মাছের ঝোল

জাহাঙ্গীর নগর ইউনিভার্সিটি থেকে একটা কাজ সেরে ফিরছিলাম। ঢাকাগামী একটা বাসে উঠে বসলাম। অনেককে দেখি জানালার পাশের সিটে বসতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। অথচ আমি আইল সাইডে। জানিনা কেনো। হয়তো অভ্যাস। একটু পর আমার পাশে একজন ভদ্র মহিলা চোখের চশমা ঠিক করতে করতে বসলেন। বসার ভঙ্গি বলে দিল উনি একজন শুচিবায়ু গ্রস্থ মহিলা। এরপর কি বলবেন আমি অনুমান করে একটু সরে বসলাম। কারন কোন ভদ্রমহিলা যদি বলেন একটু সরে বসেন তো! সেটা কিন্তু চরম অপমানের। এটাকে অনুবাদ করলে দাঁড়ায় আপনার ঘরে কি মা বোন নেই! উনি এরকম কিছু বললেন না। তবে মুখটা হাসি হাসি করে বললেন আচ্ছা আচ্ছা ঠিক আছে। এরপর আমার অনুমান সঠিক প্রমাণ করতে বললেন ইশ.. বাসের সিটগুলো এত ছোট আর নোংরা!

দুপুরের কড়কড়ে সূর্য একটু হেলে পড়তে শুরু করেছে। রাস্তায় থেকে থেকে জ্যাম।

ভদ্রমহিলা আমাকে চমকে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন তুমি কোথায় যাবা?

প্রথম দর্শনেই কেউ তুমি করে বলে এরকমটা ঠিক মেনে নেয়া যায় না। বললাম ঢাকায় ফিরছি।

বললেন সে তো আমিও ফিরছি। তুমি কি পড়?

এখন বুঝতে পারলাম তিনি কেন তুমি করে বলছেন। সম্ভবত ভেবেছেন আমি ইউনিভার্সিটি থেকে ফিরছি।

বললাম পড়ি না। আমি লিখি টুকটাক। আর আমাকে তুমি করে বলাটা পছন্দ হচ্ছে না। হতে পারেন আপনি সিনিয়র কিন্তু আমিওতো কম না।

এ কথায় উনি হেসে ফেললেন। বললেন আমি শিক্ষক মানুষতো। তাই ছেলে পেলে দেখলেই তুমি করে বলে ফেলি।

আচ্ছা ঠিক আছে বলেই যখন ফেলেছেন তখন আর আপত্তি করবো না।

ভদ্রমহিলা এবার বললেন আচ্ছা তুমি কি লিখ? মানে গল্প উপন্যাস?

বললাম না না সেরকম কিছুনা। ফেসবুকে স্ট্যাটাস লিখি।

তিনি হেসে ফেললেন। বললেন তুমি বেশ মজার। আচ্ছা শোন। তোমাকে একটা গল্প শোনাই। যেহেতু তুমি লেখক। মনে হচ্ছে তোমাকে শোনানো যায়।

আমি ভালো শ্রোতা হিসেবে তাকে আশ্বস্ত করলে তিনি বলা শুরু করলেন।

আমি সাভার যুব উন্নয়নে চাকরি করি। ঢাকায় থাকি। হাজব্যান্ড বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। এক ছেলে এক মেয়ে। স্কুলে পড়ে। এক শীতে বড় বড় দেশী কই মাছ খুব মজা করে রান্না করে অফিসে চলে গেলাম। সেদিন বেশ খিদেও পেল। যাকে বলে বাঘের খিদে। ফেরার পথে বাস ধরলাম। বাসে উঠে মনে হল বাসায় গিয়ে খুব মজা করে কই মাছের তরকারি দিয়ে ভাত খাব। এরকম ভাবতে খিদেটা আরো বেশি জেঁকে ধরলো। আর ঠিক তখনই বাসটি দুর্ঘটনায় পতিত হলো। তিন দিন সেন্সলেস হয়ে হাসপাতালে পড়ে ছিলাম। মাথায় ইনজুরি ছিল। সৌভাগ্যক্রমে সেই যাত্রায় বেঁচে যাই। মানুষের জীবন কেমন অদ্ভুত তাই না!

আমি তার বর্ণনা শুনে স্পষ্ট ভিজুয়ালাইজ করতে পারছিলাম পুরো ঘটনাটি। এখন তার চোখের চিকমিক দেখে বুঝতে পারছি বেঁচে থাকাটা আসলেই সুন্দর। বললাম আপনার গল্প বলা শেষ?

উনি বললেন না শেষ হয়নি। আরো আছে।

এই দুর্ঘটনাটা যতোটা না আমায় ভাবিয়েছিল তারচে বেশি ভাবিয়েছিল কই মাছ দিয়ে ভাত খাওয়ার ব্যাপারটা। আমার কিন্তু সেই কই মাছ দিয়ে আর ভাত খাওয়া হয়নি। একটা কুসংস্কার মনে নিয়ে কিছুদিন সকালে রান্না করা বাদ দিলাম। তারপর একদিন ছেলে বলল আম্মু ঝাল করে মুরগী রান্না করতো। খেতে ইচ্ছে করছে। আমি যথারীতি রান্না করে ছেলের জন্য ডাইনিং এ সাজিয়ে রেখে সকালে অফিসে গেলাম। সারাদিন কাজের মধ্যে কিছু মনে হয়নি। ফেরার পথে বাস ধরতেই মুরগীর মাংসের সেই ঘ্রাণ যেন আমি পেলাম। ক্ষুধাটাও জোর জানান দিল। আমার মনে হতে লাগলো বাসায় গিয়ে মুরগীর ঝোল দিয়ে মজা করে ভাত খাচ্ছি। ঠিক এরপরেই আমাদের বাসটি একটি ট্রাকের সাথে ধাক্কা লাগিয়ে রাস্তার পাশে একটি কৃষ্ণচূড়া গাছের গায়ে কাত হয়ে পড়ে থাকলো। আমার হাতে পাঁচটি সেলাই পড়ল। সেই যাত্রাতেও প্রাণে বেঁচে গেলাম।

এ পর্যন্ত বলে তিনি থামলেন। তার চোখেমুখে দ্বিতীয়বার বেঁচে যাওয়ার চিকচিক আভা। বললেন মানুষের জীবন আসলেই বিচিত্র। তাই না!

আমি গল্পের সত্যতা যাচাই করতেই হয়তো কিছু খুঁজছিলাম। তার বাম হাতে কাঁটা দাগ দেখে নিশ্চিত হলাম। গল্প মিথ্যে নয়।

বললাম আপনার গল্প শেষ?

বললেন হয়তো শেষ নয়তো নয়।

আপনার কথা বুঝিনি। আরো আছে! তাহলে বলুন।

তিনি প্রচণ্ড ঘামছেন। ভয়ার্ত কণ্ঠে বললেন আমার এতক্ষণ মনে ছিল না। আজ সকালে আমি বড় বড় চিংড়ি মাছ ভুনা করে রেখে এসেছি। আর এখন আমার বেশ ক্ষুধা পেয়েছে!

তার এই কথা শুনে আমি বসা থেকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। কী ভয়ংকর কথা! আমি দেখলাম শুধু আমি না বাসের সব লোক দাঁড়িয়ে পড়েছে আর সবাই চিৎকার করছে। বাসটির ব্রেক কাজ করছে না!

-জামান একুশে 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *