লাল শাড়ী ( অণুগল্প )

শাড়ীটা লাল। জরির কাজ করা চওড়া পাড়।এই শাড়ীটা এই নিয়ে পাঁচবার পরলো কুসুম। চাচীর এই একটাই ভাল শাড়ী। প্রতিবার এই শাড়ীতে সেজে পাত্রপক্ষের সামনে বসে কুসুম। ইচ্ছে হয় কুঁচি কুঁচি করে কেটে ফেলতে শাড়ীটা। খাওয়া দাওয়া আর প্রশ্নোত্তর পর্ব শেষে ঘরে ফেরে কুসুম। তারপর শুরু হয় অপেক্ষা কোনো খবর আসে না!

কোরআন শরীফ পড়তে পারো? পরিচিত প্রশ্ন।মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানায় কুসুম। সুরা ফাতিহার অর্থ বলো তো.. এটা কমন প্রশ্ন নয়। কুসুমের মাথা নুইয়ে পড়ে লতানো পুঁইয়ের ডাঁটার মত। কি লজ্জা! কি লজ্জা!
বাবার অসহার মুখটা লাল নয়, বেগুনি হয়।
পর্দার আড়াল থেকে মায়ের দীর্ঘতম শ্বাস ছুঁয়ে দেয় কুসুমের এই দীনতা!

পান চিবুতে চিবুতে ছেলের বাবার হাসিমুখে খেলে যায় নিঠুর রঙধনু।
মেয়ে তো কিছুই পারে না। গায়ের রংও তো একেবারে পাঁকা!
আমার ছেলে আজকাল রাজনীতি করে, ফেসবুক আর ইমো চালায়। মানাবে না একদম…. ঢেঁকুরের শব্দ শোনা যায়।

কুসুমের বাবা কোনো কথা বলে না। দিনমজুরের একদিনের রোজগার পানিতে গেলো। কুসুমের উপর খুব রাগ হয়। একটু ফর্সা হলে কি হতো!

তবে আমি ছেলেকে রাজী করাবো। যদি..
কুসুমের বাবা উৎসুক চোখে বলে… যদি…
…. ছেলেকে ব্যবসার জন্য দুই লাখ টাকা, টিভি,ফ্রীজ, মোবাইল দিতে হবে।
আর মেয়েকে তো সাজিয়ে দিতেই হবে… আরেক খিলি পান ঠেসে দেয় মুখে।

কুসুমের আনত চোখে তখন বারুদের হল্কা। বাবার মুখটা গনগনে আগুনে পুড়ছে। লাল শাড়ীটা খুব ভারী মনে হয়। মায়ের অসহায় মুখটা ঝাপসা দেখা যায়। ছোট বোনের কচি কচি হাত… কুসুমকে জড়িয়ে ধরে।
কোরআন শরিফের সূরা ফাতিহার অর্থ না জানার অপরাধে কুসুমের দরদাম এমনটি….
গায়ের রং ফর্সা নয়… তাই চাহিদার পরিমান বেশ বড়।

ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায় কুসুম।
…. বাবা আপনার ছেলেকে কিচ্ছু দিবে না… কিচ্ছু না! হাঁপাতে হাঁপাতে বলে কুসুম। লাল শাড়ীর ঘোমটা বেঁকে ঝুলে গেছে।
…. আপনার ছেলেকে আমি বিয়ে করবো না।
আপনারা যেতে পারেন এবার।

বাবা হায় হায় করে ওঠে।
…. ওরে কুসুম! তুই কি পাগল হলি?
আপনারা বসেন… বসেন। মেয়ে আমার ছোট।কি বলতে কি বলেছে!
কুসুম বাবার হাত ধরে…. বাবা আমি বিয়ে করবো না। এভাবে আর আমাকে দরদামে এনো না।

সেই যে কুসুম ঘরের খিল এঁটেছে। এত ডাকাডাকিতেও খুলছে না। ভাঙা আয়নাটা হাতে নিয়ে বসে আছে কুসুম। কুসুমের চোখ থেকে আগুন গড়িয়ে পড়ে…..
জল নাই চোখে…. তীব্র এক ঘৃনার শিখা।
বলা হয়নি কুসুমের…. ছেলেটা দেখতে লম্পটের মত! ছেলেদের এসব কথা বলতে নেই।

নদীর পাড়ে মানুষের জটলা। কুসুমের বাবার লাশ ভেসে উঠেছে সকালে। অপয়া মেয়েটার জন্য বাবাটার জান গেলো।
দরজার খিল খুলে বাইরে আসে কুসুম। বাবাকে দেখতে যায় না। একটু পর পুলিশ আসবে। ময়নাতদন্ত হবে।
কুসুম অনির্ণীত পথে হাঁটে আর হাঁটে!

রোজরাতে নতুন নতুন মানুষ আসে এ পাড়ায়। কুসুমের ঘর কখনো খালি থাকে না। শরীরের পোক্ত গাঁথুনী থাকলে এ পাড়ায় গায়ের রং কেউ দেখে না….
কুসুম এখন সূরা ফাতিহার অর্থ জানে!

-ফারহানা নীলা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *