মাই এক্স (৭ম পর্ব)

বাসায় যখন পৌঁছলাম, তখন রাত প্রায় আটটা। শাহেদই দরজা খুলল। আমার চেহারা দেখেই বুঝল, ভয়ংকর কিছু হয়েছে। মুখ একেবারে ফ্যাকাশে হয়ে ছিল। দরজা খুলেই ও আমাকে আগলে নিল। এরপরে ধরে ধরে আমাকে লিভিং রুমের সোফায় বসাল। আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। বোঝার চেষ্টা করল, এখনই সবকিছু জানতে চাইবে কি না। এরপরে কি মনে করে লিভিং রুম লাগোয়া ডাইনিং রুমে গেল। এক গ্লাস পানি ঢেলে নিয়ে এল।

এতোটা অফ ব্যালেন্স যে আমি হব, স্বপ্নেও ভাবিনি। এর একটা কারণ বোধহয়, সুমনের পুরনো স্মৃতি। ও সব ক্যালকুলেশান করে মাঠে নামে। আর যাকে শেষ করতে চায়, তাকে করে ছাড়ে। প্রথম দিকে ভেবেছিলাম, আমাকে কিভাবে শেষ করবে। সহজ যে উত্তরগুলো মাথায় এসেছিল, তা ছিল, শাহেদের কাছে আমাদের রিলেশানের ডিটেলস জানানো। সব শুনে শাহেদ আমাকে ঘৃণা করবে। হয়তো আমাকে ডিভোর্সও করতে পারে।
টার্মিনেশান লেটারের খেলাটা দেখবার পরে বুঝতে পারি, ও রিসার্চ করেই মাঠে নেমেছে। শাহেদ কেমন মানুষ, সেটা ও জানে। পুরনো কাহিনী শুনিয়ে শাহেদের মন বিষাতে যে পারবে না, সেটা ও বুঝে গিয়েছিল। তাই অন্য পথ ধরেছে। কেন যেন মনে হচ্ছে ওর আল্টিমেট চাওয়া হচ্ছে, ওর পায়ে পড়ে ক্ষমা ভিক্ষা করি। যেন আমি বলি, আমি তোমার সাথে অনেক অন্যায় করেছি, আমাকে ক্ষমা করে দাও।
মনে মনে আমি স্যরি ছিলাম না, এমন না। খুব সাধারণভাবে যদি দেখা হত, আমি সত্যিই হয়তো ওকে স্যরি বলতাম। কিন্তু এভাবে আমাকে বাধ্য করার চেষ্টা, কেন যেন মনটা বিষিয়ে দিল। একটা জেদ তৈরি হল। ওর কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করব না। আমার যত ক্ষতিই ও করুক, সহ্য করব।
আমাকে অসহায় করার প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে ও শাহেদের চাকরী নট করিয়েছে। যদি ভুল না করি, এরপরে হয়তো নতুন চাকরী পেতে বাধা দেবে। ব্যাবসা করতে চাইলেও, পদে পদে ঝামেলা করবে। প্রাইম মিনিস্টারের অফিসে আছে, সো ওর একটা ফোন এখন অনেক ক্ষমতা রাখে।
ব্যাপারটা যখন শাহেদকে বললাম, ও তখন একটাই কথা বলল,
— দেখা করতে তো যাচ্ছই, নিজের কানেই শোন, কি বলতে চায়। শুধু শুধু গেস করছ কেন?
কথাটা মেনে নিতে গিয়েও মেনে নিতে পারলাম না। বললাম
— গেসটা করছি, কারণ প্রিপেয়ার্ড থাকতে চাইছি।
শাহেদও দেখলাম ব্যাপারটা মেনে নিল। কিছুক্ষণ ভেবে বলল
— যদি সত্যিই তেমন হয়, কানাডা বা অস্ট্রেলিয়াতে ইমিগ্রেশান ট্রাই করব। ওখানে আত্মীয় স্বজন আছে, হেল্প লাগলে, করবে আই থিংক।
শাহেদের কথাগুলো শুনে কিছুটা আস্বস্ত লাগলেও, পুরোপুরি সাহস পাচ্ছিলাম না। কেন যেন মন বলছিল, সুমন এতো সহজে আমাকে ছাড়বে না। যাওয়ার পথে পুরো রাস্তা তাই দোটানায় কেটেছিল, ক্ষমা চেয়ে নেব কি না। মনে এক অংশ বলছে, না। এভাবে জোর করলে, কখনই রাজী হওয়া উচিৎ না। মনের আর এক অংশ বলছে, এই সাইকোপ্যাথের সাথে কোন রকম ডুয়েলে যাওয়া বোকামী ছাড়া আর কিছু হবে না। আত্মসম্মানে লাগবে, বাট, ব্যাপারটার একটা হেস্তনেস্ত তো হবে। ঝামেলাটা ঘাড় থেকে তো অন্তত নামবে।
মনের কোনে আরও একটা সম্ভাবনার কথা ভেবেছিলাম। শাহেদকে ডিভোর্স দিয়ে ওকে বিয়ে করতে বলতে পারে। এভাবে প্রতিশোধ নেয়াটা সুমনের সাথে যায় না। সো, যদিও সম্ভাবনা কম, তারপরও হতে পারে। আর তেমন কিছু বললে, সোজাসুজি ‘না’ বলব। এই সম্ভাবনার কথাটা অবশ্য শাহেদকে বলিনি।
এসব চিন্তায় হয়তোবা বেশি মগ্ন ছিলাম, তাই সুমন কখন এসে সামনে দাঁড়িয়েছে, লক্ষ্য করিনি।
— কি ভাবছো?
চমকে উঠে সামনে তাকালাম। সুন্দর একটা পাঞ্জাবি পড়ে এসেছে সুমন। অ্যাজ ইউজুয়াল, লুকিং গর্জিয়াস। ঠোঁটে স্মিত হাসি। এতোটাই হতচকিত হয়ে গিয়েছিলাম যে মুখে কোন কথা আসছিল না। অবাক হয়ে ওর দিকে তাকিয়েছিলাম। সেই হতবাক চেহারার দিকে তাকিয়ে আবার জানতে চাইল
— কিছু অর্ডার করেছো?
মন্ত্রমুগ্ধের মত উত্তর দিলাম
— না।
ইশারায় ওয়েটারকে ডাকল। এরপরে আমার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল
—আগের মত?
সুমনের এই সাবলীল ভাব দেখে সত্যিই আশ্চর্য্য হয়ে যাচ্ছিলাম। এতো কিছুর পরেও কোন গ্লানি নেই এই মানুষটার? এমনভাবে কথা বলছে যেন কিচুই হয়নি। আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝল, আমি এখনও হতবাক ভাব কাটিয়ে উঠতে পারিনি। তাই নিজেই দুটো কফি বলল। এরপরে আমার দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে বলল
— হোয়াট হ্যাপেন্ড?
সুমনের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলাম। নিজেকে সামলে নেয়ার আপ্রাণ চেষ্টা করছি। কিছুটা সময় নিয়ে উত্তর দিলাম
— কিছু না।
এরপরে সুমনের দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসি দিয়ে জানতে চাইলাম
— কেমন আছ?
উত্তরে আমার দিকে খানিক্ষণ তাকিয়ে থাকল সুমন। এরপরে টিপিক্যাল প্রেমিকের মত আবেগঘন কন্ঠে বলল,
— সুন্দর লাগছে।
এখন অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে এসেছি। দ্রুত ভাবছি। মূল আলোচনায় আসব, না প্রাথমিক ফর্মালিটি যেভাবে চলছে, সেভাবে আরও কিছুক্ষণ চলতে দেব। দ্বিতীয়টা করব সিদ্ধান্ত নিলাম। স্মিত একটা হাসি দিয়ে ব্যাপারটায় সায় দিলাম। এরপরে বললাম
— তোমাকেও।
এমন সময় কফি এল। ধোঁয়া উঠছে। সুমন এমন গরম কফিই খায়। আমি প্রথমে ফেনাটা খাই, এরপরে একটু ঠান্ডা হলে কফি খাই। আমার মগটা কাছে টেনে নিলাম, ফেনাটাই চুমুক দিলাম। মন বলছে, মূল আলোচনায় যাওয়ার সময় এখনও হয়নি। তাই স্বাভাবিক আলোচনা চালিয়ে গেলাম। বললাম
— তারপর?
সুমন আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। চোখে এখনও হাসি। এরপরে ধীরে ধীরে কফির কাপে চুমুক দিল। আবার আমার দিকে তাকাল। চোখে এখনও প্রেমিক টাইপ দৃষ্টি। অবাক লাগছে, প্রতিশোধের চাহনি আশা করছিলাম। সেটা নেই। স্মিত হেসে বলল
— চলে যাচ্ছে। তোমার খবর বল। সেদিন এমন করলে… ইচ্ছে ছিল তোমার হাজব্যান্ডের সাথে পরিচিত হব। সুযোগই পেলাম না। কি করে হাজব্যান্ড?
ইচ্ছে করেই কি টপিকটা আনল? মূল আলোচনায় আসতে চাইছে? ওর দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম। মনে হচ্ছে আপাতত স্বাভাবিক প্রশ্ন হিসেবেই কথাটা বলেছে।
সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম। সময় নষ্ট করার কোন মানে হয় না। ফিল করলাম, হঠাৎ করেই যেন আত্মবিশ্বাস ফিরে এসেছ। মনে হল, চোখে চোখ রেখে সাহসের সাথে ব্যাপারটা ফেস করা ছাড়া উপায় নেই। একটু ভয় পেয়েছি কি, ও পেয়ে বসবে। বিজয়ের হাসি হাসবে।

— জাস্ট গট স্যাকড টুডে।
আমার গলার আওয়াজে কিছু একটা ছিল। সুমন কফিতে চুমুক দিতে গিয়েও দিল না। মগটা ধীরে ধীরে নামিয়ে রাখল। মনে হল, হেজিটেট করছে। কি বলবে সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। আমি নিস্পলক ওর দিকে তাকিয়ে আছি। ফেনা খেয়ে ফেলেছি। এবার প্রথমবারের মত আমি কফিতে মগে চুমুক দিলাম। এরপরে বললাম
— লেটস কাম টু দ্যা পয়েন্ট।
সুমন আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। চোখ নামিয়ে নিল। এরপরে নিজের মগে চুমুক দিল। গুছিয়ে নিচ্ছে। ওর প্ল্যান অনুযায়ী সম্ভবত কাহিনী এগোচ্ছে না। এক ভীত সন্ত্রস্ত তৃণাকে আশা করছিল। হয়তো ভেবেছিল কাঁদো কাঁদো চেহারায়, ‘আমাকে প্লিজ ছেড়ে দাও।’ টাইপ কিছু বলে ওর কাছে অনুনয় বিনয় করব, ক্ষমা চাইব। তেমনটা না দেখতে পেয়ে কিছুটা অবাক হয়েছে।
কেমন যেন বিজয় অনুভব করতে শুরু করলাম। শাহেদ আমার পাশে আছে। এই অনুভুতিটাই একরাশ আত্মবিশ্বাস এনে দিয়েছে। মনে হচ্ছে, যত সমস্যাই হোক, ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
সুমন কিছুক্ষণ আমার কনফিডেন্ট চেহারা দেখল। হয়তো বুঝতে পারল, ভুল অনুমান করে ফেলেছে। অবিশ্বাস ভরা চোখে দেখছে, সেই উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার হুমকি পেয়ে ভয়ে কাঁপতে থাকা নরম শরম মেয়েটিকে। সাহসে টইটুম্বুর এক তৃণাকে। বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকবার পরে, শান্তভাবে নিজের কফির মগে চুমুক দিল। মগটা নামিয়ে রেখে বলল
— ওকে। লেটস কাম টু দ্যা পয়েন্ট।
এবার আমি সুমনের চোখে চোখ রাখলাম। ওর চোখে এখন সেই স্মিত হাসি আর নেই। নোংরা প্রতিহিংসা জ্বলজ্বল করছে। একদিক দিয়ে ভালোই হল, ওর স্মিত হাসি মাখা, ভন্ড চেহারার সাথে ডিল করতে ভাল লাগছিল না। ওর দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলাম, কতটা ক্রোধ ওর ভেতরে কাজ করছে। বুঝতে চেষ্টা করলাম, প্রতিশোধের জন্য কতটা নীচে ও নামতে পারে। মনে হল, হি ইজ ডেসপারেট। হি ক্যান ডু এনিথিং। সবচেয়ে বাজে পরিস্থিতির জন্য নিজেকে তৈরি করে ফেললাম। মনের কোণে যে সন্দেহ ছিল, শাহেদকে ছেড়ে ওর কাছে ফিরে যেতে বলবে, সেটা ফিরে এল। মনে হল, এই সাইকোপ্যাথ যেকোন কিছু করতে পারে। যতটা সম্ভব কন্ঠকে স্বাভাবিক করে জানতে চাইলাম
— কি চাও?
এমন সরাসরি কথা বোধহয় আশা করেনি। মনে হল এক মুহুর্তের জন্য চমকে উঠল। বুঝে গেল, ব্যাকফুটে খেলার আদৌ কোন ইচ্ছে আমার নেই। ওর প্রতিহিংসার মুখোমুখি হতেই আমি এসেছি। ঘাড় কাত করে ব্যাপারটার খানিকটা প্রশংসা করল মনে হল। এরপরে কফির মগটা নিজের ঠোঁটের কাছে নিয়ে চুমুক দেয়ার ঠিক আগে ছোট্ট করে জানতে চাইল
— দেন আই হ্যাভ টু নো, হোয়াট ইজ ইয়োর অফার? স্বামীর প্রাণ বাঁচাতে কি কি করতে রাজী আছো?

চলবে…

-রাজিয়া সুলতানা জেনি

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *