়না দু’জনেরই প্রাপ্তি। তবে, প্রাপ্তির খাতাটা আমার চেয়ে বেশি সুনয়নারই প্রাপ্য।

 

-জিসান রাহমান

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *